ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০২ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২

সকালে খালি পেটে চা? না হলে শুরু হয় মাথাব্যথা? সতর্ক হোন এখনই

প্রকাশিত: ০৫:১২, ২ জুলাই ২০২৫

সকালে খালি পেটে চা? না হলে শুরু হয় মাথাব্যথা? সতর্ক হোন এখনই

ছ‌বি: প্রতীকী

সকালে ঘুম ভাঙার পর প্রথম কাজ হিসেবে এক কাপ চা খাওয়ার প্রবণতা আমাদের সংস্কৃতিতে গভীরভাবে গেঁথে গেছে। কারও জন্য এটি একটি আরামদায়ক অভ্যাস, কারও জন্য আবার এক ধরনের নির্ভরতা; চা না পেলে দিনই যেন ঠিকমতো শুরু হয় না। অনেকেই বলেন, চা না খেলেই মাথায় কেমন একটা চাপ অনুভব করেন, কখনো কখনো সরাসরি মাথাব্যথা শুরু হয়, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় এবং কাজে মন বসে না। নিখুঁত স্বাদের কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতেই শরীর ঝটপট সাড়া দেয়, চোখ মেলে যায়, মনে হয় শক্তি ফিরে এসেছে। কিন্তু খালি পেটে চা খেলে শরীরে যে ক্ষতি হতে পারে, সে কথা দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসকেরা বলে আসছেন।

চায়ের পাতায় থাকে ট্যানিন ও ক্যাফেইন নামের দুটি শক্তিশালী উপাদান। দিনের মাঝামাঝি কিংবা বিকেলবেলা হালকা নাস্তাসহ চা খেলে এগুলো শরীরকে সতেজ হতে সহায়তা করে, কারণ তখন পাকস্থলীতে অন্য খাবার উপস্থিত থাকে এবং এসিডের প্রাকৃতিক ভারসাম্য মোটামুটি ঠিক থাকে। কিন্তু রাতে দীর্ঘ সময় ঘুমানোর পর পাকস্থলীতে অ্যাসিড নিঃসরণ এমনিতেই কিছুটা বেড়ে থাকে। সেই অবস্থায় খালি পেটে চা প্রবেশ করলে ট্যানিন পাকস্থলীর ভেতরের ঝিল্লি আরও উত্তেজিত করে, পেপটিক অ্যাসিড আরও বাড়িয়ে তোলে। শুরুতে সামান্য অস্বস্তি হয়, পরে তা গ্যাস্ট্রিক, অম্বল বা পেট জ্বালাপোড়ার দিকে গড়াতে থাকে। কারও কারও ক্ষেত্রে এইধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এতই তীব্র হয় যে কয়েক মাসের মধ্যে পাকস্থলীর দেয়ালে ক্ষত তৈরি হতে পারে; দীর্ঘদিন অবহেলা করলে আলসার পর্যন্ত দেখা দিতে পারে।

চায়ে থাকা ক্যাফেইন মানুষের স্নায়ুতন্ত্রকে উদ্দীপিত করে, রক্তনালীর সংকোচন ঘটায় এবং মস্তিষ্কে ‘ডোপামিন’ নামের সুখানুভূতিমূলক রাসায়নিক বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। ক্যাফেইনের এই তাৎক্ষণিক প্রভাবই অনেককে চনমনে অনুভূতি দেয়, মনে হয় ঘুমের ঘোর কেটে গেছে। সমস্যাটা শুরু হয় তখন, যখন শরীর এই উদ্দীপক পদার্থকে প্রতিদিন ঠিক একই সময় প্রত্যাশা করতে শেখে। কেউ যদি হঠাৎ একদিন সকালে চা না খেয়ে কাজে বের হন, তখন শরীর সেই প্রত্যাশিত ক্যাফেইন না পেয়ে রক্তনালীগুলোকে আবার দ্রুত প্রসারিত করে। সংকোচন-প্রসারণের এই হঠাৎ পরিবর্তন মাথার ভেতরে চাপ সৃষ্টি করে, যার ফলাফল হয় মাথাব্যথা, চোখে ভারী অনুভূতি কিংবা আলোকসংবেদনশীলতা। এই অবস্থাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ক্যাফেইন বহিষ্করণজনিত লক্ষণ বলা হয়, যা কখনো কখনো মাইগ্রেন আকারেও দেখা যায়।

পাশাপাশি খালি পেটে চা খাওয়ার ফলে শরীর দ্রুত ডিহাইড্রেটেড হতে পারে। রাতে দীর্ঘ সময় পানি না খাওয়ার পর সকালে দেহের পানির মাত্রা এমনিতেই কম থাকে। সেই অবস্থায় চায়ের হালকা মূত্রবর্ধক (ডাইইউরেটিক) বৈশিষ্ট্য শরীর থেকে আরও তরল বের করে দেয়। পর্যাপ্ত পানি ঘাটতির কারণে রক্ত ঘন হয়ে যায়, রক্তনালীর ভেতরে চলাচল বাধাগ্রস্ত হয় এবং মাথায় রক্তপ্রবাহ কমে গিয়েও মাথাব্যথা তৈরি করতে পারে। সুস্থ থাকতে গেলে ঘুম ভাঙার পর প্রথমেই এক গ্লাস স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি পান করা প্রয়োজন, যাতে শরীরের অক্সিজেন পরিবহন ও বিপাকক্রিয়ার গতি স্বাভাবিক গতিতে ফিরতে পারে। পানি না খেয়ে সরাসরি চা খেলে মাথাব্যথা ছাড়াও মাথা ঘোরা, দুর্বল লাগা কিংবা বমিভাব দেখা দিতে পারে।

নারীদের ক্ষেত্রে খালি পেটে চা খাওয়ার ক্ষতি আরও জটিল হয়ে উঠতে দেখা যায়। মাসিক চক্রের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে শরীরে এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের ওঠানামা পাকস্থলীর কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে। এই সময় ট্যানিনের অতিরিক্ত চাপ পেটে ফাঁপা, গ্যাস বা বদহজমের প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। যেসব নারী রক্তস্বল্পতায় ভোগেন, তাঁদের শরীরে আয়রনের প্রাপ্তি এমনিতেই কম। ট্যানিন আয়রনের শোষণ বাধাগ্রস্ত করে; ফলে নিয়মিত খালি পেটে চা খেলে আয়রন-ঘাটতি আরও তীব্র হয়ে অ্যানিমিয়া, ক্লান্তি ও বারবার মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। গর্ভবতী বা শিশুকে দুধ পান করানো মায়েদের জন্যও একই সতর্কতা প্রযোজ্য।

কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, শুধু দুধ-চা খেলে কি ক্ষতি কমে যায়? বাস্তবে দেখা যায়, দুধ-চা বা লিকার-চা—দুই ধরনের চায়েরই মূল উপাদান কিন্তু একই রকম। দুধ সাময়িকভাবে পাকস্থলীকে যতটা শান্ত করে, ট্যানিন ঠিক ততটাই আবার অ্যাসিড বাড়ায়। দুধ-চায়ে চিনি থাকলে ইনসুলিনের হঠাৎ উত্থান আরও বিচিত্র বিপাক-ঝামেলা তৈরি করতে পারে। তাই দুধ মিশিয়েও খালি পেটে চা খেলে সমস্যা পুরোপুরি এড়ানো যায় না।

অভ্যাস বদলানো কঠিন কাজ, কিন্তু অসম্ভব নয়। বিশেষজ্ঞেরা বলেন, সকালটা শুরু করুন এক গ্লাস পানি দিয়ে, চাইলে হালকা কুসুম গরম হতে পারে। এরপর যদি খুব চা না খেলে চলেই না, তবে অন্তত কয়েকটা বিস্কুট, কয়েকটা বাদাম কিংবা একটি ছোট ফল খেয়ে নিন, তবেই চায়ের কাপে চুমুক দিন। এতে পাকস্থলীতে কিছুটা খাবার থাকবে, ট্যানিন সরাসরি পেটের দেয়ালে লাগবে না এবং শরীর ক্যাফেইন গ্রহণের আগে সামান্য শক্তি পাবে। ধীরে ধীরে যারা খুব বেশি চা নির্ভর, তাঁরা দৈনিক ক্যাফেইনের পরিমাণ কমাতে পারেন; যেমন প্রতিদিন এক কাপের বদলে আধা কাপ, কয়েক সপ্তাহ পর দুই দিনে এক কাপ। একই সময়ে লেবু-পানি, মধু-পানি, আদা-দারুচিনি বা তুলসিপাতা দিয়ে তৈরি ক্যাফেইনমুক্ত ভেষজ পানীয় খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুললে শরীর স্নায়ু-উদ্দীপক পদার্থ ছাড়া সতেজ থাকার কৌশল শিখে নেয়।

ওয়ার্ক-ফ্রম-হোমের সময়ে অনেকেরই সকালের রুটিন এলোমেলো হয়ে পড়েছে। কেউ দেরি করে ঘুম থেকে উঠছেন, কেউ আবার ঘুম থেকে উঠেই কম্পিউটার অন করে কাজ করছেন। তাড়াহুড়োর মধ্যে জলখাবার বাদ পড়ে যাচ্ছে, কেবল চায়ের কাপই মুখে যাচ্ছে। এভাবে দিনের পর দিন চললে ডিহাইড্রেশন, খাদ্যস্বল্পতা ও ক্যাফেইন-নির্ভরতার সম্মিলিত ধাক্কায় পেশির টান, চোখজ্বালা, মনোযোগহীনতা এবং দীর্ঘমেয়াদে উদ্বেগ বা ঘুমের অসুবিধা দেখা দিতে পারে। স্বাস্থ্যবিদেরা মনে করেন, কাজের চাপ যত থাকুক, শরীরকে যথাযথ জ্বালানি না দিলে মস্তিষ্কও একসময় থমকে দাঁড়ায়।

ঢাকার উত্তরা এলাকার ব্যাংককর্মী আনিসুর রহমানের অভিজ্ঞতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, অভ্যাস বদলানো কতটা জরুরি। বছরখানেক আগেও তিনি ঘুম থেকে উঠেই বড় মগভর্তি দুধ-চা না খেলে অফিস যেতে পারতেন না। দুপুরের দিকে তীব্র অম্বল, বিকেল থেকে মাইগ্রেনের ব্যথা তাঁকে প্রায়ই বেকায়দায় ফেলত। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে প্রথমে সকাল-বিকেলের মাঝখানে এক গ্লাস পানিতে লেবু মিশিয়ে খাওয়া শুরু করেন, চায়ের পরিমাণ অল্প অল্প কমিয়ে আনেন। তিন মাসের মাথায় মাইগ্রেনের ওষুধ ছাড়াই ব্যথা নিয়ন্ত্রণে আসে। তিনি বলেন, শুরুতে মনে হয়েছিল অসম্ভব, এখন বুঝি শরীর যেমন, তেমন অভ্যাসও বদলাতে পারে, যদি দৃঢ় সিদ্ধান্ত থাকে।

পুষ্টিবিদেরা বারবার মনে করিয়ে দেন, যেকোনো অভ্যাসের চাবিকাঠি হলো সচেতনতা। আপনার শরীরে ঠিক কোন খাবার কখন গ্রহণ করবেন, তা বুঝতে পারলেই অর্ধেক কাজ শেষ। চা নিশ্চয়ই পরিহার্য নয়, কিন্তু সময়টা নির্বাচন করা জরুরি। সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠে যদি সাতটা পাঁচ মিনিটে চা খান, পাকস্থলী বিশ মিনিট সময়ও পায় না নিজেকে প্রস্তুত করার। অথচ সাতটা ত্রিশে হালকা নাস্তা সেরে আটটায় চা খেলে একই কাপ চায়ের সামগ্রিক ক্ষতি অর্ধেকে নেমে আসে।

চা-প্রেমী পরিবারের লোকজনের মধ্যে এই আলোচনা শুরু করা দরকার। অনেক সময় প্রবীণরা ছোটদের খালি পেটে চা খেতে উৎসাহ দেন, কারণ তাঁদের নিজেদেরও সে অভ্যাস আছে। কিন্তু নতুন প্রজন্মের খাদ্যাভ্যাস ভিন্ন, রাত জাগা ও ভিন্নধর্মী ফাস্টফুড আরও হজমজটিলতা তৈরি করে; তাই একান্তই চা খেতে হলে পরিবারের সবাইকেই খালি পেটে চা এড়িয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

অবশেষে একটি কথা না বললেই নয়। চা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গী, অতিথি আপ্যায়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু কোনো উপকারী জিনিস ভুল সময়ে গ্রহণ করলে সেটিই ওষুধ থেকে বিষে পরিণত হয়। খালি পেটে চা খাওয়ার এই ক্ষুদ্র অভ্যাসকে যদি উপেক্ষা করা হয়, তা ভবিষ্যতে পাকস্থলী, স্নায়ু ও হরমোনের জটিল অসুখ ডেকে আনতে পারে। তাই আজই সিদ্ধান্ত নিন, ঘুম ভেঙে প্রথমে পানি, তারপর হালকা কিছু খাবার, তারপর চা। মাথাব্যথা বা অস্বস্তি যদি ইতিমধ্যে স্থায়ী সঙ্গী হয়ে থাকে, তবে দেরি না করে চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন। আপনার এক কাপ চা যেন আরাম ও আনন্দের প্রতীকই থাকে, শরীরের জন্য লুকানো বিপদের চাবিকাঠি না হয়।

এম.কে.

×