ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

পাটশিল্প পল্লী

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ২২ ডিসেম্বর ২০১৭

পাটশিল্প পল্লী

সুদিন ফিরে এসেছে সোনালি আঁশের। সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক চাহিদা। বিস্মৃতির করাল গ্রাস থেকে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে নতুন আভরণে, আবরণে। রফতানির খাতেও হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে তার এগিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা ক্রমশ বিস্তারিত হচ্ছে। তবে তার শনৈঃ শনৈঃ এগিয়ে যাওয়ার পথটি অবশ্যই হবে মসৃণ। এখন সে আর চটের বস্তাই শুধু নয়, শাড়ি থেকে স্যান্ডেল পর্যন্ত নানা ব্যবহার্য সামগ্রীর প্রধান উপকরণ এখন এই স্বর্ণ সূত্র। এর সুরক্ষা প্রয়োজন আজ। দরকার দূরদর্শিতাপূর্ণ পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের কার্যকর সফল উদ্যোগ। নতুবা সবই যাবে ভেস্তে। একদা পূর্ববঙ্গের প্রধান রফতানি আয় ছিল এই সোনালি আঁশ। সেই আঁশ যেন আর কোনদিন গলার ফাঁস না হয়ে দাঁড়ায় পাটচাষীদের কাছে তার পদক্ষেপও জরুরী। পূর্ববঙ্গের প্রধান রফতানি পণ্য ছিল পাট। এর রফতানি আয়ের প্রায় পুরোটা দিয়েই পাকিস্তান নামক শোষক দেশটির রাজধানীসহ অন্যান্য অঞ্চল সমৃদ্ধ হতে থাকে। এর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল বাংলার মানুষ সেই ষাটের দশকেই। স্বাধীনতার পর বিশ্ববাজারে পাটের চাহিদা হ্রাস পেতে থাকে পলিথিনের ব্যাপক প্রচলন ঘটায়। পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পলিথিন ব্যবহার অবশেষে দেশে দেশে নিষিদ্ধ হয়ে গেলে পরিবেশবান্ধব সেই স্থান পূরণে এগিয়ে এসেছে চটের ব্যাগ। বস্তার এখন ব্যাপক চাহিদা গড়ে উঠছে এদেশে, বিদেশে। বাংলাদেশে এখন পাটের ব্যাপক চাষাবাদ হচ্ছে। নানা ধরনের পণ্য উৎপাদন হচ্ছে এই পাট থেকে। বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাট উৎপাদনকারী দেশ। ভারত শীর্ষে রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে পঁচাত্তর লাখ বেল পাট উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ষাট শতাংশের ক্রেতা সরকারী-বেসরকারী পাটকল। এসব পাট দিয়ে মূলত সুতা, পাটের বস্তা, ব্যাগসহ বিভিন্ন নিত্যব্যবহার্য পণ্য উৎপাদন করা হয়। এছাড়া বছরে গড়ে দশ থেকে বারো লাখ বেল পাট রফতানি হয়। পাট ও পাটজাত পণ্য হলো দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত। গত অর্থবছরে (২০১৬-২০১৭) প্রায় একশ’ কোটি ডলারের পাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানি হয়েছে। আর এই খাতে বর্তমানে দুই লাখ শ্রমিক কর্মরত। এই সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। পাটের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর নানামুখী ব্যবহার নিয়ে চলছে গবেষণা। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জেনোম আবিষ্কার করেছেন। এর ফলে পাট চাষের পরিধি বাড়ছে। তাই দেশে পাটশিল্প পল্লী গড়ে তোলা হচ্ছে। দেশের একুশটি জেলায় এই পল্লী স্থাপন করা হবে। মূলত পাটের ব্যাগ, জুতা, স্যান্ডেল, তৈজসপত্রসহ বৈচিত্র্যময় পাটজাত পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে এই পরিকল্পনা কার্যকর করা হচ্ছে। এসব পণ্য রফতানিও করা যাবে। দেশের যেসব জেলায় বছরে দুই লাখ বেলের বেশি পাট উৎপাদন হয় এবং যেসব জেলায় অন্তত দশজনের বেশি পাটজাত পণ্যের উদ্যোক্তা রয়েছে সেসব জেলাতেই এই পল্লী হবে। এ জন্য চালু ও বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলের খালি জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৯৯৩ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ পাট কর্পোরেশনের আওতায় যেসব পাটকল ছিল সেখানে এক শ’ একরের মতো জমি রয়েছে। যেখানে কমপক্ষে পঁচিশটি ছোট শিল্প প্লট করা হবে। এছাড়া বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের আওতায় পঁচিশটি পাটকল পরিচালিত হয়, যেখানে এই পল্লী হবে। দেশের বন্ধ হয়ে যাওয়া চুয়ান্নটি পাটকলের স্থানেও এই পল্লী স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। পাটশিল্পের দ্রুত বিকাশ এবং সম্প্রসারণের লক্ষ্যে পাটশিল্প পল্লী গড়ার জন্য পাট উৎপাদনভিত্তিক এলাকাও সম্ভাব্যতা যাচাই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এই কাজ করা হচ্ছে। বছরে দুই লাখ বেলের বেশি পাট উৎপাদন হয় এমন জেলা রয়েছে ষোলোটি। সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় ফরিদপুরে। সবচেয়ে বেশি ২৬৬ জন পাট পণ্যের উদ্যোক্তা রয়েছেন ঢাকায়। এর বাইরে আরও সাতটি জেলা রয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা এক্ষেত্রে প্রাধান্য পাচ্ছেন। যারা পাটের ব্যাগ, শাড়ি, স্যান্ডেল, চাদরসহ বৈচিত্র্যময় পাটপণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত হবেন। এমন উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসা পাওয়াার যোগ্য। দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই পণ্যটির সুদিন আসায় এর নানামুখী ব্যবহার নিয়ে গবেষণাও চলছে। কারণ, সনাতনী পাটপণ্যের রফতানি বাজার অত্যন্ত সীমিত। তাই এর বিভিন্নমুখী ব্যবহারের জন্য সে ধরনের পণ্য উৎপাদন হলে বাজার চাঙ্গা হবে। পাটশিল্প পল্লী সুদিন ফিরিয়ে আনবে এটাই কামনা।
×