
ছবি: প্রতীকী
চাল বাঙালির প্রধান খাবারের একটি অনন্য অংশ। ভাত ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন খাবারের টেবিল যেন অসম্পূর্ণ। কিন্তু সেই চালই যদি আপনার অজান্তেই শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দেয়? শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি চাল ধোয়ার অভ্যাস না থাকলে শরীরে যেতে পারে নানা ধরনের ক্ষতিকর কেমিক্যাল, যার মধ্যে অন্যতম হলো কীটনাশক।
বাজার থেকে কেনা চালকে আমরা প্রায়ই খুব বেশি গুরুত্ব দিই না। অনেকেই বিশ্বাস করেন, চাল তো পরিষ্কার করেই আনা হয়, ধোয়ার দরকার নেই। আবার অনেকে মনে করেন, চাল ধুলে নাকি পুষ্টিগুণ কমে যায়। কিন্তু এসব ধারণা অনেকাংশেই ভুল। বিশেষজ্ঞদের মতে, চাল ধোয়ার অভ্যাস না থাকলে আপনি অজান্তেই শরীরে নিয়ে নিচ্ছেন রাসায়নিক সার, কীটনাশক, কিংবা সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত ক্ষতিকর প্রিজারভেটিভ।
চালের উৎপাদন, সংগ্রহ এবং বাজারজাতকরণের প্রতিটি ধাপে কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে যায়। প্রথমেই আসে চাষের সময় জমিতে ব্যবহার করা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। ধানগাছের পোকামাকড় রোধ করতে অনেক কৃষক অতিরিক্ত পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করেন। এসব রাসায়নিক ধান থেকে সরাসরি চাল পর্যন্ত থেকে যেতে পারে। চাল সংগ্রহের পর সংরক্ষণের সময় অনেক সময় ফাঙ্গাস বা পোকা প্রতিরোধ করতে চালের গায়ে দেওয়া হয় নানা ধরনের কেমিক্যাল।
এইসব রাসায়নিক শুধু চালে সীমাবদ্ধ থাকে না, রান্না করা ভাতেও থেকে যায়। আপনি যদি রান্নার আগে চাল না ধুয়ে সরাসরি কুকারে বা হাঁড়িতে ফেলে দেন, তাহলে সেই চালের সাথে থাকা কেমিক্যাল সরাসরি আপনার শরীরে প্রবেশ করে।
চিকিৎসকরা জানান, অনেক রোগী আজকাল হজমে সমস্যা, ত্বকের অ্যালার্জি, এমনকি দীর্ঘমেয়াদে কিডনি সমস্যা নিয়ে আসছেন। এর পেছনে খাদ্যে থাকা বিষাক্ত উপাদান অন্যতম কারণ। চাল ধোয়ার অভ্যাস যদি না থাকে, তাহলে সেটা বড় একটি ঝুঁকি হয়ে দাঁড়ায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, খাদ্যে থাকা কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ দীর্ঘ সময় ধরে খাওয়া হলে তা ধীরে ধীরে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি করে। বিশেষ করে যকৃত (লিভার), কিডনি এবং স্নায়ুতন্ত্র এই বিষক্রিয়ার শিকার হয় বেশি।
এছাড়া চালের মধ্যে ধুলো, ময়লা, কিংবা ছোট পাথরের টুকরোও থেকে যেতে পারে, যেগুলো চোখে সহজে ধরা পড়ে না। চাল ধোয়ার সময় এই ধুলো এবং অন্যান্য অবাঞ্চিত উপাদান অনেকটাই দূর করা যায়।
অনেকেই দাবি করেন, চাল ধুলে এর মধ্যে থাকা ভিটামিন বি১ (থায়ামিন) নষ্ট হয়ে যায়। যদিও এটি আংশিক সত্য, তবে সেই ক্ষতি ক্ষুদ্র এবং তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ—কারণ আপনি যদি ধোয়ার জন্য হালকা পানি ব্যবহার করেন এবং খুব বেশি ঘষামাঝা না করেন, তাহলে পুষ্টিগুণ প্রায় অক্ষত থাকে। কিন্তু যদি চাল না ধুয়ে রান্না করেন, তাহলে যে ধরনের ক্ষতিকর পদার্থ শরীরে প্রবেশ করে, তার চেয়ে পুষ্টিগুণ হারানো অনেক ছোট বিষয়।
চালের সঙ্গে থাকা রংও কখনও কখনও চিন্তার কারণ হয়। বিশেষ করে অনেকে চালকে চকচকে করার জন্য কৃত্রিম রঙ বা পালিশ ব্যবহার করে থাকেন, যা দেখতে আকর্ষণীয় হলেও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। চাল ধোয়ার সময় এই অতিরিক্ত রঙ বা পালিশ কিছুটা হলেও উঠে আসে।
গবেষণায় দেখা গেছে, চাল ধোয়ার সময় অন্তত ২–৩ বার পরিষ্কার পানি ব্যবহার করলে চালে থাকা ধুলো, কেমিক্যাল, ও ময়লা অনেকটাই দূর হয়ে যায়। বিশেষ করে প্রথম পানিটা খুব ময়লা থাকে, যেটা ফেলে দেওয়াই ভালো। কেউ কেউ আবার চাল ভিজিয়ে রেখে খানিকটা সময় পরে ধুয়ে নেন, এটিও কার্যকর পদ্ধতি। তবে খুব বেশি ঘষামাঝা না করে সাবধানে ধুলে চালের বাইরের আবরণ উঠে যায় না, তাই ভয়ের কিছু নেই।
বিশেষ করে শিশুদের জন্য রান্না করা চাল অবশ্যই ভালোভাবে ধুয়ে নেওয়া উচিত। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম, তাই তাদের শরীরে যদি কোনও কেমিক্যাল ঢুকে পড়ে, তাহলে তা দ্রুত প্রভাব ফেলে।
আরেকটি বিষয় হলো, প্যাকেটজাত চালেও ঝুঁকি থাকে। অনেকেই ভাবেন, প্যাকেটের চাল তো পরিষ্কার থাকে, ধোয়ার দরকার নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্যাকেটজাত চালও উৎপাদনের সময় একই কেমিক্যাল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। এমনকি কখনও কখনও অতিরিক্ত সময় সংরক্ষণ করার জন্য এসব প্যাকেটে ব্যবহৃত হয় কৃত্রিম সংরক্ষণ উপাদান, যা ধোয়ার মাধ্যমে কিছুটা হলেও দূর করা যায়।
চাল ধোয়ার অভ্যাস শুধু স্বাস্থ্যগত দিক থেকেই নয়, রান্নার স্বাদ ও গন্ধের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে। অনেক সময় না ধোয়া চাল দিয়ে ভাত রান্না করলে তার গন্ধে কৃত্রিমতার ছাপ পাওয়া যায়। আবার তাতে ফেনা হয় বেশি, ভাত ঝরঝরে হয় না।
বাজারে চাল কেনার সময়ও কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। খুব চকচকে চাল, বা এমন চাল যেটার গায়ে ধুলোবালি নেই বললেই চলে সেসব চাল আসলে অতিরিক্ত পালিশ করা হতে পারে। এসব চাল কিছুটা দেখতে আকর্ষণীয় হলেও তার স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি।
আমাদের প্রতিদিনের জীবনে ছোট ছোট অভ্যাসই আমাদের সুস্থ রাখে। যেমন হাত ধোয়ার মতোই চাল ধোয়াও একটি স্বাস্থ্যকর অভ্যাস। এই অভ্যাস গড়ে তুললে আপনি নিজেকে এবং আপনার পরিবারের মানুষদের নিরাপদ রাখতে পারেন অনেকাংশে।
বিশেষ করে যাদের বাড়িতে ছোট শিশু, বয়স্ক মানুষ বা রোগী আছেন, তাদের প্রতিদিনের রান্নার আগে চাল ধোয়ার বিষয়টি উপেক্ষা না করাই ভালো।
আপনি যাই রান্না করুন না কেন— তা যদি চালভিত্তিক হয়, তবে সেই চাল ভালোভাবে ধুয়ে নেওয়াই সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকর সুরক্ষা। এক গ্লাস পানিতে হয়তো আপনি শরীর ঠাণ্ডা করেন, আর তিন গ্লাস পানিতে ধুয়ে ফেলতে পারেন অজস্র বিপদ।
আজ থেকেই এই ছোট অভ্যাসটা গড়ে তুলুন। কারণ স্বাস্থ্য আসে ছোট সিদ্ধান্ত থেকেই, আর সেই সিদ্ধান্ত শুরু হতে পারে রান্নাঘরের এক চামচ চাল ধোয়ার মধ্য দিয়েই।
এম.কে.