ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

মুনীর চৌধুরীর মরমিয়া মন

প্রকাশিত: ০০:৩৭, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২

মুনীর চৌধুরীর মরমিয়া মন

মুনীর চৌধুরীর জীবনের গতিপথ এবং কর্মের বৈচিত্র্যতা যে হবে বহু পথে বহু মতে তা তার শৈশব বাস্তবতায় স্পস্ট প্রতীয়মান। বাবা আবদুল হালিম চৌধুরীর বাড়ি নোয়াখালী। মা আফিয়া বেগমের বাড়ি কুমিল্লা। চৌদ্দ ভাই বোনের সংসারে উপর থেকে নিচের অভিমুখী দ্বিতীয় সন্তান হয়ে মুনীর চৌধুরী জন্মগ্রহণ করলেন মানিকগঞ্জে। স্থানান্তরের কারণ বাবার সরকারী চাকরি বদলির নির্দেশনা এলেই জায়গার অদল বদল। এই অদল বদলের তাড়নার তাড়া আজীবনের সঙ্গী মুনীর চৌধুরীর জীবনে। জন্মালেন মানিকগঞ্জের অবুঝ শিশু হয়ে, আদো আদো হাতে বইয়ের পাতা ওল্টালেন বগুড়ায় বসে, পঠিত লেখার অর্থ অনুধাবন করা শুরু করলেন পিরোজপুরে বসে। সারা বাংলাদেশ ঘুরে স্থিতি যখন ঢাকায় তখন স্কুর শেষ করে ম্যাট্রিক পাস করলেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে। বিজ্ঞানে বিজ্ঞ হবার জন্য পিতার তাড়নায় আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলেন কিন্তু নিরস বিজ্ঞানের সিলেবাসের পাশ কাটিয়ে সমৃদ্ধ লাইব্রেরির জ্ঞান সমুদ্রে স্বেচ্ছায় ডুব দিলেন। ঢাকায় ফিরে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তির নিপীড়নে এবং নিষ্পেষণে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব উপলদ্ধি করলেন এবং প্রতিবাদ প্রতিরোধের মাধ্যম হিসেবে প্রগতিশীল শক্তিকে সমুন্নত রাখতে শক্তিশালী এবং শাণিত গল্পকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হিসেবে ভর্তি হলেন ইংরেজী সাহিত্যে কিন্তু লোক শিক্ষায় নাটকের ব্যবহারের জন্য নাটক রচনা-অভিনয়-নির্দেশনা দেয়া শুরু করলেন বাংলা মাধ্যমে। ১৯৪৬ এর রাজনৈতিক চক্রান্তে মানুষ যখন মানুষকে আক্রান্ত করছে ধর্মের নামে তখন মুনীর চৌধুরী মানুষ নাটক রচনা এবং মঞ্চায়নের মধ্যে দিয়ে রোঝাচ্ছেন, সব কিছুর উর্ধে মানুষের বড় পরিচয় যে সে মানুষ। ছাত্রজীবন অবসানে অধ্যাপনাকে ব্রত করে অধ্যাপক হয়ে তিনি যখন খুলনার দৌলতপুর কলেজে অধ্যাপনা করছেন তখন ঢাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পরীক্ষার খাতা এবং প্রশ্নপত্র নিতে এসে প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণার কারণে বন্ধী হচ্ছেন বদ্ধ কারাগারে। বাবার অমতে যখন নৃত্য ও অভিনয়ে পারদর্শী লিলি মীর্জাকে জীবনসঙ্গী করলেন তখন অর্থ উপার্জনের জন্য রেডিওতে স্বনামে এবং ছদ্মনামে রেডিও নাটক লিখলেন। দৌলতপুর কলেজ ছেড়ে এসে যোগ দিলেন জগন্নাথ কলেজে কিন্তু স্থায়ী পেশাকে উপেক্ষা করে নাটকীয়ভাবে অস্থায়ীভাবে লেকচারার পদে যোগদান করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে। তাড়িয়ে নেয়ার তাড়নার হাত থেকে মুনীর চৌধুরী হয় মুক্তি চায় না নচেৎ মুক্তি পায় না। জীবনের যৌবনের প্রারম্ভে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিভৃত লাইব্রেরিতে একে একে পড়ে শেষ করেছেন ওয়াগনার, তলস্তয়, শেক্সপিয়ার, বার্নাড’শ, দস্তয়ভস্কি, আর্থার মিলার, ডিকেন্স, হুগোসহ বিশ্বের প্রায় সকল লেখকের কালজয়ী রচনা। এবার সরসরি চাক্ষুস মঞ্চায়ন দেখার অপার সুযোগ। ভাষাতত্ত্বে মাস্টার্স অফ আর্টস পড়তে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে গেলেন আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অথচ প্রতিটি রজনী নিমগ্ন হলেন নাটকের প্রাণকেন্দ্র বোস্টনের থিয়েটার হলে। একদিকে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী লাভ অপর দিকে মানব মনের গুঢ়-গাঢ় দিকের রহস্য অনুধাবন। অনুধাবনে স্বদেশে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালীর ভাষার উপর পশ্চিম পাকিস্তানের আগ্রাসনে আক্রান্তর প্রতিনিধি হয়ে মুনীর চৌধুরী যখন আমেরিকার প্রভাবশালী পত্র পত্রিকায় ইংরেজী রচনায় তুলে ধরছেন ‘ফ্রেনিমস অভ ব্যাঙ্গলি ল্যাাঙ্গুয়েজ’ অথবা ‘দি ল্যাঙ্গুয়েজ প্রবলেম ইন ইস্ট পাকিস্তান’ ঠিক সে সময় সরকার এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি নিয়ে নিয়েছে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান। আবার ধারাবাহিক তাড়নায় তাড়িত মুনীর চৌধুরী। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষকী উদ্যাপন এবং বাস্তবায়নের সম্মুখ সমরে মুনীর চৌধুরী হিমালয়ের মতো অটল এবং অবিচল। অটল অবিচল আজীবন মুনীর চৌধুরী যুদ্ধবিরোধী অবস্থানে তথাপি দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধ দেখে ফেললেন ততদিনে স্বচক্ষে। যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নিয়ে নাটক রক্তাক্ত প্রান্তর লিখে পুরস্কৃত হলেনÑ বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কারে কিন্তু ভুলে গেলেন না কবর নাটকের কল্পিত চরিত্রের আসল বাস্তবতাকে। ত্যাগের মহিমাকে মহিমান্বিত করে, অগ্রণী ভূমিকায় অধিষ্ঠিত হয়ে সকলকে নিয়ে নির্মাণ সম্পন্ন করলেন শহীদ মিনার। নাটক আর কাকে বলে। বাঘ সিংহের সঙ্গে দুই জঙ্গলে একই মানুষের বসবাস। ভাষাতত্ত্বে এম এ করলেন আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর সোভিয়েত ইউনিয়নে আমন্ত্রিত হয়ে ভাষাতত্ত্বের উপর সেমিনারে বক্তব্য রাখলেন আন্তর্জাতিক আবহে। দেশীয় আবহে পূর্ব পাকিস্তানের টেলিভিশনের জন্য প্রথম নাটক লেখার দাবিদার যেমন মুনীর চৌধুরী ’একতলা দোতলা’ রচনার কারণে ঠিক তেমনি পূর্ব পাকিস্তানের বিষয় অবলম্বনে মীরমানস গ্রন্থ, নাটক চিঠি, শিশু নাটক কুপোকাৎ রচনাগুলো পেয়ে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের নামাঙ্কিত দাউদ পুরস্কার এবং সিতারা-ই-ইমতিয়াজ উপাধি। সরকারী সিদ্ধান্তে বেতার টেলিভিশনে যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ করা হল তখন পূর্ব পাকিস্তানের যে আঠারজন বুদ্ধিজীবী বিপক্ষে বিবৃতি প্রদান করলেন তার অগ্রেই শুধু মুনীর চৌধুরী না বরং বিবৃতিটির রচয়িতাও মুনীর চৌধুরী। বৈপরিত্য কাকে বলে, সরকারী চাপে বাংলা বানান সংস্কারের মুনীর চৌধুরী যেমন আপস করলেন না তেমনি টাইপ রাইটারের কীবোর্ড আধুনিকায়নে মুনীর চৌধুরী কার্পণ্য করলেন না। ফলে বার্লিনের প্রাচীর জার্মানিকে পূর্ব পশ্চিম দুই ভাগে বিভক্ত করলেও দুই বিভক্ত জার্মান পরিব্রাজক এক মুনীর চৌধুরীকে স্বাগত এবং স্বীকৃতি জানাতে জার্মান ভুল করল না। জার্মান কোম্পানি বাজারে নিযে এলো আধুনিক বাংলা টাইপ রাইডার ‘মুনির অপটিমা’। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের বাধা এবং বেতার টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ হলে প্রতিবাদে প্রতিরোধে বিপ্লবী যে মুনীর চেধুরী সে দেখেছে, অন্যায় বর্বরভাবে ব্রিটিশ সরকার জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা- সংঘটিত করলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুহূর্তমাত্র বিলম্ব করেনি ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত নাইটহুড উপাধি, ব্রিটিশ সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে নাইটহুড উপাধি বর্জন করতে। তেমনি ক্রান্তিকালে রবীন্দ্র অনুরাগী মুনীর চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথেরই অনুসারি। আজীবন তাড়নায় তাড়িত মুনীর চৌধুরী। সারা বাংলা যখন বাধ্য হলো পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের বিপরীতে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে তখন আবার তাড়নায় তাড়িত মুনীর চৌধুরী। মুহূর্তমাত্র কালক্ষেপণ। তার পরই অবিচল সিন্ধান্ত। বাঙালীর অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে পাকিস্তান সরকারের দেয়া উপাধি সিতারা-ই-ইমতিয়াজ বর্জন। বর্জন গ্রহণ কিংবা অর্জনের তালিকায় তাড়নায় তাড়িত মুনীর চৌধুরী একটা ব্যাপারেই শুধু প্রভাবিত হলেন না। সেটা হলো সুযোগে কিংবা দুর্যোগে স্বদেশ ত্যাগ। হার্ভার্ডে পড়াকালীন সময়ে আমেরিকায় সিটিজেনশিপ জোগাড় করে আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার সুযোগ গ্রহণ করলেন না। তিন তিনবার কারাবন্দী মুনীর চৌধুরী সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিভ্রমণের সময় রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলেই তা পেতে পারতেন কিন্তু তা করলেন না। ভাষাতত্ত্ব সম্মেলনে শেষবারের মতো আমেরিকা লন্ডন পরিভ্রমণে যখন বক্তৃতায় বলছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের জয় অসম্ভাবি তখন ব্যক্তি নিরাপত্তার স্বার্থে আমেরিকা কিংবা লন্ডনে ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে থেকে যেতেই পারতেন কিন্তু তিনি তা করলেন না। কোন অবস্থায় মাতৃভূমিকে উপেক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব হলো না। আরও অনেকের মতে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে হাত মিলিয়ে সুরক্ষা বলয় তৈরি এবং সুবিধাভোগীর দলে যোগ দিয়ে স্বদেশবাসীর সঙ্গে বেইমানিও করলেন না। যুদ্ধের বছরের সেপ্টেম্বরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের সতর্কবাণী পেয়েও স্বদেশ ছাড়লেন না। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব যখন হাজার বার অনুরোধ করছেন নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে, সুরক্ষিত জায়গায় অবস্থান নিতে তখনও মুনীর চৌধুরী স্বদেশ, কর্মস্থান ঢাকা ছাড়লেন না। ঢাকা ছাড়লেন কি ছাড়লেন না তার চেয়ে বড় কথা তার জীবনটাই শিল্পর মতো বড়। শিল্পীর নশ্বর দেহ এক না এক সময় সময়ের গহিনে বিলীন হয় কিন্তু শিল্পীর কাল উত্তীর্ণ। শিল্প টিকে থাকে মহাকালের যাত্রায় শিল্প অনুরাগীর মনে। মুনীর চৌধুরীর পরিণতির নিশ্চয়তার সিদ্ধান্তহীনতা তার সৃজিত শিল্পর মতোই বহমান। তিনি কোথাও একটি জায়গায় নেই অর্থ তিনি আছেন মানিকগঞ্জ, বগুড়া, পিরোজপুর, ঢাকা কিংবা সমগ্র বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও অথবা সমগ্র বাংলাদেশের যে কোন স্থানে। ক্রুশবিদ্ধ যীশু পুনরুজ্জীবিত হন ভক্ত হৃদয়ে আবার ভক্ত হৃদয় যীশুকে খুঁজে পান বাইবেলের আশ্রয়ে। তদ্রƒপ ব্যক্তি মুনীর চৌধুরীর নিরুদ্দেশ, শহীদ হওয়া পুনরুজ্জীবিত করে অনুরাগী হৃদয়ে স্মরণে, স্মৃতিতে। আবার আগ্রহী অনুরাগী মুনীর চৌধুরীর সৃজন নির্মাণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পায় বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত প্রয়াত ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সম্পাদিত মুনীর চৌধুরী রচনাবলী চারটি খ- পড়তে পড়তে। যে মুনীর চৌধুরী নাট্যকার হয়ে দুটি মৌলিক পূর্ণাঙ্গ নাটক, বাইশটি মৌলিক একাঙ্ক নাটক, অনুবাদ-রূপান্তরে চারটি পূর্ণাঙ্গ, অনুবাদ-রূপান্তরে পাঁচটি একাঙ্ক নাটক, অনুবাদ-রূপান্তরে অসমাপ্ত সাতটি নাটক রচনা করেছেন তিনি দায়িত্ব নিয়ে যে কথা পঞ্চাশের দশকে ‘নাট্য সাহিত্য’প্রবন্ধে লিখে গেছেন তা যে আজ এই ২০২২ সালেও এত প্রাসঙ্গিক হবে তাকি তিনিও কল্পনা করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের নাটকের জয়যাত্রাকে মাথায় রেখে এবং সাঈদ আহমদ, মমতাজ উদ্দীন আহমদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন, সেলিম আল দীন, সৈয়দ শামসুল হক, মামুনুর রশীদ, মান্নান হীরা প্রভৃতি মহৎ নাট্যকারদের অবদানকে শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করেও মুনীর চৌধুরীর সেদিনের লেখা লাইনগুলো কি এখনও সাময়িকভাবে পাঠক-নাট্যকারদের থমকে দেয় না! যে লাইনগুলোতে তিনি লিখেছেন, ‘যেদিকে তাকাই কেবলই নাটক, কিন্তু যে-নাটক আমাকে নাড়াতে পারে, পোড়াতে পারে, বাড়াতে পারে-সে-নাটক কোথায়! সে নাটক কি! এখনও আসেনি! তার কি আসার সময় হযনি? কবে আসবে! কোন পথে আসবে?’ তেতাল্লিশ সাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে তিনি নাটক লেখা শুরু করেছেন, জনসমক্ষে পাঠ করছেন, বেতারে একাঙ্কিকা নাটক উপস্থাপন করছেন, মঞ্চে রচনা-নির্দেশনার মধ্যদিয়ে নতুন নতুন নাটক নামাচ্ছেন, ইংরেজী এবং বাংলা ক্লাসে অধ্যাপক হয়ে নাটক বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াচ্ছেন, টোকিওতে সমকালীন নাটক বিষয়ে বক্তব্য রাখছেন, ইউনেস্কোর প্রকাশনা কনটেমপোরারি গ্রন্থে থিয়েটার ইন ইস্ট পাকিস্তান নামে প্রবন্ধ লিখছেন, বিদেশী নাট্যকারদের লেখা নাটক অনুবাদ এবং রূপান্তর করে স্বদেশবাসীকে জানাচ্ছেন, সর্বোপরি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নাটক রচনার সাধনা থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। মুনীর চৌধুরীর নাটক রচনা এবং তাঁর নাটকীয় জীবন যে ট্রেন লাইনের মতো পরস্পর সমান্তরাল এই সত্য বুঝে নিতে তাঁর রচিত নাটকে চোখ না বুলিয়ে থাকবার কোন উপায় নেই। অসম্ভব বাগ্মী পুরুষ, আলোকিত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নদ্রষ্টা অধ্যাপক আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ। তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধ ‘বক্তা মুনীর চৌধুরী’ ছাপা হয়েছিল শ্রদ্বেয় রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যবাহী থিয়েটার পত্রিকার একদম প্রথম সংখ্যায়। আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ লিখেছেন, ‘মুনীর চৌধুরীর মার্জিত, পরিশীলিত বাচনভঙ্গি, তাঁর সচেতন কুশলী ও অনিন্দ শব্দ প্রয়োগ, আপোসহীন অভিজাত রুচি, শানিত বৈদগ্ধ, সূক্ষ পরিচ্ছন্ন কৌতুকপ্রিয়তা, অসাধারণ পরিমিতিবোধ ও প্রাণবান সাবলীলতা তাঁর বক্তৃতাকে আমাদের কালের শ্রোতাদের কাছে উপভোগ্য ও অনন্য করে তুলেছিল। সাধারণ শ্রোতারা তাঁর বক্তৃতায় চমৎকৃত, অভিভূত ও প্রশংসামুখর হয়েছে এবং তাঁর বক্তৃতায় অসাধারণত্বের স্পর্শ অনুভব করেছে। তাঁর বক্তৃতার আশ্চর্য ভারসাম্যময়তা তাঁর পক্ষের বিপক্ষের সবার কাছেই স্বস্তিস্বরূপ মনে হয়েছে।’ মনে মনে কম বেশি সকলের জানা মুনীর চৌধুরী অভিনেতা-নাট্যকার-নির্দেশক-সংগঠক-সমালোচক-গবেষক-উপস্থাপক-লেখক-অধ্যাপক। কিন্তু যে জিনিসটি তুলনামূলক কম জানা তা হলো তিনি একজন শক্তিশালী চলচ্চিত্র অনুরাগী। চলচ্চিত্রের প্রতি মুনীর চৌধুরীর গভীর অনুরাগের বিষয়টি লেখা রয়েছে বড় ভাই, প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর ‘মুনীর চৌধুরী; স্মৃতির পাতা থেকে’ শিরোনামের লেখায়। কবীর চৌধুরী লিখেছেন, ‘স্কুল জীবনের শেষ দুই বছরের দিকে ভীষণ ছবি দেখত। ঢাকার ইংরেজী ছায়াছবির একমাত্র ছবিঘর ব্রিটানিয়ায় মুনীর ছিল একটি নিয়মিত একান্ত পরিচিত মুখ।’ পরিচিত মুখ মুনীর চৌধুরী নিরুদ্দেশ হলেন ১৯৭১ সালে ১৪ ডিসেম্বরে। আজও তিনি নিরুদ্দেশ। তবুও জীবন্ত অনুভূতি নিয়ে মুনীর চৌধুরীর নাটকের যে মঞ্চমায়ায়, বিচিত্র এবং বৈচিত্র্যময় মুনীর চৌধুরীর যে কর্মের ফল্গুধারায়, কর্ম সম্পন্ন করার জন্য মুনীর চৌধুরী মরমিয়া মনের যে বোঝাপড়ায়, তাতে করে ব্যাকুল অনুরাগীর কাছ থেকে কোন অবস্থায় তার মুক্তি নেয়। জীবনের থেকে শিল্প বড় বলে মুনীর চৌধুরীর মরমিয়া মন আজীবনের মতো বাঁধা পড়ল শিল্পেরই অন্তর্লোকে। লেখক : নাট্যকর্মী
×