প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী
ভারতে ১৮তম লোকসভা নির্বাচনে শুক্রবার থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হচ্ছে। ছয় সপ্তাহ ধরে চলা এই নির্বাচনে এবার প্রায় একশ’ কোটি ভোটার তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করবেন। ফলে এ নির্বাচন হতে চলেছে বিশ্বের এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় নির্বাচন।
নির্বাচন নিয়ে ভারতের রাজনীতির মাঠ এখন সরগরম। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারকে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আনতে মরিয়া। তার প্রমাণ বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে তিনি নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে মোদির উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে।
দেশটির প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসসহ ইন্ডিয়া জোটও বসে নেই। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস এবার পশ্চিমবঙ্গসহ অসমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে প্রচার চালাচ্ছে। দিল্লিতে ক্ষমতাসীন আম আদমি পার্টিসহ দেশটির অন্যান্য রাজ্যের অপেক্ষাকৃত ছোট দলগুলোও প্রচারে ব্যস্ত। কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি রাহুল গান্ধী ইন্ডিয়া জোটের অপর গুরুত্বপূর্ণ নেতা অখিলেশ যাদবকে নিয়ে প্রচারে নেমেছেন। মাঠে সরব রয়েছেন কংগ্রেসের জনপ্রিয় মুখ প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও। গেরুয়া শিবির তাদের উন্নয়ন বার্তা নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছে। আর কংগ্রেস শিবির বলছে, তারা ক্ষমতায় গিয়ে ভারতজুড়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।
এ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হবে সাত দফায়। যে তিন রাজ্যে সাত দফাতেই ভোট নেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম। এছাড়া উত্তরপ্রদেশ ও বিহারেও সাত দফায় ভোট হবে। সেই হিসেবে ১৯ এপ্রিল প্রথম দফায় উত্তরপ্রদেশে ৮ আসন, বিহারের ৪ আসন এবং পশ্চিমবঙ্গের ৩ আসনে ভোট হবে। তবে মহারাষ্ট্র দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লোকসভা আসনের রাজ্য হলেও সেখানে ভোট নেওয়া হচ্ছে ৫ দফায়। খবর এনডিটিভি, এএফপি ও আলজাজিরা অনলাইনের।
৫৪৩ আসনের লোকসভায় বিজেপি এবার ৩৭০ আসনের টার্গেট নিয়ে এগুচ্ছে। আর গেরুয়া শিবির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের লক্ষ্য ৪০০ আসন। গত লোকসভায় বিজেপি-এনডিএ জোট ৩০৩ আসন পায় যেখানে তাদের লক্ষ্য ছিল ৩০০ আসন। ২০১৯ সালের চেয়ে এবার ১০০ আসন বেশি পেতে চাইছে জোট। উত্তরপ্রদেশে রাম মন্দির উদ্বোধনের মধ্যদিয়েই বিজেপি কার্যত প্রচার শুরু করে।
শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহারের ভোট হবে। ১৭তম লোকসভায় এই তিন জেলাতেই গেরুয়া শিবিরকে ভোট দিয়েছিল সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটাররা। তাই এ তিন আসনের গেরুয়া শিবির এবারও জয়ের আশা করছে। আর সেই লক্ষ্যেই পশ্চিমবঙ্গজুড়ে ১৫টি নির্বাচনী সভা করবেন মোদি। প্রচারে থাকবেন অমিত শাহ, রাজনাথ সিং জেপি নাড্ডার মতো হাইপ্রফাইল নেতৃত্বও।
পশ্চিমবঙ্গে মঙ্গলবার নির্বাচনী প্রচারে আসেন মোদি। তিনি বলেন, এবার আমরা চারশ’ আসন পাব। মোদির এ কথার সমালোচনা করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বলেন, এবার দুইশও পার করতে পারবে না বিজেপি।
মোট ২ হাজার ৬৬০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনী যুদ্ধে নেমেছে। জনমত জরিপগুলো বলছে, বিজেপি ও এর মিত্ররা তৃতীয়বারের মতো নির্বাচনে জয়ী হবে।
লোকসভার সবচেয়ে বড় দলের নেতা বা জোটের নেতা সাধারণত প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত হন। প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভা গঠন করেন, যারা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকেন। ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি একাই ৩০৩ আসন পায়।
এই নির্বাচনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ বৃহত্তম বিরোধী দল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোটের পক্ষ থেকে। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স বা ইন্ডিয়া জোটে এরই মধ্যে ২৪ টির বেশি রাজনৈতিক দল যোগ দিয়েছে। এই জোটের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে আছেন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। বর্তমানে কারাবন্দি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল আম আদমি পার্টিও (আপ) এ জোটে আছে।
সঙ্গে আছে আরও কিছু শক্তিশালী আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল। দুর্নীতির অভিযোগে আম আদমি পার্টির তিন নেতা সম্প্রতি গ্রেপ্তার হন। দলটি বলছে, মোদি ও বিজেপি আম আদমির নেতাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছে। তবে বিজেপি এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এই নির্বাচন কেন গুরুত্বপূর্ণ॥ মোদি দাবি করতেই পারেন যে, ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভাল সম্পর্কের কারণে বিশ্বে দেশটির অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চায় চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে তাদের মিত্রদেশ করে রাখতে। মোদি সম্প্রতি ভারতের ৮০ কোটি গরিবের জন্য একাধিক উদার কল্যাণমূলক কর্মসূচি চালু করেছেন। এর মধ্যে বিনা মূল্যে শস্য সরবরাহ এবং কম আয়ের পরিবারের নারীদের মাসে ১ হাজার ২৫০ রুপি ভাতা দেওয়ার মতো বিষয় রয়েছে।
কংগ্রেস তাদের ইশতেহারে বলেছে, ভারতে এখন বেকারত্বের হার অনেক। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। ইশতেহারে বাড়তি কমসংস্থান সৃষ্টি, নারীদের ভাতা বৃদ্ধি এবং কলেজ উত্তীর্ণদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। ভারতকে স্বৈরাচারের পথ থেকে সরিয়ে আনা হবে এমন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে কংগ্রেস।
সংখ্যালঘুদের অভিযোগ, তারা প্রায়ই বৈষম্য ও হামলার শিকার হন। মোদির শাসনামলে তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে বিজেপি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
আন্তর্জাতিক নাগরিক অধিকার সংস্থা ফ্রিডম হাউজ বলেছে, বিজেপি সরকারের সমালোচনা করা ব্যক্তিদের, বিশেষ করে সাংবাদিকদের হয়রানি করার ঘটনা বাড়ছে। সংস্থাটি ভারতকে ‘আংশিকভাবে স্বাধীন’ হিসাবে শ্রেণিভুক্ত করে।
কেন এত দীর্ঘ ভোট ॥ ভারতজুড়ে বিভিন্ন স্থানে ৭টি তারিখে ভোট গ্রহণ চলবে। প্রথম দফার ভোট হবে ১৯ এপ্রিল। এরপর ২৬ এপ্রিল, ৭ মে, ১৩ মে, ২০ মে, ২৫ মে’র ভোটের পর ১ জুন সর্বশেষ দফার ভোট হবে। ফল ঘোষণা হবে ৪ জুন।
লোকসভা আসন কম এমন কয়েকটি রাজ্যে মাত্র একদিনই ভোট হবে। কিন্তু, যেসব রাজ্যে আসন বেশি সেখানে কয়েক দফায় ভোট অনুষ্ঠিত হবে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভারতের জনসংখ্যা। এর সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনের সময়ও দীর্ঘ হয়েছে। যেমন: ১৯৮০’র দশকে ভোটের পুরো সময়টা ছিল মাত্র চারদিন, ২০১৯ সালে তা দাঁড়ায় ৩৯ দিনে, আর ২০২৪ সালে এসে ভোট হচ্ছে ৪৪ দিনব্যাপী।
৫৪৩ লোকসভা আসনে এ নির্বাচনের পাশাপাশি বিধানসভা নির্বাচন হবে চার রাজ্যে। একইসঙ্গে বিধানসভা উপনির্বাচন হবে ১৩টি রাজ্যে।
একাধিক দফায় ভোট গ্রহণের মূল কারণ হচ্ছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে বিপুল সংখ্যক কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করতে হয়। নির্বাচনী সহিংসতা প্রতিরোধ থেকে শুরু করে ভোট জালিয়াতি ঠেকাতে মাঠপর্যায়ে তারা তৎপর থাকে।
ভোটকেন্দ্রগুলোতে নিরাপত্তাকর্মীদের পর্যাপ্ত উপস্থিতি নিশ্চিত করতেই ভোটগ্রহণ ধাপে ধাপে করা হয়। ভোটদানের জন্য লাখ লাখ ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা হবে। ভোটাররা এই যন্ত্র ব্যবহার করে প্রার্থীদের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে পারবেন কিংবা উল্লিখিত প্রার্থীদের ‘কেউ না’ বিকল্পটি বেছে নিতে পারবেন।
কারা ভোট দেবেন ॥ বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারতের জনসংখ্যা ১৪০ কোটির বেশি। এর মধ্যে ৯৬ কোটি ৯০ লাখ ভোটার এবারের নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন, যা বিশ্বের জনসংখ্যার হিসাবে ৮ জনে ১ জন।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশের বেশি ভোটার পাঁচ বছরের জন্য পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষের ৫৪৩ সদস্যকে নির্বাচিত করবেন।
ভোটারদেরকে অবশ্যই ভারতীয় নাগরিক হতে হবে। তাদের বয়স ১৮ বছর বা তার বেশি হতে হবে। ভোটার তালিকায় নাম থাকতে হবে এবং বৈধ ভোটার পরিচয়পত্র থাকতে হবে। বিদেশে বাস করা ১ কোটি ৩৪ লাখ ভারতীয়ও ভোট দিতে পারবে। তবে ভোট দেওয়ার জন্য তাদেরকে নিবন্ধন করতে হবে এবং ভারতে ফিরে আসতে হবে।