ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৫ মে ২০২৫, ২২ বৈশাখ ১৪৩২

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা

মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো প্রক্সি ওয়ারে জড়াবে না বাংলাদেশ

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০১:৩৭, ৫ মে ২০২৫

মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো প্রক্সি ওয়ারে জড়াবে না বাংলাদেশ

মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো প্রক্সি ওয়ারে জড়াবে না বাংলাদেশ

অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি সংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেনটেটিভ ড. খলিলুর রহমান বলেছেন, মানবিক করিডরের’ নামে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো ‘প্রক্সি ওয়ারে’ (ছায়া যুদ্ধ) জড়াবে না বাংলাদেশ; বরং এ নিয়ে যা প্রচার করা হচ্ছে, তা নিছকই অপতথ্য ও গুজব। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ মিয়ানমারের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

দেশটিতে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি হোক, এমন কিছুই বাংলাদেশ চায় না, সেটা দেশটিকে (মিয়ানমার) আবার আশ্বস্ত করছি। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, মানবিক করিডর নিয়ে কোনো আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়নি। এ নিয়ে কোনো পক্ষের সঙ্গে কোনো সমঝোতাও হয়নি।
রবিবার দুপুরে রাজধানীর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) অডিটরিয়ামে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ক এক সেমিনারে এসব কথা বলেন তিনি।  সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ (এএফডি) ও বিইউপি যৌথভাবে এ সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, বিশেষ অতিথি হিসেবে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসান উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়াও সেমিনারে কূটনীতিক, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও সামরিক অ্যাটাশে, সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা, রোহিঙ্গা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/সংস্থার কর্মকর্তা, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং বিইউপি’র ছাত্র-ছাত্রীরা অংশগ্রহণ করেন। এই সেমিনারের মূল লক্ষ্য ছিলো বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের আলোচনা ও অংশগ্রহণকারীদের মতামতের ভিত্তিতে আঞ্চলিক নিরাপত্তার উপর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কৌশলগত প্রভাব ও এর চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত পূর্বক বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতে করণীয় ও সুপারিশ নির্ণয় করা।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে রাখাইনে ‘মানবিক করিডর’ বিষয়ে বিতর্কের প্রসঙ্গ টেনে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, এটা মানবিক করিডর নয়। তারা রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে চ্যানেলের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। আর মানবিক করিডর ও চ্যানেল এক নয়। এমন কিছু (চ্যানেল) হলে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে তা পরিচালিত হওয়ার কথা। এর মাধ্যমে ত্রাণ ও খাদ্য যাবে।

রোহিঙ্গাদের কখনোই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না উল্লেখ করে খলিলুর রহমান বলেন, ‘যদি সেটা করা হয়, তাহলে বাংলাদেশ হবে প্রতিবেশী দেশগুলোর ডাম্পিং গ্রাউন্ড।’  প্রধান অতিথির বক্তব্যে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বর্তমান সরকার একটি সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সম্ভাব্য সকল উপায় ও বহুমাত্রিক কূটনীতি পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে এ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানে আশাবাদী।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অন্যান্য বৈশ্বিক সংঘাতের মধ্যে রোহিঙ্গা সংকটের ওপর থেকে মনোযোগ যেন সরে না যায়, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার বিষয়ে একটি রোডম্যাপ থাকার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। মিয়ানমারের মূল অংশীদার সামরিক জান্তা, আরাকান আর্মি এবং জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) বিধায় যেকোনো স্থায়ী সমাধানে এই তিন পক্ষকেই যুক্ত হতে হবে।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন আরও বলেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি যাই হোক না কেনো, রাখাইনের আঞ্চলিক অবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন স্বাধীনতা আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের উদাহরণ দিয়ে আশা প্রকাশ করেন যে, একদিন সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার পুনঃস্থাপিত হবে।
এদিকে সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর ড. সাহাব এনাম খান। এছাড়া, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের রিসার্চ ডাইরেক্টর আবু সালাহ মোঃ ইউসুফ এবং বিইউপি’র আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোঃ আতাউর রহমান তালুকদার- প্যানেল আলোচক হিসেবে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

পরবর্তীতে, প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের সভাপতি এম হুমায়ুন কবির সেমিনারের উন্মুক্ত আলোচনা ও সারাংশ সেশন পরিচালনা করেন যেখানে অংশগ্রহণকারীরা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত তাদের মতামত ও সুপারিশ তুলে ধরেন।  আর সেমিনারের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন বিইউপি’র উপাচার্য মেজর জেনারেল মোঃ মাহবুব-উল আলম।

বিশেষ অতিথি হিসেবে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার তার বক্তব্যে সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির প্রভাব ও সীমান্ত এলাকায় মিয়ামারের সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতির জটিলতা তুলে ধরে রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানে দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং আঞ্চলিক অংশীদারদের সমন্বিত সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
সেমিনারের আলোচনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে চূড়ান্ত  লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ করলেও বেশ কয়েকটি প্রতিবন্ধকতার বিষয় উঠে আসে, যার মধ্যে রয়েছে রাখাইন অঞ্চলের বর্তমান অস্থিতিশীলতা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে আরাকান আর্মির অনিশ্চিত অবস্থান এবং ভৌগোলিক রাজনীতির বিভাজন। বাংলাদেশকে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক কূটনীতি, নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সংমিশ্রণে একটি বহুমুখী কৌশল গ্রহণের বিষয়ে বক্তারা আহ্বান জানান।

একই সাথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনকে স্থিতিশীল করা, বৈশ্বিক অঙ্গীকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি সব পক্ষের মধ্যে আস্থা গড়ে তোলার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়। সেমিনারটি রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে সামরিক ও বেসামরিক প্রাঙ্গনে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে পদক্ষেপ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে আশা করা হচ্ছে ।
উল্লেখ্য, প্রক্সি ওয়ার’ বা ‘ছায়া যুদ্ধ’ হলো দুটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের মধ্যে এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে কোনো পক্ষ সরাসরি আক্রমণ বা অন্যের প্রতি সামরিক শত্রুতা স্বীকার করে না। কিন্তু ছোট ও শক্তিশালী রাষ্ট্র বা সশস্ত্র মিলিশিয়া তাদের জন্য লড়াইয়ে প্রক্সি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ সোজা কথায় কোনো বড় শক্তির বিরুদ্ধে অন্য একটি বড় শক্তির দ্বারা ব্যবহৃত হওয়ার পরিস্থিতিকেই ‘প্রক্সি ওয়ার’ বলে। অর্থাৎ সোজা কথায় কোনো বড় শক্তির বিরুদ্ধে অন্য একটি বড় শক্তির দ্বারা ব্যবহৃত হওয়ার পরিস্থিতিকেই ‘প্রক্সি ওয়ার’ বলে।

×