
ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ময়দানে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে আগত মুসল্লিরা ঈদের নামাজ আদায় করছেন
উপমহাদেশের বৃহত্তম ঈদগাহ হচ্ছে কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ময়দান। জেলা শহরের বুকচিরে বয়েচলা এককালের খরস্রোতা নরসুন্দা নদীর তীর ঘেঁষে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মনোরম পরিবেশে এর অবস্থান। বড় জামাতে ঈদের নামাজ পড়লে অধিক সওয়াব পাওয়া যায়-এ বিশ্বাসে প্রতিবছর ঈদুল ফিতরে দেশ-বিদেশের লাখো মুসল্লির সমাগম ঘটে শোলাকিয়া ঈদগাহে। প্রায় ৭ একর আয়তনের মাঠ কানায় কানায় ভরে ওঠে মুসল্লিদের অংশগ্রহণে। মাঠ ভরেও আশপাশের খালি রাস্তা, জায়গা-জমি, বসতবাড়ির আঙ্গিনা-ছাদ, নদীর পাড়সহ যে-যেখানে পারে বহু সংখ্যক মুসল্লি চাদর বিছিয়ে জামাতে শরিক হয়। এতবড় জামাত চোখে না দেখলে বিশ্বাস করাই কঠিন। প্রতি বছরই এ জামাতের প্রতি ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের আকর্ষণ বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় এর কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ও পরিধি বিস্তৃত হয়নি। মক্কা শরীফের হজব্রত ও টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমার পরেই মুসলমানদের সর্ববৃহৎ জমায়েত অনুষ্ঠিত হয় এ মাঠে। শোলাকিয়ার ঈদগাহ নিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য ও জনশ্রুতি। কিন্তু ২০১৬ সালের ৭ জুলাই ঈদুল ফিতরের দিন সকালে আকস্মিক শোলাকিয়ার পাশে জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটে। এতে অনেকে নিহত-আহত হয়। এরপর থেকে মুসল্লিদের মনে একধরনের ভীতির সঞ্চার হয়। সেই ভীতি জয় করে দেশ-বিদেশের লাখো লাখো মানুষ প্রতিবছর শোলাকিয়া ঈদগাহে নামাজ পড়তে ছুটে আসেন।
বিভিন্ন বাহিনীর কয়েকস্তরের কঠোর নিরাপত্তায় বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে বৃহৎ এ ঈদগাহ ময়দানের জামাত দেশ-বিদেশ মানুষ দেখতে পাচ্ছে। প্রতিবছর স্যাটেলাইট চ্যানেল আইসহ কয়েকটি টেলিভিশন এ মাঠের নামাজ সরাসরি সম্প্রচার করে থাকে। এতে করে মাঠে না আসতে পারলেও অগণিত দর্শকশ্রোতা মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন। এবারের ঈদেও শোলাকিয়া ঈদগাহ পরিচালনা কমিটি মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম এ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরের জামাত অনুষ্ঠানে সর্বস্তরের মানুষের সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করেছেন।
সোয়া লাখিয়া থেকে শোলাকিয়া নামকরণ ॥ শোলাকিয়া ঈদগাহের নামকরণের সঠিক ইতিহাস এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। শোলাকিয়ার নামকরণ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এলাকায় প্রচলিত আছে একাধিক জনশ্রুতি। শোলাকিয়ায় প্রথম ঈদের জামাতেই বিপুল পরিমাণ মুসল্লি অংশ নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে দিন দিন এ মাঠে মুসল্লির সংখ্যা বাড়তে থাকে। কথিত আছে, কোনো এক ঈদের জামাতে লোকসংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে সোয়া লাখে (১ লাখ ২৫ হাজার) পৌঁছেছিল। সেই থেকে এ মাঠের নামকরণ হয় ‘সোয়া লাখ’ থেকে ‘সোয়া লাখিয়া’। পরে কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষার বিবর্তিত উচ্চরণে দাঁড়ায় ‘শোলাকিয়া’। এ বিষয়ে অপর জনশ্রুতি হচ্ছে, জমিদাররা প্রজাদের কাছ থেকে যে ভূমি রাজস্ব আদায় করতেন তার পরিমাণ কোনো এক বছর রেকর্ড পরিমাণ অর্থাৎ সোয়া লাখ মুদ্রায় দাঁড়িয়েছিল। এই কারণে এর নাম ‘সোয়া লাখিয়া’ বা শোলাকিয়া হয় বলে ধারণা করা হয়। তবে প্রথম জনশ্রুতি থেকে শোলাকিয়া নামকরণ করা হয় বলে এলাকায় বহুল প্রচলিত রয়েছে।
শোলাকিয়া ঈদগাহের গোড়াপত্তন ॥ শোলাকিয়া ঈদগাহের গোড়াপত্তন নিয়ে মতান্তর থাকলেও তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণে জানা যায়, বর্তমান শোলাকিয়া সাহেব বাড়ির পূর্ব পুরুষ শাহ সূফী মাওলানা সৈয়দ শাহ আহাম্মদ (র) নেতৃত্বে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে শোলাকিয়া মাঠে ঈদুল ফিতরের প্রথম জামাত অনুষ্ঠিত হয়। তিনিই ওই জামাতে ইমামতি করেন এবং তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে হয়বতনগর ও জঙ্গলবাড়ির তদানীন্তন জমিদারগণ উক্ত জামাতে অংশ নেন। এরপর থেকে নিয়মিতভাবে এ মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বাংলার বার ভূঁইয়া প্রধান বীর ঈশা খাঁর ষষ্ঠ পুরুষ কিশোরগঞ্জ শহরের হয়তবনগরের জমিদার দেওয়ান হয়বত খাঁর আমলে এ ঈদগাহের প্রসার হয়। ১৯৫০ সালে ঈশা খাঁর ১৪তম পুরুষ হয়বতনগরের শেষ জমিদার দেওয়ান মান্নান দাদ খাঁন এ ঈদগাহ মাঠের জন্য ৪ দশমিক ৩৫ একর জমি ওয়াকফমূলে দান করেন। এ ওয়াকফ দলিলমতে, দলিল সম্পাদনের আরও কমপক্ষে আড়াইশ’ বছর পূর্ব থেকে এখানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এ হিসাবে ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ তিনশ’ বছরেরও প্রাচীন।
ওয়াকফ দলিলে উল্লেখ করা হয়, এ মাঠের ওয়াকফ সম্পদে পূর্বের কোনো লিখিত দলিল না থাকায় কেন্দ্রীয় ওয়াকফ বিধানমতে ওই ওয়াকফ কমিশনার অফিসে নামভুক্ত করা যাচ্ছিল না। এ জন্য জমিদার দেওয়ান মান্নান দাদ খাঁন এ দলিল করে দিয়েছিলেন। যেখানে তিনি নিজেও এ মাঠের মোতাওয়াল্লি থাকা ছাড়াও তার পূর্ব পুরুষগণও মোতাওয়াল্লি ছিলেন বলে লিপিবদ্ধ রয়েছে। হয়বতনগর জমিদার বাড়ির তৎকালীন জমিদার সৈয়দ মো. আবদুল্লাহ ১৮২৯ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত এই শোলাকিয়া মাঠে ইমাম ছাড়াও তিনি এই ঈদগাহের মোতাওয়াল্লি ছিলেন। পর্যায়ক্রমে হয়বতনগর জমিদার পরিবার থেকে মোতাওয়াল্লি নিযুক্ত হয়ে আসছে। সর্বশেষ মোতাওয়াল্লি ছিলেন এই জমিদার পরিবারেরই সদস্য দেওয়ান ফাত্তাহ দাদ খান মঈন।
বর্তমানে একনজরে শোলাকিয়া ॥ কালের বিবর্তনে ১৯৯৬ সালে সরকার ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের প্রভূত উন্নতি সাধন করে। বর্তমানে স্থানীয় প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতা, অর্থানুকূল্যে এবং জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় শোলাকিয়া মাঠ সার্বিকভাবে বিকাশ লাভ করেছে। দিন দিন মাঠের সীমানা ছাড়িয়ে মুসল্লিদের সংখ্যা যেন বেড়েই চলেছে। শোলাকিয়া ময়দানে বর্তমানে কিশোরগঞ্জ মৌজায় ভূমির পরিমাণ ৬.৬১ একর। চারদিকে সাদা দেয়াল ঘেরা মাঠের পশ্চিম সীমারেখা উত্তর-দক্ষিণে ৩৩৫ ফুট এবং পূর্ব সীমারেখা উত্তর-দক্ষিণে ৩৪১ ফুট, উত্তর সীমারেখা পূর্ব-পশ্চিমে ৯১৪ ফুট। ঈদের সময় মাঠের উত্তর-দক্ষিণে ২৬৫টি কাতার বা সারি হয়। প্রতি সারিতে ৫শ’ করে স্বাভাবিকভাবে মুসল্লি দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে পারেন। সে হিসেবে মুসল্লির সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৩২ হাজার ৫শ’। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মাঠের ভেতর-বাইরে প্রতিবছর ঈদুল ফিতরে মুসল্লির সংখ্যা হয় দ্বিগুণ বা দ্বিগুণের বেশি। গত বছর জামাতে রেকর্ড সংখ্যক মুসল্লি অংশ নেন। বর্তমানে মাঠের পশ্চিম দিকে নির্মিত দ্বিতল মিম্বরটি সংস্কার করা হয়েছে। সাউন্ড সিস্টেমেরও উন্নয়ন করা হয়েছে। নতুনভাবে নির্মিত হয়েছে অজুখানা। এছাড়া বৃষ্টিতে ঈদগাহের আশপাশে কোথাও যেন পানি না জমে সে জন্য পানি নির্গমনের দিকটিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে শোলাকিয়া ॥ শোলাকিয়া ঈদগাহের খ্যাতি কিংবদন্তির মতো দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে দেশ থেকে দেশান্তরে। ইতোমধ্যে মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ ও রায়ে শোলাকিয়া ঈদগাহ ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক রাষ্ট্রীয় নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃতি ও মর্যাদা লাভ করেছে। এ ব্যাপারে অন্যত্র যাই থাকুক না কেন, অত্র গঠতন্ত্র শোলাকিয়া ঈদগাহ ও তৎসংশ্লিষ্ট সকল কিছু পরিচালনায় প্রাধান্য বিস্তার করবে। অত্র গঠনতন্ত্র ও গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সংক্রান্ত যাবতীয় প্রসিডিং কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে রেকর্ড হিসেবে সংরক্ষিত থাকবে। অপরদিকে কালক্রমে শোলাকিয়া ঈদ জামাতে মুসল্লিদের আগমন ও জমায়েত বৃদ্ধি পাওয়ায় মুসল্লিদের সুযোগ-সুবিধার জন্য তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের নেতৃত্বে ও শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে ‘কিশোরগঞ্জ শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ পরিচালনা কমিটি’ মাঠ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ২০০৯ সাল থেকে স্থানীয় প্রশাসন শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ পরিচালনা দেখভাল করে আসছে। হয়বতনগর দেওয়ান বাড়ির একজন প্রতিনিধি জমিদাতা হিসেবে মাঠের মোতাওয়াল্লি থাকার পাশাপাশি বর্তমান কমিটিতে পদাধিকার বলে জেলা প্রশাসক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার দায়িত্ব পালন করছেন।
শোলাকিয়া ঈদ জামাতের ঐতিহ্য ॥ এ এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার! শুধুমাত্র ঈদের দু’রাকাত নামাজে জামাতের সঙ্গে অংশ নেওয়ার জন্য শোলাকিয়ায় লাখো জনতার ঢল নামে। ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে ঈদের জামাত আদায় করতে দু’একদিন পূর্ব থেকেই কিশোরগঞ্জ অভিমুখে যাত্রা শুরু হয় অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মানুষের কাফেলা। দল বেঁধে ধর্মপ্রাণ মানুষের কাফেলায় কিশোরগঞ্জ শহর যেন পরিণত হয় ধর্মপ্রাণ মানুষের মহামিলন ক্ষেত্রে। অগণিত মানুষ আশ্রয় নেন শহরের আবাসিক হোটেল, মসজিদ-মাদ্রাসাগুলোতে, আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি এবং শোলাকিয়া ঈদগাহ ও আশপাশ এলাকায়।
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ধর্মপ্রাণ লাখো মানুষের এ সম্মিলনে অংশ নিতে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকাসহ প্রতিবেশী দেশ ভারত, মায়ানমার, পাকিস্তান তথা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিগণও আসেন শোলাকিয়া ঈদগাহে। আর এ কারণে ঈদুল ফিতরের জামাতের সময় শোলাকিয়া প্রান্তর পরিণত হয় ধর্মপ্রাণ মানুষের জনসমুদ্রে।
বিশ্ব মুসলিম উম্মার শান্তি-সংহতি, জাতীয় অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি কামনা করে এ জামাতে অনুষ্ঠিত মোনাজাতের সময় ধর্মপ্রাণ মানুষের আমিন! আমিন!! ধ্বনি গগন বিদারি রূপ ধারণ করে আশপাশ এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। ঈদুল ফিতরের এ মহামিলন উৎসব উপলক্ষে কিশোরগঞ্জ শহরকে সাজিয়ে তোলা হয় অপরূপ সাজসজ্জায়। পৌরসভা, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির উদ্যোগে আলোকসজ্জার পাশাপাশি দেশ-বিদেশ থেকে আগত অতিথিদের ঈদের পয়গাম জানিয়ে তৈরি করা হয় অসংখ্য বর্ণাঢ্য তোরণ। এছাড়া বৃহত্তম এ ঈদ জামাতকে কেন্দ্র করে মাঠ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় হস্ত, কারু ও নানারকম শিল্পের মেলা বসে।
অন্যদিকে দেশ-বিদেশ থেকে আগত মুসল্লিগণের তত্ত্বাবধান এমনকি সেবা দিতে এগিয়ে আসে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মপরায়ণ ও সমাজ হিতৈষী ব্যক্তি। তথ্য প্রযুক্তির প্রসার ও মিডিয়ার বদৌলতে শোলাকিয়া ঈদগাহের ঈদে বড় জামাতের খবর ক্রমান্বয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে।
জামাত শুরু হয় যেভাবে ॥ নামাজ শুরুর সময় এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ভালো করে দেখা যায় না। অনেকে মিম্বরের দোতলায় ইমামকে দেখতে পারেন না। তাই মাঠের বিভিন্ন স্থানে ৫০-৬০টির মতো মাইক লাগানো থাকে। কয়েক সারি পরপর এক একটি উঁচু স্থানে একজন করে মুসল্লি ইমামের অনুকরণে সজোরে আওয়াজ করেন। অন্য মুসল্লিরা তাদের অনুসরণ করেন। প্রথানুযায়ী ঈদের নামাজ শুরুর ৫ মিনিট আগে ৩টি, ৩ মিনিট আগে ২টি ও ১ মিনিট আগে ১টি শর্টগানের গুলি ফুটিয়ে জামাত আরম্ভের ঘোষণা দেওয়া হয়। এদিকে শোলাকিয়া ঈদগাহ জামাতের মোনাজাতের সময় মাঠের বাইরে বিভিন্ন বাড়ি-ঘর এমনকি খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে বিভিন্ন বয়সের হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ নারীরাও অংশ নেন।
শোলাকিয়া ইমামের পরিচয় ॥ সুপ্রাচীন শোলাকিয়া ঈদগাহে ১৯৭৫-২০০৩ সাল পর্যন্ত অবৈতনিকভাবে ঈদের জামাতে ইমামতি করেছেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ হয়বতনগর আলিয়া মাদ্রাসার প্রাক্তন অধ্যক্ষ প্রয়াত মুফতি আবুল খায়ের মোহাম্মদ নূরুল্লাহ (র.)। তাঁর মৃত্যুর পর ২০০৪ সাল থেকে ইমামতির দায়িত্ব পান তারই ছেলে মুফতি আবুল খায়ের মোহাম্মদ ছাইফুল্লাহ (দা:বা:)। তিনি এর আগে শহরের এসভি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মহিলাদের ঈদ জামাত প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে ৯ বছর ইমামতি করেন। মাওলানা ছাইফুল্লাহ ১৯৯৬ সালে সরকারি মাদ্রাসা-ই আলিয়া ঢাকা থেকে কামিল (হাদিস), ১৯৯৮ সালে হয়বতনগর এ. ইউ আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কামিল (তাফসির) ও ২০০০ সালে কামিল (ফিকাহ) সম্পন্ন করেন এবং প্রতিটি স্তরেই ১ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। এছাড়াও তিনি ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন সরকারি কলেজ থেকে এমএ (ইসলামিক স্টাডিজ) ও এমএ (ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি) বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। ইতোমধ্যে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে এমফিল কোর্স ওয়ার্ক সম্পন্ন করেন। শিক্ষাজীবনে তিনি ইউনেস্কো অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অর্ধশতাধিক পুরস্কার অর্জন করেন। একইভাবে পেশাগত জীবনেও বিভিন্ন বিষয়ে পদকপ্রাপ্ত হয়েছেন। ধর্মীয় কাজে তিনি সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেছেন। বিভিন্ন মিডিয়ায় গবেষণাধর্মী বিষয়ে লিখেছেন এবং ধর্মীয় আলোচক হিসেবে তিনি সমাদৃত হয়েছেন।
প্রসঙ্গত: প্রতি বছরই ঈদের আগে শোলাকিয়া ঈদ জামাতের জন্য ইমাম নির্ধারণ করা হয়। ২০০৪ সাল থেকে মুফতি আবুল খায়ের মোহাম্মদ ছাইফুল্লাহ নিয়মিতভাবে ইমামের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। কিন্তু ২০০৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর স্থানীয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে তৎকালীন জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে মাঠ পরিচালনা কমিটি ঈদগাহের বৈধ ইমামকে সরিয়ে দেয়। পরে তৎকালীন কমিটি ইসলাহুল মুসলেমিন পরিষদের চেয়ারম্যান মুফতি ফরিদউদ্দীন মাসউদকে ইমাম হিসেবে নিয়োগ দেয়। এরপর থেকে তিনিই শোলাকিয়া ঈদগাহে ইমামতি করছিলেন। কিন্তু ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থান পটপরিবর্তনে ২০২৫ সালের ২ মার্চ যথাযথ কর্তৃপক্ষ আবারও মুফতি ছাইফুল্লাহকে শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম হিসেবে পুনর্বহাল করেন।
শোলাকিয়া যাওয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা ॥ বাস, মাইক্রো, প্রাইভেটকার, ট্রেন কিংবা নৌ-যানেও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ প্রান্তরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা যায়। বিশেষ করে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ঢাকা-কমলাপুর ও ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ অভিমুখে বিশেষ ট্রেন চালু করা হয়। চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও রাজশাহী থেকে সরাসরি কিশোরগঞ্জগামী বাস রয়েছে। ঢাকার কমলাপুর থেকে সকাল এবং সন্ধ্যা দু’বার এগারোসিন্দুর নামে আন্তঃনগর ট্রেনটি চলাচল করে। এছাড়া গোলাপবাগ-মহাখালী থেকে বাস চলাচলের পাশাপাশি গুলিস্তান ও সায়েদাবাদ থেকে গেটলক ও সাধারণ বাস সার্ভিস রয়েছে। ট্রেনযোগে ভৈরব ভায়া কিশোরগঞ্জ কিংবা নৌ-পথে চামটা নৌ-বন্দর ভায়া কিশোরগঞ্জ যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। এছাড়া রাজশাহী থেকে ট্রেনে সিরাজগঞ্জ এসে সেখান থেকে সরাসরি কিশোরগঞ্জগামী বাস পাওয়া যায়। খুলনা থেকে ট্রেনযোগে ঢাকা, ঢাকা থেকে ট্রেনযোগে ভৈরব ভায়া কিশোরগঞ্জ কিংবা ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ ভায়া কিশোরগঞ্জ যাওয়া যায়। বরিশাল থেকে লঞ্চযোগে কিংবা বাসযোগে ঢাকা এসে বাস কিংবা ট্রেনযোগে ময়মনসিংহ অথবা ভৈরব ভায়া কিশোরগঞ্জ যাওয়া যায়।
শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলা ও মামলা কার্যক্রম ॥ ২০১৬ সালের ৭ জুলাই ঈদুল ফিতরের দিন ঘড়িতে তখন বাজে সকাল পৌনে নয়টা। এমন সময় ঈদগাহের পাশে শোলাকিয়াস্থ সবুজবাগ মুফতি মুহাম্মদ আলী মসজিদের কাছে পুলিশের একটি নিরাপত্তা চৌকিতে অতর্কিত সশস্ত্র হামলা চালায় জঙ্গিরা। ঈদের নামাজ শুরুর কিছু আগে খুশির এইদিনে জঙ্গিদের বোমা আর গুলির শব্দে তখন কেপে ওঠে শোলাকিয়া ময়দানের আশপাশ। শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে জঙ্গিদের বন্দুকযুদ্ধ। এ সময় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। হামলায় পুলিশের দুই কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম ও আনসারুল হক এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে ঝর্ণা রানী ভৌমিক নামে স্থানীয় এক গৃহবধূ নিহত হয়। এছাড়া পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় আবির রহমান নামে এক জঙ্গি। আহত অবস্থায় আটক করা হয় শফিউল ইসলাম ডন নামে এক জঙ্গিকে। পরে সেও মারা যায় র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে। হামলার ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। আজও সেই দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে এলাকার মানুষকে। দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ভয়াবহ এ হামলা মামলায় আদালতে চার্জশিট দিতেই সময় লেগেছে দুই বছর। চার্জশিট দেওয়ার পর মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন শুরু হলেও এরপর আর তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। এদিকে এ ঘটনার এতবছর কেটে গেলেও এখনো আতংক কাটেনি শোলাকিয়া ঈদগাহের আশপাশের এলাকাবাসীর। শোক কাটেনি নিহত ও আহতদের পরিবারে। ভয়াবহ এ জঙ্গি হামলা মামলার বিচার কার্যক্রমও চলছে ধীর গতিতে। জঙ্গি হামলা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ঘটনাস্থল মুফতি মুহাম্মদ আলী মসজিদের ইমাম জানান, তিনি ওই সময় মসজিদের দ্বিতীয় তলা থেকে এমন বর্বরোচিত হামলার পর স্বাভাবিক হতে কয়েকদিন সময় লেগেছিল। ইসলাম কখনো সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ সমর্থন করে না। জঙ্গিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলেই নিহতদের আত্মা শান্তি পাবে।
শেষ কথা ॥ প্রতি বছর দেশের বৃহত্তম ঈদ জামাত শোলাকিয়ায় লাখো মানুষের সমাগম ঘটে। এতে মুসল্লিদের পদচারণায় ঈদগাহের পুরো মাঠ কানায় কানায় ভরে যায়। তখন মাঠে জায়গা না পেয়ে দেশ-বিদেশের আগত মুসল্লিদের ঈদের নামাজ আদায় করতে খুবই কষ্ট হয়। এছাড়া যানজটে পড়ে অনেক মুসল্লি নামাজে অংশ নিতে পারেন না। এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা প্রবীণ সাংবাদিক ও লেখক মু আ লতিফ বলেন, মাঠের সুনাম দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় মুসল্লিদের সমাগম বাড়ছেই। এ পরিস্থিতিতে ঈদগাহ ময়দানের জায়গা বৃদ্ধিসহ মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে চলাচলের সুবিধার্থে শোলাকিয়ায় আসার রাস্তাগুলো প্রশস্তকরণ এখন সময়ের দাবি। তিনিসহ আগত মুসল্লিরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট এ ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের জোর দাবি জানিয়েছেন।
মাজহার মান্না, কিশোরগঞ্জ