
আয়ারল্যান্ডের আলুর দুর্ভিক্ষ, ট্রিনিডাডে দাসত্ব, কিংবা আইসল্যান্ডের হাম মহামারির মতো ভয়াবহ সময়েও দেখা গেছে—নারীরা পুরুষদের চেয়ে বেশি দিন বেঁচে ছিলেন।
এটা শুধু কাকতাল নয়, বরং নারীর দেহের জৈবিক গঠন ও প্রতিরোধক্ষমতারই একটি নিদর্শন। এসব নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই লেখক ও পরিবেশবিদ স্টার ভারটান আবিষ্কার করেছেন—নারীদের শরীর প্রকৃত অর্থে তৈরি হয়েছে দীর্ঘায়ু ও সহনশীলতার জন্য।
তাঁর বই “The Stronger Sex” ১৫ জুলাই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।
নারীরা যেমন মাসিক, গর্ভধারণ, সন্তান প্রসব ও বুকের দুধ পান করানোর মতো জটিল ও বিপজ্জনক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যান, তবুও এসবের পরেও তারা পুরুষদের তুলনায় দীর্ঘজীবী হন—এমনকি সেখানে যেখানে মেয়েরা কম খাদ্য, কম চিকিৎসা ও কম সুযোগ সুবিধা পেয়েছে, সেখানেও।
এই প্রবণতা ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে। ইতালির পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেমোগ্রাফি বিভাগের অধ্যাপক ভির্জিনিয়া জারুলি ২০১৮ সালে সাতটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সময়ে বেঁচে থাকার তথ্য বিশ্লেষণ করেন। যেমন—ইউক্রেন, আয়ারল্যান্ড ও সুইডেনের দুর্ভিক্ষ; ট্রিনিডাডের দাসত্ব; আর আইসল্যান্ডে হাম মহামারির সময়।
তিনি দেখেছেন—এই চরম প্রতিকূল পরিবেশেও নারীরা পুরুষদের চেয়ে বেশি বেঁচে ছিলেন, এমনকি সদ্যোজাত কন্যাশিশুরাও বেশি টিকে গেছে। এতে ধারণা করা যায়, নারীর এই টিকে থাকার ক্ষমতা জৈবিকভাবেই নিহিত।
আজকের আধুনিক পৃথিবীতেও এই চিত্র দেখা যায়। সব বয়সে পুরুষদের তুলনায় নারীদের মৃত্যুহার কম — বলছেন গবেষক জারুলি।
X ক্রোমোজোম ও ইস্ট্রোজেন: নারীর দেহে রয়েছে টিকে থাকার গোপন শক্তি
নারীদের দেহে রয়েছে দুটি X ক্রোমোজোম, যেখানে পুরুষদের রয়েছে একটি X ও একটি Y। X ক্রোমোজোম অনেক বড় — এতে ১০ গুণ বেশি জিন থাকে। ফলে নারীর দেহে রোগ প্রতিরোধী জিনের সংখ্যা বেশি, যা তাদের ইমিউন সিস্টেমকে করে আরও শক্তিশালী ও অভিযোজিত।
ড. শ্যারন মোয়ালেম তাঁর বই “The Better Half”-এ বলেন, “নারীরা রোগ প্রতিরোধে পুরুষদের তুলনায় অনেক দ্রুত অভিযোজিত হয়।” ইস্ট্রোজেন হরমোনও এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
নারীদের দেহে নিউট্রোফিল (সাধারণ শ্বেত রক্তকণিকা) বেশি সক্রিয় থাকে এবং তারা বেশি কার্যকর অ্যান্টিবডিও তৈরি করতে পারে। ফলে তাদের শরীর ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অধিক সফল।
তবে এর কিছু নেতিবাচক দিকও আছে—নারীরা অটোইমিউন রোগে বেশি আক্রান্ত হন এবং অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা নিয়েই বেঁচে থাকেন।
টেস্টোস্টেরন: পুরুষদের দুর্বলতা কোথায়
পুরুষদের শরীরে টেস্টোস্টেরনের উচ্চ মাত্রা অনেক সময় তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে। পরীক্ষায় দেখা গেছে—পুরুষ প্রাণীদের ‘নিউটার’ করলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। আবার, নারী প্রাণীদের শরীরে টেস্টোস্টেরন প্রবেশ করালে তা কমে যায়।
এর একটি ব্যাখ্যা হলো—টেস্টোস্টেরন পুরুষদের শরীরকে “জীবনকে উপভোগ করে দ্রুত শেষ” করার প্রবণতার দিকে ঠেলে দেয়।
জীবনযাপন ও খাদ্য গ্রহণেও রয়েছে পার্থক্য
পুরুষরা তুলনামূলকভাবে ধূমপান, মদ্যপান ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বেশি করে—যা তাদের আয়ু কমিয়ে দেয়। তবে গবেষণায় দেখা গেছে—নারীরা যদি একই জীবনযাপনও করে, তবুও তাদের গড় আয়ু বেশি থাকে। অর্থাৎ শুধু জীবনযাপনের কারণে নয়, বরং জৈবিকভাবে নারীর শরীর বেশি টেকসই।
নারীর দেহে ছোট অন্ত্র, বড় কাজ
২০২৩ সালের একটি গবেষণায় উত্তর ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা দেখিয়েছেন—নারীদের ‘স্মল ইনটেস্টাইন’ পুরুষদের তুলনায় দীর্ঘতর। এই অতিরিক্ত দৈর্ঘ্য তাদের খাবার থেকে বেশি পুষ্টি শোষণ করতে সাহায্য করে, যা সন্তান জন্মদান ও দুধ পান করানোর সময় বিশেষভাবে কাজে লাগে।
এটি সম্ভবত ‘Female Buffering Hypothesis’-এর একটি প্রমাণ—যা বলে, নারীদেহ প্রকৃতিগতভাবে প্রতিকূলতা সহ্য করার জন্য তৈরি।
নারীস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা
ঐতিহাসিকভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞান পুরুষের শরীরকেই মানদণ্ড ধরে এগিয়েছে। কিন্তু এখন নারীদেহের জিনতত্ত্ব ও শারীরবৃত্তীয় কার্যকারিতা নিয়ে গভীর গবেষণার দরকার। এতে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই আরও কার্যকর চিকিৎসা ও টিকা তৈরি সম্ভব হবে।
Jahan