ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

পাথরের কান্না

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ৫ আগস্ট ২০১৬

পাথরের কান্না

প্রতিটি মানুষের মনের ভেতরই একটি শিল্পীসত্তা লুকিয়ে থাকে। তাই আপাত দৃষ্টিতে কোন মানুষকে নিষ্ঠুর বলে মনে হলেও দেখা যাবে সে ফুল ভালবাসে। শিল্পের প্রতি, সুন্দরের প্রতি এ এক সহজাত টান। সুন্দরের প্রতি মানুষের ভাল লাগার বোধটুকু জন্মানোর অনেক আগেই হয়ত গায়ে মেখে নিয়েছে মানুষ। আর এই সুন্দরকে কেউ কেউ অমর করে রাখেন। শিল্পীরা কেউ গানে, কেউ কবিতায়, কেউ বা তার শিল্পকর্মে তুলে আনেন সুন্দরের সুভাষটুকু। এগুলোর অনেক কিছুই আমাদের কাছে নান্দনিক হয়ে ধরা দেয়। মাইকেল এঞ্জেলোর ‘পিয়েতা’ ভাস্কর্যটি তেমনই ঈঙ্গিত দেয়। মাত্র ২৫ বছর বয়সে অনন্য সৃষ্টি পিয়েতা সম্পন্ন করেন। এটি রোমের সেন্ট পিটর ব্যাজিলিকায় রক্ষিত আছে। এটি তৈরির সময় এঞ্জেলো স্বগর্বে লিখেছিলেন ‘রোমে যেসব ভাস্কর্য আছে তার মধ্যে এটি হবে সবচেয়ে সুন্দর, এ রকম ভাস্কর্য আজকের দিনে কোন জীবিত ওস্তাদ গড়তে পারবে না।’ এমন অহঙ্কার মাইকেল এঞ্জেলোর মতো মহান শিল্পীকেই মানায়। পিয়েতা পাথর খুদে আবেগ ফোটানোর এক কালজয়ী নজির। ভাস্কর্যটি গড়ে তোলার সময় হয়ত শিল্পগুরুর ওপর স্বয়ং ঈশ্বর ভর করেছিলেন। মা মেরির মৌনতা যে কোন ধর্ম-বর্ণের দর্শকে বেদনায় সিক্ত করে। পিয়েতা অর্থাৎ দুঃখ। ভাস্কর্যটির মূল বিষয়বস্তু হলো, মা মেরির কোলে শায়িত যিশুর মৃতদেহ। পাথর খুদে তৈরি ভাস্কর্যটি প্রাণময় ও প্রাণহীন দুটো দেহের ভঙিমা বেশ নান্দনিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। প্রতিটি চরিত্র এতটাই জীবন্ত যা সত্যিই বিস্ময়ের উদ্রেক করে। যা তাদের বাস্তবের খুব কাছাকাছি এনে ফেলে। মাতা মেরি পা ঝুলিয়ে বসে আছেন, কোলে আড়াআড়ি ক্রুশবিদ্ধ ছেলে যিশুর মৃতদেহ। একজন ৩৩ বছর বয়সী ছেলের মা হিসেবে মেরির বয়স যথেষ্ট কম। অথচ ভঙ্গিমার মধ্য দিয়ে শোকস্তব্ধ মাতৃত্বের এক আশ্চর্য প্রতিচ্ছবি এই ভাস্কর্যটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মেরির ডানকোলে যিশুর মাথা। যিশুর ঘাড়ের তলায় মেরির ডানহাত। সেই হাত যিশুর পাজর পর্যন্ত প্রসারিত। যিশুর হাঁটু মেরির কোল পেরিয়ে বাঁ উরু দিয়ে মেরির বাঁ দিকে ঝোলানো। যিশুর দেহ এমনভাবে নেতিয়ে পড়েছে যে মনে হয় প্রাণহীন স্থবির শরীরের সব ভার মেরির কোলে। যিশুর ডানহাত মেরির ডানহাঁটুর সামনে দিয়ে ঝুলে পড়েছে। তাঁর বাঁ হাতে নিজের কোমর বরাবর এসে তাঁর কোমরের পাশ দিয়ে মেরির কোলে উঠে মেরির শরীরের বাঁ দিকে পড়ে আছে। মেরি তন্ময় হয়ে সমস্ত পৃথিবী থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে প্রিয় পুত্রের দিকে মুখ নত করে অর্ধমুদ্রিত চোখ রেখে ভাবছেন। কী ভাবছেন তিনি? যিশুর নিয়তি নির্ধারিত জীবন, তার মাতৃত্বের নাটকীয় স্মৃতি, যিশুর মৃত্যু এ রকম হবে বহু আগে তার ভবিষ্যদ্বাণী স্মরণ করে? এমন হৃদয় বিদারক, শোকাচ্ছন্ন, আত্মসমাহিত, সংযত ভাস্কর্য কেউ আগে সৃষ্টি করেননি। সন্তানের জন্য মায়ের শোকের এমন শৈল্পিক আবেগের প্রকাশ আর কোন ভাস্কর্যে ঘটেনি, হয়ত ভবিষেতও ঘটবে না। ভাস্কর্যটির গাম্ভীর্য, আবেগ, পুত্র হারানোর শোকের এক অসাধারণ শিল্পিতরূপ প্রকাশ পেয়েছে।
×