
একজন পুরুষ ছোটখাটো গড়নের হলেই কি তিনি আগ্রাসী হবেন? তাকে কি সব সময়ই প্রমাণ করতে হবে, তিনি যথেষ্ট ‘পুরুষ’? এসব ধারণা থেকে জন্ম নিয়েছে একটি প্রচলিত সামাজিক ধারণা ‘লিটল ম্যান সিনড্রোম’। এটি কোনো চিকিৎসাগত সমস্যা নয়, বরং একটি বিভ্রান্তিকর স্টেরিওটাইপ, যা ক্ষতিগ্রস্ত করে মানসিক স্বাস্থ্যকে।
লিটল ম্যান সিনড্রোম কী?
‘লিটল ম্যান সিনড্রোম’, কিংবা ‘ন্যাপোলিয়ন কমপ্লেক্স’ হিসেবে পরিচিত এই ধারণাটি মূলত একটি সামাজিক ছক। ধারণাটি বলছে, গড়ন ছোট পুরুষরা নিজের উচ্চতা নিয়ে কম আত্মবিশ্বাসী থাকেন এবং সেই ঘাটতি ঢাকতে বেশি মাত্রায় কর্তৃত্বপূর্ণ বা আক্রমণাত্মক আচরণ করেন।
এই নামটি এসেছে ফরাসি সামরিক নেতা ন্যাপোলিয়নের নাম থেকে, যাকে ভুলভাবে অনেকেই খাটো মনে করেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি তার উচ্চতা ঢাকতেই ছিলেন এতটা যুদ্ধপাগল ও কর্তৃত্বপরায়ণ। যদিও ইতিহাসবিদরা প্রমাণ করেছেন, ন্যাপোলিয়নের উচ্চতা তার সময়ে গড় উচ্চতার কাছাকাছিই ছিল।
আধুনিক সমাজে ‘লিটল ম্যান সিনড্রোম’ দিয়ে বোঝানো হয় এমন একজন ব্যক্তি, যিনি উচ্চতা বা অন্য কোনো শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগেন এবং সেই ঘাটতি পূরণে আত্মপ্রতিপন্ন, দমনমূলক বা আক্রমণাত্মক আচরণ করে থাকেন।
এটি কীভাবে প্রভাব ফেলে পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্যে?
এই স্টেরিওটাইপ নিজেই একটি মানসিক চাপ হয়ে দাঁড়ায় অনেক পুরুষের জীবনে। কারও আচরণ আগ্রাসী না-হলেও সমাজ তাকে ‘সিনড্রোম’-এর ছকে ফেললে তৈরি হয় আত্মসম্মানহীনতা, উদ্বেগ বা বিষণ্নতা। ২০২৫ সালের একটি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দেহসচেতনতা বা বডি ইমেজ সংক্রান্ত উদ্বেগ পুরুষদের মধ্যে বাড়ছে, যা থেকে সৃষ্টি হতে পারে-
আত্মবিশ্বাসের অভাব,দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্নতা,সামাজিক উদ্বেগ।
এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বার্তা দেয়: ‘ছোট পুরুষ মানেই দুর্বল’, masculinity মানেই কর্তৃত্ব ও ভয় দেখানো, যা একটি বিপজ্জনক বার্তা।
আক্রমণাত্মক আচরণ মানেই কি লিটল ম্যান সিনড্রোম?
না। দমনমূলক বা সহিংস আচরণের জন্য কখনোই শারীরিক গড়ন দায়ী নয়। কাউকে তার উচ্চতার জন্য হেয় করা যেমন অন্যায়, তেমনি কারও খাটো গড়নের আড়ালে সহিংসতা বা মানসিক নির্যাতনকে যুক্তিযুক্ত বলাটাও মারাত্মক ভুল।
একজন ব্যক্তি যদি ক্রমাগত ইচ্ছামতো কর্তৃত্ব করতে চান,আপনাকে বন্ধু বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চান,অস্বাস্থ্যকর ঈর্ষা দেখান,দোষ চাপিয়ে আপনাকে অপরাধবোধে ভোগান তাহলে সেটি তার ব্যক্তিত্বগত সমস্যা, যা আপনি কখনোই সহ্য করতে বাধ্য নন।
বিষাক্ত পুংলিঙ্গ মানসিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো জরুরি কেন?
‘পুরুষ মানে শক্ত হতে হবে’, ‘পুরুষের চোখে জল নেই’, ‘পুরুষ মানেই নেতৃত্ব করবে’ এসব বিশ্বাস পুরুষদেরকেই চাপে ফেলে। অনেকে সামাজিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে নিজেদের আবেগ দমন করেন, সম্পর্কের উপর কর্তৃত্ব কায়েমের চেষ্টা করেন, এমনকি নারীদের কাজ বলে বিবেচিত কাজ এড়িয়ে চলেন।
এই মানসিকতা থেকে জন্ম নেয় প্রতিযোগিতার অস্বাস্থ্যকর মানসিকতা,সম্পর্ক নষ্ট করা দমনমূলক আচরণ,আবেগ প্রকাশে সংকোচ,সামাজিক সহিংসতা।তাই এসব আচরণ চ্যালেঞ্জ করা, সচেতনতা বাড়ানো এবং নিরাপদ পরিবেশে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন।
‘লিটল ম্যান সিনড্রোম’ বলতে যা বোঝানো হয়, তা কোনো বাস্তব রোগ নয় বরং একটি সামাজিক ছক, যা ছোট উচ্চতার পুরুষদের নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। এটি শুধু ক্ষতিকর স্টেরিওটাইপই নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও ফেলতে পারে গুরুতর প্রভাব।
তাই শারীরিক বৈশিষ্ট্যের বদলে, মূল্যায়ন করা উচিত আচরণ ও মনন দিয়ে।
সূত্র:https://tinyurl.com/yn9sbvr9
আফরোজা