
ছবি: প্রতীকী
ভালোবাসা মানেই কী সারাক্ষণ একে অন্যের সঙ্গে কথা বলতে হবে? একটু দেরি করে ফোন ধরলে কি ভালোবাসা কমে যায়? আজকের ডিজিটাল যুগে এই প্রশ্নগুলো আরও তীব্র হয়ে উঠছে। আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম যত সহজ হয়েছে, ততটাই যেন বেড়েছে ভুল বোঝাবুঝি আর সম্পর্কের জটিলতা। বিশেষ করে প্রেম বা দাম্পত্য সম্পর্কে ছোট ছোট কিছু ভুল এক সময় বড় হয়ে ওঠে, যেখান থেকে শুরু হয় দূরত্ব, বিষণ্নতা আর সম্পর্কের টানাপড়েন।
আমাদের অনেকের মাঝেই এই প্রবণতা দেখা যায় সঙ্গী যদি সময়মতো ফোন না ধরে, কিংবা কিছুক্ষণ অনলাইনে থেকেও উত্তর না দেয়, তখন মন খারাপ হয়ে যায়। এমনকি কেউ কেউ আবার ধরে নেন, 'নিশ্চয় সে আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে' অথবা 'তার মন অন্য কারও প্রতি ঝুঁকে গেছে'। অথচ বাস্তবতা হতে পারে খুবই সাধারণ— কাজে ব্যস্ত থাকা, ফোন সাইলেন্টে থাকা বা একান্ত কিছু সময় নিজের জন্য রাখা। এই সাধারণ কারণগুলো না জেনেই অনেক সময় আমরা নিজের মনে একটা গল্প বানিয়ে ফেলি। এবং তখনই শুরু হয় সন্দেহ, রাগ এবং অভিযোগ।
একটি সুস্থ সম্পর্কের সবচেয়ে বড় ভিত্তি হলো আস্থা। এই আস্থা না থাকলে সম্পর্ক যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। অথচ আস্থার অভাবে অনেক সময় আমরা এমন কিছু কাজ করে ফেলি যা সম্পর্কের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। যেমন, বারবার মেসেজ পাঠানো, একাধিকবার ফোন করে সাড়া না পেয়ে রেগে যাওয়া, সামাজিক মাধ্যমে নজরদারি করা, কিংবা সঙ্গীর প্রতিটি আচরণে সন্দেহ করা। এই আচরণগুলো প্রথম দিকে হয়তো ছোট মনে হয়, কিন্তু দিনের পর দিন চলতে থাকলে সঙ্গীর মধ্যে তৈরি হয় বিরক্তি। যে সম্পর্ক একসময় আনন্দের জায়গা ছিল, সেটি তখন পরিণত হয় মানসিক চাপের স্থানে।
আরেকটি বড় ভুল হলো অতিরিক্ত প্রত্যাশা। আমরা অনেক সময় নিজের অজান্তেই সঙ্গীর কাছ থেকে এমন কিছু আশা করি যা বাস্তব নয়। প্রতিটি মুহূর্তে উত্তর দেওয়া, সব কথা বলা, নিজের সময় ছেড়ে শুধু আমাদের সময় দেওয়া এসব দাবি ধীরে ধীরে সম্পর্ককে ক্লান্ত করে তোলে। একজন মানুষ তার ব্যক্তিগত সময়, স্বাধীনতা বা ব্যস্ততা ভুলে গিয়ে যদি শুধু সঙ্গীর প্রত্যাশা পূরণ করতে চায়, তাহলে সে নিজেই একসময় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। এবং ঠিক তখনই সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।
বলা হয়, ভালোবাসা মানে দমবন্ধ করা নয়, বরং একে অপরকে নিজের মতো করে বাঁচতে দেওয়াও ভালোবাসারই অংশ। কিন্তু যখন সম্পর্কের মাঝে আসে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ, তখন সেখান থেকে জন্ম নেয় শঙ্কা আর প্রতিরোধ। সঙ্গীকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে অনেকেই না বুঝে এমন কিছু কথা বলে ফেলেন, যা সামনে না বললেও চিরস্থায়ী ক্ষত তৈরি করে। যেমন— “তুমি সবসময় পালিয়ে যাও”, “তুমি আর আগের মতো ভালোবাসো না”, “তুমি নিশ্চয় অন্য কারো সঙ্গে ব্যস্ত”, এই ধরনের কথাগুলো বারবার শুনতে শুনতে একসময় সঙ্গী ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সেই ক্লান্তিই তাকে দূরে সরিয়ে দেয়।
অনেক সময় দেখা যায়, ঝগড়া এড়াতে মানুষ কথা বলা কমিয়ে দেয়, যোগাযোগ এড়িয়ে চলে। কিন্তু সমস্যার মুখোমুখি না হয়ে, চুপ থেকে বা দোষ চাপিয়ে দিয়ে সম্পর্ক রক্ষা করা যায় না। সম্পর্ক মানে তো দুজনের চেষ্টায় গড়ে ওঠা বন্ধন। তাই যখনই কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়, তখন দরকার হয় খোলামেলা আলোচনার। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমরা রাগতে জানি, অভিযোগ করতে জানি, কিন্তু শান্তভাবে বোঝাতে বা বুঝতে চাই না। আর এখানেই তৈরি হয় দুরত্বের দেয়াল।
অনেক সময় আবার সামাজিক মাধ্যমে অতিরিক্ত সক্রিয়তাও সম্পর্ককে নষ্ট করে। সঙ্গী কার পোস্টে কমেন্ট করলো, কার ছবি লাইক দিলো, কার সঙ্গে ছবি আপলোড করলো— এসব দেখে মনের মধ্যে তৈরি হয় হাজারো প্রশ্ন। এবং এই প্রশ্নগুলো না বুঝেই আমরা অনেক সময় রেগে যাই, কথা বন্ধ করে দিই বা ঝগড়া শুরু করি। অথচ সঙ্গীর ব্যাখ্যা জানার আগেই এই ধরনের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কের জন্য বিষাক্ত হয়ে দাঁড়ায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সম্পর্ক মানে বিশ্বাসের জায়গা, নিয়ন্ত্রণের নয়। ভালোবাসা মানেই নিজের ভেতর জায়গা ছেড়ে দেওয়া, অপরকে বুঝতে শেখা, তাকে স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে দেওয়া। যে সম্পর্ক শুধু সন্দেহে ভরে থাকে, সেখানে ভালোবাসা টিকতে পারে না।
ঢাকার উত্তরার বাসিন্দা রায়হান ও নিশাত দম্পতির উদাহরণই ধরা যাক। রায়হান বলছিলেন, “আমি অফিসে মিটিংয়ে ছিলাম, ফোন ধরতে পারিনি। ফিরে এসে দেখি নিশাত আমাকে ব্লক করে রেখেছে। ওর কাছে ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগই পাইনি। ছোট একটা ভুল বোঝাবুঝি থেকেই আমাদের মধ্যে বড় দূরত্ব তৈরি হয়।” পরে অবশ্য তারা দুজনেই একজন ম্যারেজ কাউন্সেলরের সাহায্য নেন এবং ধীরে ধীরে সমস্যাগুলো বুঝে একসঙ্গে কাজ করতে থাকেন।
এভাবেই, যেকোনো সম্পর্কেই ভুল হতে পারে। কিন্তু সেটি কীভাবে সামলানো হচ্ছে, সেটাই আসল বিষয়। কিছু ভুল এমন থাকে, যেগুলো বারবার হলে সম্পর্ক ভেঙে যেতে বাধ্য। যেমন— অযথা রাগ করা, সন্দেহ করা, ব্যক্তিগত সময় না দেওয়া, একতরফা প্রত্যাশা, এবং খোলামেলা কথা না বলা।
এই ভুলগুলো ছোট হলেও প্রভাব ফেলে গভীরভাবে। আজ যদি একজন ফোন না ধরেছে, তাতে হয়তো তার অসুবিধা ছিল। কিন্তু আমরা যদি ধরে নিই, সে চায় না কথা বলতে, তাহলে সেখানে সম্পর্কের জায়গায় আসে ভুল ব্যাখ্যা। আর এই ভুল ব্যাখ্যার উপর দাঁড়িয়ে কোনো সম্পর্ক স্থায়ী হতে পারে না।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো একজন মানুষ আরেকজনকে ভালোবাসলেও, সে তার নিজস্ব একটা জীবন বাঁচে, নিজস্ব জায়গায় ব্যস্ত থাকে। সেখান থেকে একটু সময় না পাওয়া মানেই ভালোবাসার ঘাটতি নয়। বরং সেই সময়টা না পেয়েও একে অপরকে বোঝার ক্ষমতা থাকাটাই সম্পর্কের আসল শক্তি।
তাই যখন ফোন না ধরে সঙ্গী, তখন রাগ নয়, আগে ভাবুন— তার ব্যস্ততা, অবস্থা বা মনোযোগ কোথায় ছিল। সবকিছুতেই নিজেকে গুরুত্বের কেন্দ্র ধরে চিন্তা করলে ভুল হবেই। ভালোবাসা মানে নিজেকে একটু পেছনে রেখে অপরকে বোঝা। আর যে সম্পর্ক বোঝাপড়ার ওপর দাঁড়িয়ে, সেই সম্পর্কেই দীর্ঘস্থায়ীত্ব থাকে।
ফোন না ধরা, দেরিতে রিপ্লাই দেওয়া, একদিন দেখা না হওয়া— এসব ছোট ছোট বিষয় নিয়ে যদি আমরা প্রতিদিনই নিজেদের ভিতরে বিষ জমাই, তাহলে সেই সম্পর্কের শিকড় শুকিয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি। ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে চাইলে আগে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে, বোঝার চেষ্টা বাড়াতে হবে এবং অভিযোগের চেয়ে আলোচনার পথ বেছে নিতে হবে।
সম্পর্ক গড়তে সময় লাগে, ভাঙতে লাগে না এক মুহূর্তও। আর এই ভাঙনের শুরু হয় অনেক সময় একটিমাত্র না ধরা ফোন কল থেকেই। সেখানেই যদি আমরা একটু ধৈর্য রাখি, একটু সহানুভূতি দেখাই— তাহলে হয়তো অনেক সম্পর্কই বেঁচে যেতে পারে।
এম.কে.