ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০২ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২

শরীর আর মনের ক্লান্তি দূর করতে সকালের হাঁটা কতটা জরুরি?

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২ জুলাই ২০২৫

শরীর আর মনের ক্লান্তি দূর করতে সকালের হাঁটা কতটা জরুরি?

ছ‌বি: প্রতীকী

শহরের ব্যস্ততা, জীবনের দৌড়ঝাঁপ আর প্রতিদিনের নানা চাপ আমাদের শরীর ও মন দুটোকেই ক্লান্ত করে তোলে। কেউ অফিসের পর ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসেন, কেউবা ঘুম ভাঙার আগেই মাথাভর্তি চিন্তা নিয়ে জেগে ওঠেন। আমরা প্রায়ই বলি, “সময় নেই, খুব ব্যস্ত জীবন।” অথচ প্রতিদিনের এই চাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে দরকার মাত্র অল্প কিছু সময়, আর সেই সময়টা যদি হয় সকালের হাঁটা, তাহলে উপকার পাওয়া যায় দ্বিগুণ।

সকালের হাঁটা শুধু একটি শারীরিক ব্যায়াম নয়, এটি একধরনের আত্ম-পরিচর্যা, একান্ত সময়, নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথন। সারাদিনের শুরুটা যদি হয় একটি শান্ত, ধীর গতির হাঁটা দিয়ে, তাহলে তা শুধু শরীর নয়, মনকেও প্রস্তুত করে তোলে একটি গুছানো ও সুস্থ দিনের জন্য।

ভোরের আলো, ঠান্ডা বাতাস, পাখির ডাক এইসব প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ তৈরি হলে মনের ওপর পড়ে দারুণ ইতিবাচক প্রভাব। সকালবেলা হাঁটার সময় আমরা যখন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখি, বাতাস গায়ে মাখি, তখন আমাদের মস্তিষ্কে ‘সেরোটোনিন’ নামক হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়। এটি আমাদের মনকে শান্ত করে, উদ্বেগ কমায়, এবং সুখের অনুভূতি তৈরি করে।

সকালের হাঁটার সবচেয়ে বড় উপকার হলো এটি দিনের শুরুতেই শরীরকে জাগিয়ে তোলে। যারা সকালে হাঁটেন, তাদের রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হয়, মস্তিষ্কে অক্সিজেন পৌঁছায় বেশি, আর শরীরে তৈরি হয় প্রাকৃতিক শক্তি। এতে সারা দিন ক্লান্তি কম লাগে এবং কাজের প্রতি ফোকাস বাড়ে। বিশেষ করে যারা সাদা কলার জব করেন বা ডেস্কে বসে দীর্ঘ সময় কাজ করেন, তাদের জন্য সকালের হাঁটা একপ্রকার রেসকিউ।

অনেকেই বলেন, সকালে ঘুম থেকে ওঠা কঠিন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, রাতে আমরা যতই দেরিতে ঘুমাই না কেন, সকালে হাঁটার অভ্যাস তৈরি হলে ঘুমের গঠন নিজে থেকেই বদলে যায়। কারণ হাঁটার সময় আমাদের শরীরের ‘সার্কাডিয়ান রিদম’ বা ঘুম-জাগরণ চক্র স্থির হতে থাকে। এতে রাতে সহজে ঘুম আসে, ঘুম গভীর হয় এবং সকালে সতেজভাবে ঘুম ভাঙে।

মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকে চিন্তা করলে সকালের হাঁটা একধরনের ‘মুড থেরাপি’। অনেক সময় দেখা যায়, আমাদের মনে কোনো কারণে ভীষণ চাপ, মন খারাপ, অথবা অকারণে উদ্বেগ— এই সময়টা যদি ঘরে বসে কাটানো হয়, তবে চিন্তা আরও বাড়ে। কিন্তু আমরা যদি একটু হাঁটতে বের হই, চারপাশ দেখি, চলাফেরা করি, তাহলে মন ধীরে ধীরে হালকা হতে থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, হাঁটার সময় শরীরে ‘এন্ডোরফিন’ নামক একটি হরমোন তৈরি হয়, যাকে বলা হয় ‘হ্যাপি হরমোন’। এই হরমোন মন ভালো রাখে, হতাশা কমায় এবং ধৈর্য বাড়ায়। নিয়মিত সকালে হাঁটার অভ্যাস করলে দীর্ঘমেয়াদে বিষণ্নতা বা মানসিক অবসাদের ঝুঁকিও কমে যায়।

যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগ রয়েছে, তাদের জন্য তো সকালের হাঁটা অনেকটাই ওষুধের মতো। নিয়মিত হাঁটলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে, রক্তে শর্করার মাত্রা ঠিক থাকে, হার্ট সুস্থ থাকে। হাঁটা এমন একটি ব্যায়াম, যেটি প্রায় সবাই করতে পারেন। এতে শরীরে কোনো ঝাঁকুনি নেই, নেই অতিরিক্ত ক্লান্তির ভয়। শুধু প্রয়োজন ইচ্ছা আর ধারাবাহিকতা।

সকালের হাঁটায় আরেকটি বড় ইতিবাচক দিক হলো, এটি একা বা দলবদ্ধ দুইভাবেই করা যায়। কেউ চাইলে একা হাঁটতে পারেন নিজের মতো করে, আবার চাইলে পরিবার বা বন্ধুর সঙ্গে গল্প করতে করতেও হাঁটা যায়। এতে সম্পর্ক আরও মজবুত হয়, সামাজিক বন্ধন তৈরি হয় এবং একাকীত্ব দূর হয়।

ঢাকার উত্তরার বাসিন্দা নাহিদা আফরোজ প্রতিদিন সকাল ৬টায় হাঁটতে বের হন। তিনি বলেন, “আগে সকালে উঠেই মোবাইল স্ক্রল করতাম। এখন হাঁটতে বের হই। গাছপালা দেখি, পাখির ডাক শুনি। এক ঘন্টার মধ্যে মন এত হালকা লাগে, সারাদিন অফিসেও চাপ কম লাগে।”

শুধু বড়রা নয়, শিশুদের জন্যও সকালের হাঁটা অত্যন্ত উপকারী। বিশেষ করে মোবাইল-নির্ভর এই প্রজন্মের শিশুরা যদি ছোটবেলা থেকেই সকালবেলা কিছুটা হাঁটা বা খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত হয়, তাহলে তাদের শরীর সুস্থ থাকে এবং ঘুমের সমস্যা কমে।

অনেকেই হাঁটার সময় সঙ্গে রাখেন হেডফোন, পডকাস্ট বা প্রিয় গান। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, যদি সম্ভব হয়, হাঁটার সময় চারপাশের শব্দ শুনুন। এটা একধরনের ‘মাইন্ডফুলনেস’ চর্চা। শব্দ, আলো, গন্ধ, বাতাস— সবকিছুর প্রতি মনোযোগ দিলে মস্তিষ্ক বিশ্রাম পায়। এই অভ্যাস স্ট্রেস হরমোন কমায়, মনোযোগ বাড়ায়।

সকালের হাঁটা কেবল ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বা মানসিক শান্তির জন্য নয়, বরং এটি একটি রুটিন তৈরির মাধ্যমও। প্রতিদিন একই সময়ে ঘুম থেকে ওঠা, হাঁটতে যাওয়া, এবং তারপর দিনের অন্যান্য কাজ— এই ধারাবাহিকতা জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনে। আমরা অনেকেই বলি, “সময়ই পাই না!” কিন্তু দিন শুরু হোক হাঁটার মধ্য দিয়ে, দেখবেন সময়ও যেন আপনাকে নতুন করে স্বাগত জানাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যাঁরা অন্তত সপ্তাহে ৫ দিন, দিনে ৩০ মিনিট করে হাঁটেন, তাঁদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি ৩০-৫০% পর্যন্ত কমে যায়। মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও একইরকম প্রভাব দেখা যায়।

এই অভ্যাসে খরচ নেই, কোনো যন্ত্রপাতি দরকার নেই, নেই কোনো ফিটনেস ট্রেনারের প্রয়োজন। দরকার শুধু একটি সিদ্ধান্ত— আগামীকাল সকালে হাঁটতে যাব।

শরীর আর মনের ক্লান্তি দূর করতে সকালে হাঁটার মতো সহজ, কার্যকর এবং উপভোগ্য কোনো উপায় নেই। যান্ত্রিক জীবনে আমরা নিজের প্রতি যত্ন নেওয়া প্রায় ভুলেই গেছি। কিন্তু প্রতিদিন ভোরে, যখন শহর পুরোপুরি জেগে ওঠেনি, তখন একটু হাঁটা যেন এক কাপ শান্তির চা— মন হালকা করে, শরীর সতেজ করে এবং দিনটাকে করে সুন্দর।

আপনি যদি আজ থেকেই শুরু করেন, তবে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই পার্থক্য টের পাবেন। হাঁটা শুধু হাঁটা নয়, এটি একটি জীবনচর্চা।

এম.কে.

×