
ছবি: প্রতীকী
এক সময় ছিল, শিশুদের সময় কাটতো মাঠে দৌড়ঝাঁপ, লুকোচুরি, গল্পের বই, অথবা পরিবারের সঙ্গে খুনসুটিতে। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন শিশুদের হাতে খেলনার বদলে স্মার্টফোন। কান্না থামাতে মোবাইল, খাওয়াতে মোবাইল, ঘুম পাড়াতে মোবাইল। একটু সময় বের করতে চাইলেই বাবা-মা সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন ফোন বা ট্যাব। শিশুরাও যেন এ জগতে ডুবে যেতে শিখে গেছে।
প্রথমে বিষয়টি নিরীহ মনে হলেও, ধীরে ধীরে এর প্রভাব হয়ে দাঁড়াচ্ছে ভয়ংকর। শিশুদের অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম তাদের মানসিক, শারীরিক এবং সামাজিক বিকাশে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। শিশু যখন ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে মোবাইল খোঁজে, কিংবা খেলতে না চেয়ে ইউটিউব দেখে বসে থাকে, তখনই বোঝা যায় কিছু একটা ঠিকঠাক নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়স পাঁচ বছরের নিচে যেকোনো শিশুর জন্য মোবাইল বা ট্যাবলেট স্ক্রিন বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে। এই বয়সে মস্তিষ্কের বিকাশ দ্রুত হয়। কিন্তু মোবাইলের একঘেয়ে চিত্র, অতিরিক্ত আলো, দ্রুতগতির অ্যানিমেশন— এসব শিশুদের ভাবার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। শিশু তখন দেখে, কিন্তু শেখে না। শব্দ শুনে, কিন্তু বোঝে না। এর ফলে তার স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ব্যাহত হয়।
মোবাইল ব্যবহারে সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটি দেখা যায়, তা হলো মনোযোগ কমে যাওয়া। অনেক বাবা-মা বলেন, এখনকার শিশুরা কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারে না। ক্লাসে বসে থাকলেও মন অন্যত্র থাকে। পড়ায় মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। এর পেছনের অন্যতম কারণ হলো দীর্ঘ সময় স্ক্রিনে ব্যস্ত থাকা। মোবাইলের রঙিন, আকর্ষণীয়, দ্রুতগতির ভিডিও বা গেম তাদের মস্তিষ্কে তাৎক্ষণিক আনন্দ তৈরি করে। এই আনন্দ ধীরে ধীরে আসক্তি তৈরি করে। বাস্তব জীবনের ধীরগতি, ধৈর্য, একটানা মনোযোগ—এসব আর ভালো লাগে না।
শারীরিকভাবেও এর প্রভাব পড়ে স্পষ্টভাবে। বেশি মোবাইল ব্যবহারে শিশুর চোখের ক্ষতি হতে পারে। পর্দার আলোতে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকলে চোখ শুকিয়ে যায়, পাওয়ার বাড়ে, দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়। আজকাল অল্প বয়সেই চোখে চশমা লাগছে এমন শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। শুধু চোখই নয়, একটানা বসে বসে মোবাইল দেখার ফলে শরীরচর্চা বা খেলাধুলা প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে করে শিশুদের ওজন বাড়ছে, হাড়ের গঠন দুর্বল হচ্ছে, এমনকি হজমের সমস্যাও তৈরি হচ্ছে।
ঘুমের ক্ষেত্রেও মোবাইল একটি বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা শোবার আগে মোবাইল দেখে, তাদের ঘুমাতে দেরি হয় এবং ঘুমের মানও খারাপ হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও তীব্র। মোবাইল থেকে নিঃসরিত নীল আলো (blue light) মস্তিষ্কের ঘুমের জন্য প্রয়োজনীয় হরমোন মেলাটোনিনের নিঃসরণ বাধাগ্রস্ত করে। ফলে শিশুরা রাতে ঘুমাতে পারে না, সহজে জেগে ওঠে, আবার ঘুমের মধ্যে কান্নাকাটি করে।
সামাজিক বিকাশেও পড়ে বিরূপ প্রভাব। শিশুরা যখন সব সময় মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তখন তারা বাস্তব জীবনের সম্পর্ক গড়তে শেখে না। অন্যদের সঙ্গে কথা বলা, চোখে চোখ রাখা, নিজের অনুভূতি প্রকাশ করা— এসব স্বাভাবিক সামাজিক দক্ষতা তৈরি হয় না। শিশুরা হয়ে পড়ে অন্তর্মুখী, কখনও কখনও একাকীত্বে ভোগে। বড় হয়ে তারা সামাজিক পরিস্থিতিতে অস্বস্তি বোধ করে, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।
অন্যদিকে, মোবাইলে থাকা কনটেন্টও সবসময় বয়স উপযোগী বা নিরাপদ নয়। ইউটিউব বা অন্যান্য ভিডিও প্ল্যাটফর্মে এমন অনেক ভিডিও রয়েছে যা শিশুদের জন্য উপযুক্ত নয়। কখনও কখনও শিশুরা হিংস্র, ভীতিকর বা বিকৃত বিষয়বস্তু দেখে ফেলে, যা তাদের মানসিক অবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কিছু ভিডিও বা গেমে আবার অতিরিক্ত উত্তেজনা ও সহিংসতা থাকে, যা শিশুদের মধ্যে রাগ, উগ্রতা বা অশান্ত আচরণ তৈরি করতে পারে।
এই বিষয়টি কেবল শিশুর ওপরই নয়, পরিবারের সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে। বাবা-মা ও সন্তানের মধ্যে যোগাযোগ কমে যায়। আগে যেখানে শিশুরা অভিভাবকের সঙ্গে গল্প করত, খেলা করত, প্রশ্ন করত— এখন সেসব সময় চলে যাচ্ছে স্ক্রিনে। এতে পরিবারে আন্তরিকতা, আবেগ ও বোঝাপড়া দুর্বল হয়। অনেক সময় শিশুর আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন এলেও বাবা-মা তা বুঝতেই পারেন না, কারণ শিশু তখন ফোনেই ডুবে থাকে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, মোবাইল শিশুদের শেখার ইচ্ছাকেও নষ্ট করে দিতে পারে। তারা বাস্তব জগতের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বই পড়া, প্রকৃতিতে সময় কাটানো, কল্পনা করা—এসব আনন্দ একসময় তাদের কাছে বিরক্তিকর মনে হয়। একঘেয়ে, রঙিন, তাৎক্ষণিক আনন্দের মোবাইল দুনিয়া তাদের অভ্যস্ত করে তোলে মেকি বাস্তবতায়।
তবে সমস্যার সমাধানও আছে। শিশুদের মোবাইল থেকে পুরোপুরি আলাদা না রেখে, বরং সময় বেঁধে দিয়ে ব্যবহার করতে দেওয়া যেতে পারে। দিনে এক ঘণ্টার বেশি নয়—এই নীতিতে অভ্যস্ত করা দরকার। পাশাপাশি, শিশুর সামনে মোবাইল ব্যবহারে বাবা-মা নিজেদের আচরণেও নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।
বিকল্প হিসেবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা, খেলাধুলার পরিবেশ তৈরি করা, পরিবারের সঙ্গে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, গল্প করা, প্রকৃতিতে ঘোরার সুযোগ করে দেওয়া—এসব কাজে শিশুরা ধীরে ধীরে মোবাইলের আসক্তি থেকে দূরে যেতে পারে।
শেষ পর্যন্ত বিষয়টা দাঁড়ায় অভ্যাস ও সচেতনতার উপর। শিশুরা কীভাবে বেড়ে উঠবে, তার বড় অংশ নির্ভর করে অভিভাবকদের সিদ্ধান্ত ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর। তাই সময় থাকতে সচেতন হওয়া জরুরি। কারণ একবার শিশুর মন ও মস্তিষ্ক মোবাইলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে, তা কাটিয়ে ওঠা অনেক বেশি কঠিন হয়ে যায়।
আজকের শিশুরাই তো আগামী দিনের সমাজ গড়বে। তাদের সুস্থ, সৃজনশীল ও মানবিক করে গড়ে তুলতে হলে এখনই মোবাইল ব্যবহারে লাগাম টানতে হবে। শিশুকে শান্ত রাখার জন্য একটুখানি সুবিধার আশায় যদি আমরা তার ভবিষ্যৎকে বিপদের মুখে ঠেলে দিই, তাহলে সেই ভুলের দায় একদিন আমাদেরই নিতে হবে।
তাই মোবাইল হোক কাজের জন্য, বিনোদনের জন্য সীমিত সময়ের একটি মাধ্যম। কিন্তু শিশুর জীবন ও বেড়ে ওঠার জায়গা হোক বাস্তব পৃথিবীতে, যেখানে আছে মানুষের স্পর্শ, প্রকৃতির রঙ, বইয়ের গন্ধ আর পরিবারের ভালোবাসা। সেই জীবনই তাকে করবে পূর্ণ মানুষ।
এম.কে.