ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৬ মে ২০২৫, ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

বিজয়ের গৌরবগাথা ॥ মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী সাংবাদিক

প্রকাশিত: ২১:২৯, ১২ ডিসেম্বর ২০২১

বিজয়ের গৌরবগাথা ॥ মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী সাংবাদিক

মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী নয় মাসে পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞের চিত্র বহির্বিশ্বে তুলে ধরার জন্য কিছু বিদেশী সাংবাদিকের আত্মত্যাগের কথা অবশ্যই স্বীকার্য। এদের মধ্যে ছিলেন মার্ক টালি, সিডনি শনবার্গ, এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস, সাইমন ড্রিং, নিকোলাস টোমালিন, ক্লেয়ার হলিংওয়ার্থ, মার্টিন ওলাকট, জন পিলজার, ডেভিড লোশাক, পিটার হ্যাজেনহার্স্ট ও আরও অনেকে। যুদ্ধ চলাকালীন আমাদের নিজস্ব কোন গণমাধ্যম ছিল না বললেই চলে। বাংলাদেশ বেতার শুধু দেশের ভূখণ্ডের ভেতরই মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছাতে সক্ষম ছিল। যুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল নিজেদের ভূখণ্ডে সামরিক বাহিনী কর্তৃক অত্যাচার, নিপীড়নের খবর সঠিকভাবে বহির্বিশ্বে পৌঁছে দেয়া। এ কাজে অসামান্য অবদান রেখে বাংলাদেশের বিজয়কে বেগবান করেছিলেন বিদেশী গণমাধ্যমকর্মীরা। তাই, মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপরই বিদেশী গণমাধ্যম কর্মীরা সংবাদ সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছিলেন। ২৫ মার্চ তারা অবস্থান করছিল শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। এদের মধ্যে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, কানাডা, ফ্রান্স, জাপান ও রাশিয়ার প্রায় ৩৭ সাংবাদিক। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর অন্যতম পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খুব কাছের দেশ পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া কেমন হয় তার ওপরই বেশি চোখ ছিল সাংবাদিকদের। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী সকল বিদেশী সাংবাদিককে জোরপূর্বক হোটেলে আটকে রাখে। কেউ ভাবতেও পারেনি-কী ঘটতে যাচ্ছিল সেই রাতে? ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ তাদের ২৯ তারিখের প্রতিবেদনে লিখেছিল, ‘পাকিস্তানী সেনাবাহিনী হুমকি দিয়েছে, হোটেল থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করা হলে সাংবাদিকদের গুলি করা হবে।’ একই প্রতিবেদনে আটকেপড়া সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে হোটেলে অবস্থানরত এক সৈনিকের জবাব এভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়, ‘উই ওয়ান্ট ইউ টু লিভ, বিকজ, ইট উইল বি ঠু ডেঞ্জারাস ফর ইউ। ইট উইল বি ঠু ব্লাডি।’ সৈনিকের এমন জবাবে সাংবাদিকরা নিজেদের নিয়ে যতটা না ভয় পেয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি ভয় পান নিরস্ত্র বাঙালী জাতির সঙ্গে আজ রাতে কী বিভীষিকা ঘটতে যাচ্ছিল তার কথা চিন্তা করে। তারা হোটেল থেকেই দেখতে পেয়েছিলেন, নিরস্ত্র বেসামরিক লোকজনের ওপর সামরিক বাহিনীর বর্বর আক্রমণ। ট্যাঙ্ক, বন্দুক আর মেশিনগানের গুলির শব্দে আঁতকে উঠেছিলেন সবাই। গণহত্যার ব্যাপারে সাংবাদিকরা যেন কোন তথ্য বহির্বিশ্বে সরবরাহ করতে না পারে তা নিশ্চিত করা ছিল পাকিস্তানের অন্যতম কাজ। এর প্রথম কারণ হলো, তারা নিজেরা সম্পূর্ণ অবগত ছিল কিভাবে নিরীহ বাঙালীদের ওপর বীভৎস অত্যাচার চালাচ্ছে। আর দ্বিতীয় কারণ হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা। পাকিস্তান ভয় পেয়েছিল যদি বহির্বিশ্বে এটা প্রকাশ পায় যে পাকিস্তানে সরবরাহকৃত মার্কিন অস্ত্র বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারে। ফলস্বরূপ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী যত দ্রুত সম্ভব সাংবাদিকদের দেশ থেকে বহিষ্কার করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় সাংবাদিকদের ২৮ মার্চের মধ্যেই ঢাকা ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়। বহিষ্কৃত সাংবাদিকদের মধ্যে একজন ছিলেন নিউইয়র্ক টাইমসের সিডনি শ্যানবার্গ। তিনি ছিলেন দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রতিনিধি। অন্যান্য সাংবাদিকের সঙ্গে তিনিও ২৫ মার্চের ভয়াবহতা নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তার রচিত ‘বিয়ন্ড দ্য কিলিং ফিল্ডস’ নামক বইতে তিনি নিজের চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা দিয়েছেন। ২৫ মার্চের ঘটনা বর্ণনায় তিনি লেখেন, ‘শুরুর দিকে গোলাগুলির আওয়াজ অনেকটা বিক্ষিপ্ত ছিল, তবে রাত ১ টার দিকে অনবরত গুলির আওয়াজ শুনতে পাই হোটেল কক্ষ থেকে। প্রায় টানা তিন ঘণ্টা গুলির আওয়াজ শুনেছিলাম।’ ২৮ মার্চ যখন তাদেরকে সামরিক নিরাপত্তায় এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন তিনি সকালের বিধ্বস্ত ঢাকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। অলিগলির ভেতরকার বাসাবাড়িতে দরজা-জানালা ভাঙ্গা, ছাদে আগুন জ্বলছিল, রাস্তায় মানুষের লাশ পড়েছিল। সেসব লাশের ওপর দিয়েই তাদের গাড়ি এগিয়ে চলছিল এয়ারপোর্টের দিকে। এয়ারপোর্টে তাদের ওপর কঠোর তল্লাশি চালানো হয়। তাদের নোটবুক, রেকর্ডার সবকিছু বাজেয়াফত করা হয়। করাচীতে ফিরে যাওয়ার পর নিউইয়র্ক টাইমসে ২৮ মার্চ এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। অপারেশন সার্চলাইটের সময় সাংবাদিকদের হোটেলে আটকে রাখার প্রতিবেদন ২৮ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়; বিদেশী সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও তিনি পরবর্তীতে আবারও গণহত্যার প্রতিবেদন প্রকাশ করতে জুন মাসে যুদ্ধচলাকালীন বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন তিনি শহর ও গ্রাম থেকে বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সূত্র ধরে সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন। এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ৩০ জুন পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে আবার দেশ থেকে বহিষ্কার করেছিল। সিডনি শ্যানবার্গ বাংলাদেশী শরণার্থীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন; নিউইয়র্ক টাইমসের ২৮ তারিখের সংবাদের শিরোনামে ৩৫ সাংবাদিকের দেশ ত্যাগের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থানরত বিদেশী সাংবাদিকদের সঠিক সংখ্যা ছিল ৩৭। সেখানে আরও দু’জন সাংবাদিকের কথা আলাদা করে উঠে আসে, তখন যাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রতিবেদনে বলা হয়, যখন সাংবাদিকদের একসঙ্গে আটকে রাখা হয় তখন এ্যাসোসিয়েটেড প্রেস ও রয়টার্সের দু’জন সাংবাদিক হোটেলে ছিলেন না। অফিসে তাদের সন্ধান করা হলে অফিস জানায়, এখন পর্যন্ত ঢাকা থেকে তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। এই দু’জন ব্যক্তির একজন ছিলেন ২৬ বছর বয়সী বিলেতি সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সায়মন ড্রিং সর্বপ্রথম ঢাকা এসেছিলেন ১৯৬৮ সালে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের খবর সংগ্রহের কাজে তিনি ঢাকা ত্যাগ করে ভিয়েতনাম চলে যান। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পরিস্থিতি যখন অবনতির দিকে, বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে যখন স্বাধীনতার ডাক দিলেন তখন সমগ্র বিশ্বের মানুষ একটি আসন্ন যুদ্ধের আভাস পেয়েছিলেন। যে কারণে বিদেশী সাংবাদিকরা বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছিলেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ৬ মার্চ সায়মন ড্রিং পুনরায় বাংলাদেশে এসেছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে বন্দুকের মুখে যখন বিদেশী সাংবাদিকদের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আটক করা হচ্ছিল, সাইমন তখন এ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের আলোকচিত্রী মাইকেল লরেন্টকে সঙ্গী করে হোটেলের ছাদে আশ্রয় নিয়ে তাৎক্ষণিক বহিষ্কারের হাত থেকে রেহাই পান। ২৭ তারিখ কারফিউ উঠে গেলে তিনি হোটেলের কর্মচারীদের সহায়তায় দুদিন অগ্নিদগ্ধ ঢাকার ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেন। পরে ঢাকা ত্যাগ করার সময় অত্যন্ত সৌভাগ্যবশত এয়ারপোর্টে নিজের নোটবুকটি বাজেয়াফত হবার হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। করাচী হয়ে ব্যাঙ্ককে এসে সেনাবাহিনীর হত্যাকা-ের বিবরণ পাঠাতে শুরু করেন। ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রকাশিত ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামের সংবাদে তিনি ঢাকার বীভৎস অবস্থা বর্ণনা করেন। এই সংবাদটিতেই মূলত তৎকালীন ঘোষণাকৃত স্বাধীন বাংলাদেশের বীভৎস চিত্র সঠিকরূপে বিশ্বের মানুষের কাছে উঠে আসে। ২৭ মার্চ বাংলাদেশ ত্যাগের পর তিনি আবার নবেম্বরে ভারতে আসেন। তখন তিনি মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ করতেন কলকাতা থেকে। সেসব খবর টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশ করার জন্য পাঠিয়ে দিতেন লন্ডনে। ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর ট্যাংকে চড়ে তাদের সঙ্গে ঢাকায় প্রবেশ করেন সায়মন ড্রিং এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গেই বিজয় উল্লাসে অংশগ্রহণ করেন। ১৩ জুন, ১৯৭১। লন্ডনের ‘সানডে টাইমস’ এ প্রকাশিত এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের সাড়া জাগানো প্রতিবেদন ‘জেনোসাইড’। তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্র মর্নিং নিউজের সহকারী সম্পাদক। বাকি সাংবাদিকদের নৈতিক বিবেক না থাকলেও এই সাংবাদিক নিজের বিবেকের কাছে আটকে যান। নিজে যা দেখেছেন তার বিপরীতে লিখার নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তিনি তা করতে পারেননি। বরং ১০ দিনের ঢাকা ভ্রমণ শেষে তিনি ১৯৭১ সালের ১৮ মে সরাসরি লন্ডনে চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি সানডে টাইমসের দফতরে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যা দেখেছিলেন সে সম্পর্কে সত্যিকারের গল্প লিখতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। সানডে টাইমস তার লিখিত প্রতিবেদন প্রকাশে সম্মত হয়। তার দুশ্চিন্তা ছিল পরিবারকে নিয়ে। তার পরিবার তখন অবস্থান করছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করলে পরিবারকে এর খেসারত দিতে হতে পারে এই চিন্তা করে তিনি তার সন্তান ও স্ত্রীকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে লন্ডনে নিয়ে আসেন এবং ১৯৭১ সালের ১৩ জুন লন্ডনের সানডে টাইমসে ‘জেনোসাইড’ শিরোনামের সেই বিখ্যাত প্রতিবেদনটি প্রথম পাতায় বাই-লাইন স্টোরি হিসেবে ছাপা হয়। এটিই ছিল পশ্চিমা সংবাদপত্রে প্রকাশিত গণহত্যার প্রথম বিবরণমূলক সংবাদ। ধারণা করা হয়, এই প্রতিবেদনটি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বৈধতা অর্জনে ব্যাপক সাহায্য করেছিল। এই প্রতিবেদনের কারণে ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জনে সাহায্য করার ব্যাপারে আরও বেশি উৎসাহ প্রকাশ করেছিল। বিবিসির তৎকালীন সম্পাদক হারল্ড ইভানের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘এই প্রতিবেদনটি এত গভীরভাবে আমাকে বিস্মিত করেছিল যে আমি একপর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র হস্তক্ষেপের জন্য ইউরোপ এবং রাশিয়ার ইতিবাচক মনোভাব পেতে তাদের সাথে ব্যক্তিগত কূটনৈতিক প্রচারাভিযানে লিপ্ত হই।’ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যার সত্য খবর বহির্বিশ্বে জানিয়ে দিতে মাসকারেনহাস সপরিবারে নিজের দেশ ত্যাগ করেন। সায়মন ড্রিং, সিডনি শ্যানবার্গ আর ম্যাসাকারেনহাসের মতো সাহসী সাংবাদিকদের পেশাদারিত্ব, মানবিকতা আর বিবেকের তাড়না বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে যতটা গতি দিয়েছে এবং বিদেশী গণমাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বৈধতার প্রতি বহির্বিশ্বের মানুষের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া অর্জনে যেভাবে সাফল্যম-িত হয়েছে; তাদের এই ঋণ কখনই শোধ করার মতো নয়। তারাও মুক্তিযোদ্ধা। বিদেশী সাংবাদিকরা এভাবেই বেগবান করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। লেখক : গবেষক [email protected]
×