ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ সালাতুত্ তারাবি

প্রকাশিত: ০৩:৩২, ২ জুন ২০১৭

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ সালাতুত্ তারাবি

রামাদান মাস প্রাচুর্যের মাস। এ এক মহান মাস। সিয়ামের এই মাসে ‘ই’ শার সালাত আদায় করার পরে এবং বিতরের সালাত আদায় করার পূর্বে দুই রাকা’আত করে দশ সালামে যে বিশ রাকা’আত সুন্নাত মুআক্কাদা সালাত আদায় করতে হয় তাকে বলা হয় সালাতুত্ তারাবি বা তারাবির নামাজ। তারাবি শব্দের অর্থ বিরাম বা বিশ্রাম। এই সালাতে প্রতি দুই রাকা’আত অন্তর কিছুক্ষণ বিরাম নেয়া হয়, যে কারণে একে সালাতুত্ তারাবি বলা হয়। এই সালাত আদায় করলে সায়িমের (রোজাদার) মননে এক অপূর্ব প্রফুল্লতা ও প্রশান্তি নেমে আসে। অন্তরের গভীরে এমন এক জ্যোতির বিচ্ছুরণ ঘটে যার আভা প্রস্ফুটিত হয় তার চেহারায়। দিবসের প্রায় সাড়ে তেরো ঘণ্টা কঠিন কৃচ্ছ্র সাধনের পর ইফতারের মধ্য দিয়ে সায়িমের মধ্যে যে আনন্দ আবা বিম্বিত হয় তা সুদৃঢ় হয়ে ওঠে কুড়ি রাক’আত তারাবি সালাত আদায়ের মধ্য দিয়ে। এ ছাড়াও এই সালাত পড়লে গোনাহরাশি ক্ষমা করা হয়। হাদিস শরীফে তারাবি সালাতের মাহাত্ম্য সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু থেকে বর্ণিত একখানি হাদিস আছে, কালা সামিতু রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইয়াহুকুলু লি রমাদানা মান কামাহু ইমানানান ওয়া ইহতিসাবান গুফিরালাহু মা তাকাদ্দামা মিন যাম্বিহ্Ñ তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি রমাদানে ইমানের সঙ্গে সওয়াব লাভের আশায় তারাবির সালাত আদায় করবে তার পূর্ববর্তী গোনাহ্সমূহ মাফ করে দেয়া হবে। (বুখারী শরীফ)। উল্লেখ্য, রমাদানের রাত্রিতে জাগরণ বা দ-ায়মান হওয়া দ্বারা তারাবির সালাতকেই বোঝানো হয়েছে। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি মুতাবিক দ্বিতীয় হিজরীর শাবান মাসের শেষ তারিখের দিবাগত রাত তথা পহেলা রমাদান রাতে (বা’দ ইশা) সর্বপ্রথম তারাবি সালাত মসজিদুন্ নববীতে প্রিয়নবী রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে আদায় করেন। হাদিস শরীফে আছে যে, আন আয়িশাতা রাদিআল্লাহু আনহা যাওযিন নাবী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আন্না রসূলুল্লাহ (সা) সল্লা ওয়া যালিকা ফি রমাদানÑ প্রিয়নবী রসূল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সহধর্মিণী আয়িশা রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহা থেকে বর্ণিত আছে যে, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম সালাদ (তারাবি সালাত) আদায় করেন এবং তা ছিল রমাদানে। মূলত আগে মসজিদুন নববীতে একাধিক জামাাতে একই সময় তারাবির সালাত সাহাবায়ে কেরাম আদায় করতেন, কেউ কেউ একাকীও পড়তেন। তারাবির সালাতে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত সশব্দ হওয়াতে অনেকের কুরআন পাঠের আওয়াজ উত্থিত হতো, মসজিদে নববীতে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু এক ইমামের নেতৃত্বে এই সালাতের জামাতের ব্যবস্থা চালু করেন। আমরা জানি হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবের দশ বছরের খিলাফত (৬৩৪-৬৪৪ খ্রি.) আমলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা গৃহীত হয় তার মধ্যে এই তারাবির সালাতের জামাত ব্যবস্থাও একটি। সম্ভবত এই জামাত ব্যবস্থা চালু হয় ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে। উল্লেখ্য, তিনি হিজরী সনের প্রবর্তন করেন ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে। একখানি দীর্ঘ হাদিসে আছে যে, হযরত রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি রমাদানে ইমানের সঙ্গে সওয়াব লাভের আশায় তারাবির সালাতে দাঁড়াবে তাঁর পূর্ববর্তী গোনাহ্সমূহ মাফ করে দেয়া হবে। শিহাবের পুত্র বলেন যে, হযরত রসূলুল্লাহ্ সাল্লাহ ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করলেন, তার পরও এটা একইভাবে চলে আসছিল। এমনকি হযরত আবু বকর রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হুর (প্রায় আড়াই বছরের) খিলাফতকালে এবং হযরত উমর রাদিআল্লাহু তালাআন্হুর খিলাফতের প্রথম ভাগে এ রকমটাই ছিল। ইবনে শিহাব উরওয়া ইবনে যুবায়র সূত্রে আবদুর রহমান ইবনে আব্দ আল কারী থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি রমাদানের এক রাতে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হুর সঙ্গে মসজিদে নববীতে গিয়ে দেখতে পেলাম যে, লোকেরা বিক্ষিপ্ত জামাতে বিভক্ত। কেউ একাকী সালাত আদায় করছে আবার একজন সালাদ আদায় করছে আর তাকে ইকতিদা করে একদল লোক সালাত আদায় করছে। হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু (এসব দেখে) বললেন : আমি মনে করি যে, এই লোকদের একজন কারীর (ইমামের) পেছনে একত্রিত করে দিলে সেটাই উত্তম হবে। এরপর তিনি উবাই ইবনে কাবের পেছনে সবাইকে কাতারবন্দী করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। পরে আর এক রাতে আমি তাঁর সঙ্গে বের হলাম। তখন লোকেরা তাদের ইমামের সঙ্গে সালাত আদায় করছিল। হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু এটা দেখে বললেন : অপূর্ব সুন্দর এই নতুন ব্যবস্থা। (বুখারী শরীফ) হযরত উসমান (রা) হযরত আলী (রা) হযরত তালহা (রা) হযরত যুবায়র (রা) হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা)সহ সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বিশ রাকা’আত তারাবির সালাত আদায় করার ব্যাপারে সবাই ঐকমত্য পোষণ করে তা আমল করতে থাকেন। উল্লেখ্য, এই সালাতে তিনি ইমাম ছিলেন সেই হযরত উবাই ইব্নে কাব রাদি আল্লাহু তা’আলা আন্হু প্রখ্যাত মুফতি। কুরআন মজীদ ব্যাখ্যার ব্যাপারে তিনি সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। তিনি মদিনার সনদ লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর পা-িত্যের তারিফ প্রিয়নবী (সা) করেছেন, তারই ইমামতিতে কুড়ি রাকা’আত তারাবির সালাত আদায় হয়েছিল। সেই যে বিশ রাকা’আত তারাবির সালাত জামা’আতের সঙ্গে শুরু হলো রমাদান মাসে মসজিদুন নববীতে তা আজও আদায় হয়ে আসছে, মক্কার মসজিদুল হারামেও এই বিশ রাকা’আত সালাতুত তারাবি পড়া হয়। পৃথিবীর সব দেশেই বিশ রাকা’আতই পড়া হয়। তবে উপমহাদেশে সংখ্যায় কম একটি দল ৮ রাকা’আত তারাবির সালাত আদায় করে। তারা প্রধানত লা ময্হাবি নামে পরিচিত। তারা নিজেদের আহলে হাদিস বলে পরিচয় দেয়। অন্যদিকে মালিকী মযহাবের অনুসারীগণ ৩৬ রাকা’আত পড়ে বলে জানা যায়। শীআ ফিক্হ-এ রমাদান মাসে অতিরিক্ত এক হাজার রাকা’আত সালাতের উল্লেখ আছে। তারাবির সালাতে প্রত্যেক দুই রাকা’আত শেষে একটা দরুদ শরীফ পাঠ করার রীতি রয়েছে আর তা হচ্ছে আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা সাইয়্যিদিনা মওলানা মুহম্মদ। তারাবির সালাতের চার রাক’আত পরে বিরামকালে যে দোয়াখানি পাঠ করা হয় তা হচ্ছে সুবহানা যিল মুলকি ওয়াল মালাকুতি সুবহানা যিল ইয্যাতি ওয়াল আযমাতি ওয়াল হায়বাতি ওয়াল কুদরাতি ওয়াল কিবরিয়াযী ওয়াল যাবারুত সুবহানাল মালিকিল হায়য়িল্লাযী লা ইয়ানামু ওয়ালা ইয়ামাতু আবাদান সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রব্বুনা ওয়া রব্বুল মালায়িকাতি ওয়াররূহÑ পবিত্রতা ঘোষণা করছি সেই মহান সত্তার যিনি রাজ্য ও রাজত্বের অধিপতি (রাজাধিরাজ) পবিত্রতা ঘোষণা করছি সেই মহান সত্তার যিনি তাবত ইজ্জত মহত্ত্ব, প্রতাপ, প্রতিপত্তি, শক্তিমত্তা, সৌকর্য ও মাহাত্ম্যের অধিপতি, পবিত্রতা ঘোষণা করছি সেই মহান সত্তার যিনি মালিক চিরঞ্জীব যার কোন নিদ্রা নেই, যার কোন মৃত্যু নেই, তিনি বর্তমান চিরদিন, চিরকাল, তিনি মহিমাময় পবিত্র, তিনিই আমাদের রব এবং ফেরেশতাদেরও আত্মার রব। এই দোয়া পাঠ শেষে মোনাজাত করতে হয়। তারাবির সালাতের মোনাজাত হিসেবে বহুল প্রচলিত মোনাজাতটি হচ্ছে : আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকাল জান্নাতা ওয়া নাউযুবিকা মিনান্নার, রহমাতিকা ইয়া আযীযু ইয়া গাফ্ফারু“ইয়া কারীমু ইয়া সাত্তারু, ইয়া রাহীমু, ইয়া জাব্বারু, ইয়া খালিকু। ইয়া বাররু। আল্লাহুম্মা আজিরনা মিনান্নাবি ইয়া মুজীরু ইয়া মুজীরু ইয়া মুজীরু বিরহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমীনÑ হে আল্লাহ্্! হে জান্নাত ও দোজখের স্রষ্টা, আমরা আপনারই নিকট চাচ্ছি জান্নাত এবং আশ্রয় চাচ্ছি দোজখের আগুন থেকে। আপনার রহমত কামনা করছি। হে প্রবল ও প্রিয়, হে মহা ক্ষমাশীল, হে মহামান্য দয়াবান, হে দোষ গোপনকারী, হে পরম দয়ালু, হে মহাপরাক্রমশালী, হে মহান স্রষ্টা, হে মহাহিতকারী, আপনি আপনার রহমত দ্বারা আমাদের দোজখের আগুন থেকে রক্ষা করুন, হে রক্ষাকারী, হে রক্ষাকারী, হে রক্ষাকারী। হে পরম করুণাময় দয়ালুদাতা। জানা যায়, বিশ রাকা’আত তারাবির সালাতের সুবিধার্থে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান ইব্নে আফ্্ফান রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হু ৩০ পারা কুরআন মজীদকে ৫৪০ রুকুতে বিভক্ত করেনÑ যাতে প্রত্যেক দিন বিশ রাকা’আত তারাবির সালাতে ২০ রুকু পাঠ করে ২৭ রমাদানের অর্থাৎ লায়লাতুল কদরে এক খতম কুরআন সমাপ্ত হয়। রমাদানুল মুবারকের এই খাস সালাতে কুরআন মজীদের তিলাওয়াত শোনা মুস্তাহাব। এই সালাম একাকী গৃহে আদায় করা যায়, তবে জামাতে আদায় করা উত্তম। হাদিস শরীফে আছে যে, প্রত্যেক রমাদানে হযরত রসুলাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম হযরত জিবরাঈল ‘আলায়হিস্্ সালামকে সেই রমাদান পর্যন্ত নাযিল হওয়া কুরআন মজীদ শোনাতেন এবং নিজে শুনতেন। সালাতুত্্ তারাবির জামাতকে ঐক্য ও সংহতি স্থাপনের প্রশিক্ষণ বললে অত্যুক্তি হবে না। মাহে রমাদানেই এই সালাত আদায় করতে হয়, যে কারণে এর গুরুত্ব ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অপরিসীম। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা) সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×