
ছবি:সংগৃহীত
আপনি যদি কখনও কোনও যুদ্ধবিমান উড়তে দেখেন, তাহলে নিশ্চয়ই রানওয়ে দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে দৌড়ে আকাশে ওঠার দৃশ্য চোখে ভাসে। কিন্তু কল্পনা করুন এমন একটি যুদ্ধবিমান, যেটা ঠিক হেলিকপ্টারের মতো সোজা ওপরে উঠে যায়, তারপর মেঘ ভেদ করে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুনতে যেন সিনেমার দৃশ্য, তাই না? অথচ এই দৃশ্য এখন বাস্তব — কারণ প্রযুক্তির বিস্ময় VTOL (Vertical Take-Off and Landing) এবং STOVL (Short Take-Off and Vertical Landing) প্রযুক্তি আমাদের সেই সক্ষমতা এনে দিয়েছে।
এই প্রযুক্তির সাহায্যে যুদ্ধবিমানগুলো ছোট জায়গা থেকে উড়তে পারে, এমনকি রানওয়ে ছাড়াই! যুদ্ধজাহাজ, পাহাড়ি এলাকা বা সীমান্তবর্তী দুর্গম অঞ্চলে এই ক্ষমতা তাদের ভয়ংকর কার্যকর করে তোলে।
চলুন, এমন চারটি যুদ্ধবিমান সম্পর্কে জানি, যেগুলো শুধু প্রযুক্তির চমকই নয়, যুদ্ধক্ষেত্রের খেলাও পাল্টে দিয়েছে।
১. F-35B Lightning II — ভবিষ্যতের যুদ্ধবিমান
যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি F-35 পরিবারের এই সংস্করণটি যেন এক টুকরো ভবিষ্যৎ। F-35B হলো এমন একটি যুদ্ধবিমান, যেটি চাইলেই ছোট জায়গা থেকে উড়তে পারে এবং একদম হেলিকপ্টারের মতো সোজা নিচে নামতে পারে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই পুরো রূপান্তর ঘটে একটি মাত্র বোতাম চাপলেই!
এতে রয়েছে Rolls-Royce-এর বিশেষ লিফট ফ্যান এবং ঘূর্ণনশীল থ্রাস্টার, যেগুলোর মাধ্যমে এটি ভার্টিকাল টেক-অফ বা ল্যান্ডিং করতে পারে। আর স্টেলথ প্রযুক্তি থাকায় এটি শত্রুর রাডারে প্রায় অদৃশ্য।
বর্তমানে মার্কিন মেরিন, ব্রিটিশ ও জাপানি নৌবাহিনীসহ অনেক দেশেই এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
২. AV-8B Harrier II — রানওয়েবিহীন যুদ্ধের অগ্রদূত
Harrier নামটি শুনলেই অনেকের চোখে ভেসে ওঠে একটি আশ্চর্য উড়ন্ত যন্ত্র, যেটা এক জায়গা থেকে সোজা উপরে উঠে যেতে পারে। Harrier II হলো সেই বিখ্যাত Harrier-এর আধুনিক সংস্করণ, যা ১৯৮০-এর দশকে মার্কিন বাহিনীতে যুক্ত হয়।
এর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব — এটি ছিল প্রথম বাস্তবিক সফল STOVL যুদ্ধবিমান। ছোট জাহাজ, অস্থায়ী ঘাঁটি বা দুর্গম এলাকা থেকে এটি চালানো যেত।
তবে এটি চালাতে হতো অত্যন্ত দক্ষ পাইলটকে, কারণ ভারসাম্য রক্ষা করা ছিল চ্যালেঞ্জিং। সেই কারণেই এখন ধীরে ধীরে এর জায়গা নিচ্ছে আরও আধুনিক F-35B।
৩. Yak-38 Forger — সোভিয়েতের এক সাহসী চেষ্টা
স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নও পিছিয়ে ছিল না। তারা তৈরি করেছিল Yak-38 — দেখতে মার্জিত, কিন্তু ব্যবহারিক দিক থেকে কিছুটা সীমাবদ্ধ।
এই বিমানটির তিনটি ইঞ্জিন ছিল, যার মধ্যে দুটি শুধু টেক-অফ বা ল্যান্ডিংয়ের সময় ব্যবহৃত হতো। কিন্তু এতে ছিল জ্বালানির সমস্যা, কম রেঞ্জ এবং ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় কর্মক্ষমতায় সমস্যা। তাই বেশিদিন টেকেনি — ১৯৯১ সালেই এর অপারেশনাল জীবন শেষ হয়।
তবুও, ইতিহাসের পাতায় Yak-38 একটি সাহসী প্রয়াস হিসেবেই থেকে যাবে।
৪. Harrier GR.1 — যেখানে শুরু হয়েছিল রানওয়েবিহীন যুদ্ধ
সব কিছুর শুরুটা হয়েছিল ব্রিটেন থেকে। Harrier GR.1 ছিল বিশ্বের প্রথম সফল যুদ্ধবিমান, যা এক জায়গা থেকে উড়তে এবং নামতে পারত। ১৯৬৯ সালে এটি যুক্ত হয় ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্সে, আর যুদ্ধের পদ্ধতিতে আনায় এক বড় পরিবর্তন।
যদিও এটি সাবসনিক — শব্দের চেয়ে ধীর — তবু এর সেই সময়কার প্রযুক্তি ছিল অকল্পনীয়। আজ আমরা যে F-35B দেখি, তার ভিত্তিটা তৈরি করেছিল এই বিমানটি।
যুদ্ধ মানেই শুধু গোলাগুলি নয়, কৌশলের লড়াই। আর কৌশল তখনই সফল হয়, যখন প্রযুক্তির সাথে তাল মেলে। এই চারটি যুদ্ধবিমান ঠিক সেটাই করে দেখিয়েছে। শত্রুর চোখ এড়িয়ে, সীমিত জায়গা থেকেও আকাশে উড়ে গিয়ে, আঘাত হানে যেখানে প্রয়োজন — রানওয়ে ছাড়াই।
ভবিষ্যতের যুদ্ধগুলোতে আমরা হয়তো আরও এমন বিমান দেখতে পাব, যেগুলো এক জায়গা থেকে উড়ে গিয়ে, আবার ঠিক সেখানেই ফিরে আসবে — নিঃশব্দে, অদৃশ্যভাবে। রানওয়ের দিন হয়তো গোনা শুরু হয়ে গেছে।
মারিয়া