ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পেশাভিত্তিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা জরুরী

প্রকাশিত: ১৯:১৪, ২১ জুন ২০২০

পেশাভিত্তিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা জরুরী

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এক আতঙ্কের নাম। এ আতঙ্কে গরিব মানুষ খুবই অনিশ্চিত সময় অতিবাহিত করছে। যদিও মহামারীতে সকলের মানবিক আচরণ করা উচিত। একে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসা দরকার। করোনা এমন এক ছোঁয়াচে রোগ যে আপনি নিজে সচেতন হলেই হবে না, আপনার আশপাশের মানুষদেরও করোনা প্রতিরোধে সমান সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। কিন্তু সরকারের এত নির্দেশনা সত্ত্বেও বাজারে বা রাস্তায় বের হলেই মনে হচ্ছে বাংলাদেশে কোন করোনা নেই। মাঝে কিছুটা মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস পেলেও বর্তমানে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আরও তীব্র আকার ধারণ করছে। কিন্তু বাস্তবে দেশে লক্ষণীয়ভাবে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। করোনায় প্রথম সারির যুদ্ধে কাজ করছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স, চিকিৎসক, সাংবাদিক, পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এদেরকে জানাই শ্রদ্ধা। চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ নিয়মিতভাবে বেড়ে চলেছে। চিকিৎসকদের মৃত্যুর খবর রীতিমতো উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। করোনায় এমন হয়েছে যে মানুষ চিকিৎসার অভাবে মারা গিয়েছে, কারণ সংক্রমণের ভয়ে অনেক হাসপাতাল চিকিৎসা দিতে চায়নি। যা গণমাধ্যমে জানতে পারি। অনেক মানুষ হসাপাতাল ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করছেন। যা খুবই দুঃখজনক। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সেবার মান নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে নানাবিধ প্রশ্ন রয়েছে। কারণ করোনা পরিস্থিতিতে অনেক মানুষের স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও আশঙ্কা রয়েছে। কোভিড-১৯ চিকিৎসায় বেসরকারী হাসপাতাল যেভাবে ফি নিচ্ছে যা আমাদের মতো পেশাজীবীদের পক্ষেই সম্ভব নয়। কারণ আমাদের আয় সীমিত। এ জন্য দরকার পেশাভিত্তিক হাসপাতাল। গত কিছুদিনে অনেক চিকিৎসক করোনায় মারা গেছেন। এছাড়াও শিক্ষক, সাংবাদিক এবং ব্যাংক কর্মকর্তারা অনেকেই করোনায় সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন। পেশাজীবী সংগঠনের নেতাদের মতে পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে অতি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার। সংবাদপত্রে জানতে পারি চার হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে কুমিল্লার এক ডায়াবেটিস রোগী মৃত্যুবরণ করছেন। আরও বেদনাদায়ক হচ্ছে, তার মৃত্যুর খবরে স্ট্রোক করে একই রাতে মারা গেছেন তার পিতা। কিছুদিন পূর্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সম্মানিত শিক্ষককে করোনার উপসর্গ নিয়ে একটি হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ভর্তি করা হয়। এবং এ সময় আইসিইউর অভাবে অবশেষে শ্বাসকষ্ট নিয়েই তিনি মারা যান। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু সত্যি কষ্টকর ও বেদনাদায়ক। আমাদের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিক্যাল সেন্টার আছে। কিন্তু তা বেশি কার্যকর নয়। যা নামে আছে, কাজেকর্মে বলতে গেলে নাই বললেই চলে। ১৬/০৬/২০২০ তারিখে ২৪ ঘণ্টায় করোনায় সংক্রমিত হয় ৩ হাজার ৮৬২ জন। এক্ষেত্রে করোনা শনাক্তের হার প্রায় ২২.৪৪ শতাংশ। বর্তমানে জনসংখ্যা হলো ১৬.৫২ কোটি, সুতরাং ২২.৪৪ শতাংশ হারে করোনায় আক্রান্তের আশঙ্কায় রয়েছে ৩.৭১ কোটি মানুষ। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এত শক্তিশালী নয় যে এত রোগী সামাল দেয়া সরকারী হাসপাতালের জন্য সহজ হবে। এই মুহূর্তে যদি আমাদের প্রত্যেক পেশার লোকদের নিজস্ব আলাদা হাসপাতাল থাকত, তাহলেই কিন্তু সরকারের ওপর চাপ কমত এবং সাধারণ নাগরিকরা সরকারী হাসপাতাল থেকে বেশি চিকিৎসা সুবিধা পেত। সবাই যদি সরকারের ওপর নির্ভরশীল থাকি, সরকারের পক্ষে সর্বদা ভাল সেবা দেয়া কিছুটা কঠিন। এ জন্য সময়ের দাবি প্রত্যেক পেশার জন্য পেশাভিত্তিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হোক। বাংলাদেশ পেশাজীবী সংগঠনের নেতাদের এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। যা স্ব স্ব পেশার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে। এই হাসপাতালগুলো সুবিধাজনক স্থানে ঢাকায় বা অন্য জায়গায় স্থাপন করা যেতে পারে। যেখানে দেশের যে কোন জেলা থেকে সহজেই যাতায়াত করা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে অনেক পেশার লোকদের চিকিৎসার জন্য নিজস্ব হাসপাতাল রয়েছে, যেমন সামরিক হাসপাতাল, পুলিশ হাসপাতাল, সরকারী কর্মচারী হাসপাতাল। আমি তাদেরকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। এছাড়াও তারা অন্যান্য হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তাদের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য সুব্যবস্থা করছেন। সুতারং প্রত্যেক পেশার লোকদের চিকিৎসার জন্য যে কোন ভাল হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি থাকা উচিত বলে মনে করি। যেখানে কেউ করোনা আক্রান্ত হলে যেন চিকিৎসা নিতে পারেন। আমাদের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু প্রয়োজন উদ্যোগ এবং সঠিক কর্মপরিকল্পনা। সকল পেশার সদস্যদের জন্য সামরিক হাসপাতালের ন্যায় পৃথক হাসপাতাল স্থাপন এখন সময়ের দাবি। তা বাস্তবায়নে জরুরী কমিটি এবং সমন্বিত নীতি করা উচিত। যা বাস্তবায়িত হলে সরকারের ওপর পেশাজীবীদের চিকিৎসার চাপ কমে যাবে। বিভিন্ন হাসপাতালগুলোতে আমাদের চিকিৎসার উদ্দেশ্য একটি সিটের জন্য কি বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। তা আমরা সবাই কমবেশি জানি। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আমাদের যে সকল শিক্ষক বা কর্মকর্তা রয়েছে তারা এ বিষয়ে আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করে আমাদের সকল পেশার মানুষের মনের আশা পূরণ করবে এটাই আমি বিশ্বাস করি। পেশাভিত্তিক হাসপাতাল স্থাপনের জন্য প্রথমে সরকারের নিকট জায়গার চাহিদা দিতে হবে। জায়গা পাওয়ার পর সরকার বা স্ব স্ব পেশার নিজস্ব আর্থিক ব্যবস্থাপনায় এটা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। যেমন আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করে তাদের সবাইকে কল্যাণ তহবিলে নির্দিষ্ট হারে টাকা জমা রাখতে হয়। আমাদের সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের কল্যাণ ফান্ড থেকে প্রতি মাসে টাকা কেটে বড় তহবিল গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট করে প্রতি সেমিস্টারে ছয় মাস অন্তর চিকিৎসা ফি বাবদ টাকা দিবে। যা দিয়ে সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল স্থাপনের জন্য বড় ফান্ড তৈরি করা যেতে পারে। প্রতিষ্ঠা শেষে আমরা চিকিৎসা গ্রহণের সময় টাকা দিয়ে চিকিৎসা নেব। কিন্তু ফি এর পরিমাণ কম হবে। আমাদের উদ্দেশ্য হবে চিকিৎসার জন্য যাতে হয়রানি না হতে হয়। ঐ হাসপাতালে আমরা যাতে সব প্রকারের স্বাস্থ্য সেবা নিতে পারি। প্রয়োজনে সাধারণ মানুষ চিকিৎসা নিতে পারবে। কিন্তু অগ্রাধিকার পাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যরা। এভাবে প্রত্যেক পেশার জন্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা স্থাপন করা যেতে পারে। এই হাসপাতালের বার্ষিক খরচ মেটানোর পর যদি কোন লাভ থাকে তা আবার ঐ হসাপাতালের উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। এর কোন টাকা কারও ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে বণ্টন করা হবে না। এখানে সামাজিক মূলধন হিসেবে বিনিয়োগ হবে। এখানে একটি পরিচালনা পর্ষদ থাকবে যাদের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে এবং প্রতি বছর পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন হবে এবং প্রতি আর্থিক বছরে আর্থিক বিষয়দি অডিট হতে হবে। এবং পরিচালনা পর্ষদের দিকনির্দেশনায় ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা হাসপাতালের কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিবে এবং সঠিকভাবে পরিচালনা করবে। আমাদের মূল লক্ষ্য হবে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা যাতে আমাদের কোন সদস্য বিনা চিকিৎসায় আর যেন মারা না যায়। সম্প্রতি কয়েকটি হাসপাতালের নাম গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, কিভাবে তারা রোগীর নিকট থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। যা খবুই দুঃখজনক। তাই আমাদের চিকিৎসার লক্ষ্যে পেশাভিত্তিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া আর কোন পথ দেখছি না। আজকে যদি প্রত্যেক পেশায় নিজস্ব হাসপাতাল থাকত তাহলেই আমাদের করোনাকালীন সময়ে মনে সাহস পেতাম যে করোনায় আক্রান্ত হলে চিকিৎসা পেতাম। তাহলেই যে কোন মহামারীতে সমস্যা হবে না এবং সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা কমে যাবে। তাতে সরকারী হাসপাতাল থেকে সাধারণ নাগরিকরদের বেশি চিকিৎসা সেবা গ্রহণের ক্ষেত্র তৈরি হবে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিল প্রত্যেক পেশার চাকরিজীবীরা অনেক উপকৃত হবে এবং সেই সঙ্গে নতুন যে কোন সংক্রমণের ঝুঁকিতে আমরা নিজেরাসহ অন্যদের চিকিৎসা সেবা দেয়া যাবে বলে বিশ্বাস করি। বর্তমানে গণপরিবহন চালু হওয়ায় করোনার ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। তাই দেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হচ্ছে। তারপরও করোনার সংক্রমণ থেকে মুক্তি পেতে সবাইকে আত্মসচেতন হতে হবে। তাই যতদিন না পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে প্রত্যেক পেশার কর্তৃপক্ষকে শীঘ্রই চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি থাকা উচিত বলে মনে করি। ভবিষ্যতে পেশাভিত্তিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা ও তা বাস্তবায়নে সমন্বিত নীতির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। লেখক : শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×