ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সঞ্জয় সরকার

ভাটি অঞ্চলের সারিগান

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ২২ জুলাই ২০১৬

ভাটি অঞ্চলের সারিগান

‘সারিগান’ ভাটি অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত। এক সময় হাওর-বাঁওড়, নদী-নালা ও বিল-ডোবা অধ্যুষিত নেত্রকোনা অঞ্চলের সারি গানের ব্যাপক সুখ্যাতি ছিল। বর্ষাকালে এ জনপদের প্রায় প্রতিটি গ্রাম সারিগানের আনন্দে-ঝংকারে নেচে উঠতো। নেত্রকোনা ছাড়াও কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ঢাকা, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহীর চলনবিল, পাবনা, বরিশাল, যশোর, রাজবাড়ী প্রভৃতি অঞ্চলেও প্রচলন ছিল সারিগানের। তবে এখন আর আগের মতো এর জৌলুস নেই। আরও অনেক ধরনের লোকগানের মতো সারিগানও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ‘সারি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘পঙতি’ বা ‘শ্রেণী’। শ্রেণী বা সারিবদ্ধ মানুষের গানই হচ্ছে সারিগান। অর্থাৎ সারি বা দলবদ্ধভাইে এ গান পরিবেশন করা হয়। ধারণা করা হয়, পনর শতকেরও আগে সারি গানের উদ্ভব হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদে ‘সারি’ শব্দের ব্যবহার রয়েছে। এছাড়াও পনর শতকের কবি বিজয় গুপ্ত পদ্মপুরাণে একাধিকবার ‘সারি’ গানের কথা উল্লেখ করেছেন। এর একটি উদাহরণ : ‘সকল ডিঙ্গায়ে চড়িয়া গাবরে(ভৃত্য) গাহে সারি দেখিতে দেখিতে ডিঙ্গা এড়াইল গাঙ্গুরি ॥ ধবল নদী এড়াইয়া মানিক্যপুর যায়ে হাতা তালি দিয়া গাবরে গীত গায়ে ॥’ ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে বা দূরের গন্তব্যে পৌঁছাতে মাঝি-মাল্লাদের যখন গৃহ-সংসার ছেড়ে হাওর বা নদীবক্ষে দিনের পর দিন কাটাতে হতো তখনই উদ্ভব হয়েছে এ ধরনের গান। মূলত দীর্ঘ শ্রমের ক্লান্তি দূর করার জন্য চিত্ত বিনোদন বা মনোরঞ্জনই ছিল সারিগানের মুখ্য উদ্দেশ্য। সারিগানের সঙ্গে ‘ভাটিয়ালী’ গানের কিছুটা সাদৃশ্য আছে। উভয় গান একই ধরনের পেশার সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ ভাটিয়ালীর মতো সারিগানও নৌকা, নদী ও মাঝি কেন্দ্রিক। নৌকা বেয়ে বা বৈঠা টেনে যাদের জীবন-জীবিকা চলে তারাই এ গানের ধারক ও বাহক। ভাটিয়ালীর মতো সারিগানের বিষয়বস্তুতেও লৌকিক প্রেম, পৌরাণিক রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলা ও আধ্যাত্মিকতা স্থান পেয়েছে। তবে ভাটিয়ালীর সঙ্গে ভিন্নতা রয়েছে সুর, তাল, লয় ও আবেগ-উচ্ছ্বাসের ক্ষেত্রে। ভাটিয়ালী মাঝি-মাল্লাদের অবসর মুহূর্তের গান- যা একক কণ্ঠে গাওয়া হয়। এর সুর করুণ, টান দীর্ঘ, লয় ধীর ও প্রলম্বিত। এতে সাধারণত বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয় না। অন্যদিকে সারিগান একটি কর্মসঙ্গীত। কর্মের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এটি গাওয়া হয় সমবেতভাবে এবং তাল ও বাদ্যযন্ত্র সহযোগে। এর লয় দ্রুত এবং সুর অনেকটা রসাত্মক ও উৎসাহব্যঞ্জক। ভাটিয়ালীতে হতাশা, বৈরাগ্য বা বিরহ-বিচ্ছেদের সুর প্রতিফলিত হলেও সারিগান মাঝি-মাল্লাদের এনে দেয় প্রাণচাঞ্চল্য, কর্মোৎসাহ। তাই নৌকায় বসে ভাটির কর্মজীবী মানুষেরা ভাটিয়ালীর উদাস সুরে যেমন ডুবেছেন বা মজেছেন, তেমনি আবার কর্মস্পৃহা ফিরে পেতে সমবেত কণ্ঠে সারিগানও গেয়েছেন তারা। ভাটিয়ালীর মতো সারিগানও শুধু নৌকার গ-ির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ধান-পাটের ক্ষেত নিড়ানো, ছাঁদ পেটানো প্রভৃতি কাজেও শ্রমিক শ্রেণীর লোকজন কর্মোদ্যমের তাগিদে সারিগান গাইতেন। ভাটি অঞ্চলে সারিগান সবচেয়ে বেশি অনুষ্ঠিত হয় নৌকাবাইচকে কেন্দ্র করে, যা এখনও কালে-ভদ্রে দেখা যায়। উদ্ভবকালের অনেক পরে সারিগানের সঙ্গে নৌকা বাইচযুক্ত হয়। তবে এক পর্যায়ে এসে একটি আরেকটির অবিচ্ছদ্য অংশ হয়ে পড়ে। এর মধ্য দিয়ে সারিগানে একটি নতুন মাত্রা যোগ হয় এবং দু’টিরই জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। নেত্রকোনা এবং কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে নৌকাবাইচের গানকে বলা হয় ‘হাইর গান’। ‘হাইর’ শব্দটি ‘সারি’ শব্দেরই বিকৃত রূপ(সারি>সাইর>হাইর)। কিছুকাল আগেও ভাটির প্রতিটি অঞ্চলে বর্ষাকালে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। আর নৌকাবাইচকে কেন্দ্র করে পাড়া-গ্রামে ধুম পড়তো সারিগানের। বিশেষ করে হিন্দুদের শ্রাবণী পূজা (মনষা পূজা) এবং আশ্বিনের দুর্গা পূজার মূর্তি বিসর্জনের দিন নৌকা বাইচ ও সারিগান ছিল অতি অত্যাবশ্যকীয়। এ প্রসঙ্গে খ্যাতিমান লোক সাহিত্য সংগ্রাহক সিরাজুদ্দীন কাশিমপুরীর একটি উদ্ধৃতি প্রণিধানযোগ্য। ‘বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত পরিচিতি’ গ্রন্থের তৃতীয় খ-ে তিনি লিখেনÑ শ্রাবণ হইতে ভাদ্র-আশ্বিনের ভরা নদীতে কিংবা সুবৃহৎ পরিষ্কার বিলে-ঝিলে অথবা নদী-হাওরবহুল অঞ্চলে এই নৌকা বাইচ চলিয়া থাকে। এই প্রতিযোগিতার বিশেষ উৎসব অনুষ্ঠিত হইত শ্রাবণ সংক্রান্তি ও শারদীয় পূজার প্রতিমা বিসর্জনের দিনে।... বাইচের দিন বাইচারা নৌকায় বসিয়া এক প্রকার গান গায়। এইসব গানকে সারিগান বা ‘হাইর’ বলে। অন্যান্য লোকগানের মতো সারিগানেরও বিষয়বৈচিত্র্য রয়েছে। তবে রাধা-কৃষ্ণ কাহিনী, নিমাই সন্ন্যাস কাহিনী, রাম-লক্ষণ কাহিনী, লৌকিক প্রেম প্রভৃতিই সারিগানের মূল বিষয়। এ ছাড়াও আছে লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদের কাহিনীসহ স্থূল রঙ্গ-রসিকতার গান। এটি সমবেত সঙ্গীত হলেও একজন মূল বয়াতী থাকেন। তাকে নেত্রকোনার কোথায়ও কোথায়ও আঞ্চলিক ভাষায় ‘সাইড়ল’ (সারি>সাইর>সাইড়ল) বলা হয়। তিনি প্রথমে নৌকার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কাঁসার ঝাঁঝের তালে (কাঁসার তৈরি বাদ্যযন্ত্র) গানের প্রথম অংশটুকু (দিশা) সুরে টান দেন। পরে বাইচা (যারা বৈঠা বায়) ও দোহারীরা তার সঙ্গে কণ্ঠ মিলান। একটি গান দিয়ে উদাহরণ দেয়া যাকÑ ‘বাঁশি বাজে বাজে রইয়া রইয়া গৃহে যাইতে মন চলে না প্রাণ বন্ধুরে থইয়া ॥ কদমতলায় বাজে বাঁশি রাধারে শোনাইয়া পায়ে ধরি থামাও বাঁশি নাগর কানাইয়া ॥’ সাইড়ল ‘বাঁশি বাজে বাজে রইয়া রইয়া/গৃহে যাইতে মন চলে না প্রাণ বন্ধুরে থইয়া’ দিশাটি ঠিক রেখে পুরো গানটি একাই গেয়ে যান। আর দোহারী ও বাইচারা কেবল দিশার অংশটুকুতেই বার বার তার সঙ্গে কণ্ঠ মিলান। দিশাগুলো এমন ছিলÑ যার সঙ্গে মিল রেখে বয়াতীরা তাৎক্ষণিকভাবেও গান রচনা করে গাইতে পারতেন। তাৎক্ষণিকভাবে রচিত গানের কথা অনেকটা জারি-সারি-ঘাটু প্রভৃতি গানের কথার মতোই হয়ে থাকে। সারিগানের প্রধান বাদ্য ঝাঁঝ। এছাড়াও ঢোল, মন্দিরা বা করতাল বাজনো হয়ে থাকে। গানের তালই মূলত নিয়ন্ত্রণ করে বাইচাদের। গানের তালের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই তারা বৈঠা ওঠায়-নামায়। এভাবেই ছন্দময় তালে হেলে-দুলে এবং জলের বুকে অদ্ভুদ এক জলতরঙ্গ তুলে এগিয়ে চলে ‘দৌড়ের নৌকা’। সারি গানেরও বিভিন্ন পর্ব বা রকমভেদ রয়েছে। একেক মুহূর্তে একেক রকম তাল-লয়ের গান পরিবেশন করা হয়। নৌকা নিয়ে বাইচারা যখন বাড়ির ঘাট থেকে জলযাত্রা শুরু করেন তখন থেকেই আরম্ভ হয় সারি গান। যাত্রাপর্বে গাওয়া হয় ধীর লয়ের ‘বন্দনাগীত’। এরপর চলন্ত পর্ব। নৌকা বাইতে বাইতে আর গান গাইতে গাইতে প্রতিযোগিতার স্থানে এগিয়ে চলেন বাইচারা। তখনও চলে মধ্য লয়ের গান। প্রতিযোগিতার ঠিক আগ মুহূর্তের গানগুলো থাকে উদ্দীপক। দ্রুত লয়ের উদ্দীপক গানগুলো তখন বাইচাদের শক্তি ও গতি সঞ্চার করে। প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত মুহূর্তটিকে বলা হয় ‘ছুব’। ছুবের সময় গান গাওয়ার কোন সুযোগ থাকে না। তখন শুধু দ্রুত তালে বাদ্য বাজনা বাজে। এ সময় বয়াতীরা ঝাঁঝের তালে তালে ‘সাব্বাস ভাই’, ‘সাবুডি ভাই’Ñ এ ধরনের উৎসাহব্যাঞ্জক শব্দ বলে থাকেন। আর তার শব্দ-ধ্বনিতে সাড়া দিয়ে বাইচারাও বলে ওঠেনÑ ‘হেইও’ বা ‘হিঙ্গইল’। আবার প্রতিযোগিতার পর নৌকা নিয়ে প্রতিযোগিতার আশপাশ এবং গ্রাম প্রদক্ষিণ করার সময় গাওয়া হয় ‘বিজয় সঙ্গীত’। বিজয়ের গান টানা কয়েকদিন ধরে চলে। আর সবশেষে বাইচারা যখন নৌকা নিয়ে বাড়ির ঘাটে ফিরে যায়Ñ তখন পরিবেশন করা হয় করুণ সুরের ‘বিদায় সঙ্গীত’। এগুলোও ধীর লয় বা তালে গাওয়া হয়। নৌকা বাইচ শেষ হলেও সারিগান শেষ হয় না। বিজয়ী নৌকা নিয়ে বাইচারা মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম ঘুরে বেড়ান। বিভিন্ন জনের বাড়ির ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে তারা সারি গান করেন। হিন্দু মেয়ে-বধূরা নৌকার গলুইয়ে তেল-সিদুঁরের ফোটা ও ধান-দূর্বা দিয়ে উলুধ্বনি দেন। এর সঙ্গে উপঢৌকন হিসেবে দেন নগদ টাকা, চাল, ধান, পান-চিনি অথবা নারকেল, কলা, জাম্বুরা প্রভৃতি ফল-মূল। বাইচারা তখন সে বাড়ির লোকদের গুণকীর্তন করে আবার সারি গান ধরেনÑ ‘অমুক পাড়ার (পাড়ার নাম) অমুক বাবু(গৃহ কর্তার নাম) বড় ভাগ্যবান পান চিনি খাওয়াইয়া করলো টাকা দান সখি হায় মরিরে॥’ আবার বিজয়ী নৌকার মালিকের গুণকীর্তনও কম হয় না। নৌকার মালিকের নাম ধরে বাইচারা মাঝে মাঝে গেয়ে চলেনÑ ‘খলাপাড়ার কাচু মিয়া বড় ভাগ্যবান সোনার একটা মেডেল দিয়া বাড়াইছে সম্মান মান বাড়িবে গুণ বাড়িবে সকল আল্লার দান জীবন দিয়া রাখবো মোরা তালুকদারের মান’। এভাবে টানা কয়েক দিন ধরে গান চলে। গাইতে গাইতেই একদিন শেষ হয় সারিগানের আনুষ্ঠানিকতা। প্রসঙ্গত বলা দরকার, হিন্দু-মুসলমান সব সম্প্রদায়ের লোকেরাই অংশগ্রহণ করে সারিগানে। নেত্রকোনা অঞ্চলে আরেক ধরনের সারিগান হতো বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে। বছরের ওই সময় চাষীরা যখন দলবেঁধে পাট ক্ষেত নিড়ানী দিতো (ছেনি বা খুন্তি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতো) তখন মনের আনন্দে সারিগান করতেন। কাজে উৎসাহ ও সামর্থ্য বৃদ্ধি এবং ক্লান্তি দূর করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। একই উদ্দেশ্যে মাঝে-মধ্যে ক্ষেতে ধান রোপণের সময়ও গাওয়া হতো সারিগান। নৌকাবাইচের সারিগানের মতোই একজন বয়াতী পুরো গান গাইতেন আর বাকিরা দোহারী হিসাবে দিশায় কণ্ঠ মেলাতেন। কৃষিক্ষেত্রের সারিগানে কোন ধরনের বাদ্য যন্ত্রের ব্যবহার হতো না। আজকালকার দিনে এ ধরনের সারিগান আর দেখা যায় না। আবহমান বাংলার লোক সংস্কৃতির অন্যান্য উপাদানের মতো সারিগানের ঐতিহ্যও আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। এক সময় সারি গান ও নৌকাবাইচকে কেন্দ্র করে পুরো গ্রামাঞ্চল জুড়ে যে উৎসবের ঢেউ লাগতোÑ এখন তার ছিঁটে-ফোঁটাও নেই। ভাটির গ্রামাঞ্চলে এখন সারিগান হয় না বললেই চলে। আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন, অপসংস্কৃতি, মৌলবাদ, যন্ত্রনির্ভর জীবন-জীবিকা, প্রকৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি গিলে খাচ্ছে আমাদের সবকিছু। ভাটির আগের প্রকৃতি বা পরিবেশ-প্রতিবেশ যেমন নেই, তেমনি ভাটির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও নেই আগের মতো। অথচ, লোক সংস্কৃতির এসব উপাদানই ছিল ভাটির প্রাণ। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষের মেলবন্ধন রচিত হতো এসব লৌকিকতার মধ্য দিয়েই। এগুলোর মধ্যেই নিহিত ছিল নদীমাতৃক বাংলার পরিচয়।
×