ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

১৯৫ যুদ্ধাপরাধী বনাম আটকে পড়া বাঙালী

প্রকাশিত: ০৪:০২, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৫

১৯৫ যুদ্ধাপরাধী বনাম আটকে পড়া বাঙালী

(শেষাংশ) যেখানে পরস্পর পরস্পরকে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের জন্য অভিযোগ করেছে। ভুট্টো এই কমিশনের প্রতিবেদনে যেমন প্রকাশ করেননি, তেমনি ১৯৫ জনকে বিচারের মুখোমুখি করেননি। কারণ প্রধান আসামি কসাই টিক্কা খান তখন ভুট্টোর সেনাপ্রধান। দিল্লী চুক্তিতে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানী নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা থাকলেও ভুট্টো তা করেনি। অপরদিকে চুক্তিতে আটকেপড়া বাঙালীদের দেশে ফেরত পাঠানোর উল্লেখও রয়েছে। ভুট্টো চুক্তির কোনটিই আসলে কার্যকর করেনি। কারণ ভুট্টো বলেছিল, চুক্তির আগে যে পাকিস্তান নিজে তার জাতীয় আইনের ভিত্তিতে তাদের বিচার করবে। ভুট্টো তো ’৭২ সাল থেকেই নিজে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু কথা রাখেনি। সময়টা ছিল বাংলাদেশের প্রতিকূলে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অনেকটা নাজুক ছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো ছাড়া আর কেউ সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। এমনকি মুসলিম দেশগুলোও নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার মতো বাস্তব অবস্থা এবং উপকরণগত সহায়তাও বাংলাদেশের ছিল না। সে সময় বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়, দুটি কারণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের ছেড়ে দিতে রাজি হন। প্রথমত, পাকিস্তানে আটকেপড়া প্রায় ৪ লাখ বাঙালী সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে এমন অনেকেই রয়েছেন, যারা তার প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীতে ‘সম্পদ’ হিসেবে গণ্য হবেন। তাছাড়া, যুদ্ধবন্দী বিচারের ওপর প্রায় ৪ লাখ আটকেপড়া বাঙালী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের জীবন-মরণ ও সুখ-দুঃখ নির্ভর করছে। দ্বিতীয়ত, যেসব দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করেছে এবং সাহায্য দিয়েছে, তাদের মধ্যে ভারত ছাড়া আর প্রায় দেশই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করার অনুরোধ জানিয়েছিল। পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালীদের ভুট্টো জিম্মি করে রেখেছিল। আন্তর্জাতিক বিশ্ব এ বিষয়ে সেভাবে এগিয়ে আসেনি। ভারত এ ব্যাপারে পাকিস্তানের ওপর চাপ বহাল রেখেছিল। কিন্তু এই বাঙালীদের ফেরত আনার জন্যই সেদিন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করেই ছেড়ে দিতে হয়েছিল। দিল্লী চুক্তি অনুযায়ী তাদের বিচারের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়নি। যদিও তাদের প্রায়োজনই আর জীবিত নেই। কিন্তু মরণোত্তর বিচার কাজটি পাকিস্তানের করা উচিত তাদের নিজেদের স¦ার্থে যেমনি, তেমনি বিশ্বের শান্তির স্বার্থেও। যুদ্ধাপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার নজির বিশ্বে আর নেই। কূটনৈতিক লড়াইটায় খোদ পাকিস্তান বিজয়ী হয়েছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানীদের একটি নির্দিষ্ট গ-ির মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে। মুক্তিযুদ্ধের পর জাতিসংঘ ও শরণার্থী কমিশন এবং রেডক্রস তাদের নিয়ে কাজ করে। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তাদের শরণার্থী মর্যাদা দেয়া হয়। রেডক্রস তাদের পুনর্বাসনের চেষ্টার অংশ হিসেবে নাগরিকত্ব পরিচয় লিপিবদ্ধ করলে, তারা নিজেদের পাকিস্তানী নাগরিক পরিচয় দিয়ে সে দেশে ফেরত যেতে চায়। সে সময় থেকে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিহারিদের ‘আটকেপড়া পাকিস্তানী’ বলে অভিহিত করা হয়। এদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক রেডক্রস ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের ৬৬টি ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়। এর মধ্যে ঢাকার মিরপুরে ২৫টি, মোহাম্মদপুরে ৬টি ক্যাম্প। ১৯৭৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেডক্রস বিদায় নিলে বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি এদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নেয়। আটকেপড়া পাকিস্তানীদের ফেরত নিতে জেদ্দাভিত্তিক সংগঠন রাবেতা আল আলম ইসলাম জরিপ চালায়। তারা তালিকাও প্রণয়ন করে। সর্বশেষ ২০০৩ সালে পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, প্রায় ২ লাখ ৭৫ হাজার উর্দুভাষী পাকিস্তানী ৮১টি ক্যাম্পে বসবাস করছে। এদের ফেরত নিতে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জিয়াউল হক সত্তর দশকে একটি তহবিল গঠন করেছিলেন, কিন্তু তা ব্যবহার করা হয়নি। অর্থাৎ পুনর্বাসন থমকে থাকায় তা ব্যয় হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ক্যাম্পগুলো বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে চলছে। ১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি পরিচালিত সমীক্ষা অনুযায়ী ৫ লাখ ৩৯ হাজার ৬৬৯ বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের পাকিস্তানী নাগরিক দাবি করে সে দেশে ফিরে যেতে চায়। ১৯৭৩ এবং ১৯৭৪ সালে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ এই মানবিক সমস্যা মোকাবেলায় একাধিক চুক্তি করে। ইন্দো-পাক এগ্রিমেন্ট ১৯৭৩, জেদ ট্রাইপাটাইট এগ্রিমেন্ট অব বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্ডিয়া, ১৯৭৫-এই চুক্তিগুলোর অন্যতম। ১৯৭৪ সালে তিন দেশের মধ্যে সম্পাদিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ মাত্র তিন শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিদের পাকিস্তানে ফেরত নিতে সম্মত হয়। চুক্তির আওতায় পাকিস্তান ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬শ’ ৩৭ জনকে ফেরত নেয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করে। তবে মাত্র ১ লাখ ২৬ হাজার ৯শ’ ৪১ জনকে ফেরত নেয়। বাকি ৪ লাখ ফেরত নেয়নি। বাংলাদেশে উর্দুভাষীদের মূল সমস্যাটি নাগরিকসংক্রান্ত। তারা বাংলাদেশী না পাকিস্তানী? ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ দশকগুলোতে ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে কাজ করার জন্য অনেক উর্দুভাষী বিহার, উড়িষ্যা ও উত্তর প্রদেশ থেকে পূর্ববঙ্গে আসে। এদের বেশিরভাগই বিহারের। যারা প্রধানত, রেলপুলিশ, বিচার ব্যবস্থা ও অন্য বেসামরিক পদগুলোতে যোগ দিয়েছিলেন। সৈয়দপুরে বৃহৎ রেল ওয়ার্কশপে কাজ করার জন্য ব্রিটিশরা বিহার থেকে ৭ হাজার জনকে নিয়ে এসেছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ ও দাঙ্গার ফলে ১৩ লাখ মুসলিম অধিবাসী পূর্ববাংলায় আসে। এর মধ্যে ১০ লাখ বিহারি। এদের মোহাজির অভিহিত করা হয়। পূর্ববঙ্গের সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক ভিন্নতার পাশাপাশি ভাষাগত ভিন্নতার মুখোমুখি হয় তারা। বাংলাভাষা বা লিপি তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এ কারণে এবং রাজনৈতিক নীতির কারণেও এরা বাংলা ভাষা এবং বাঙালীকে এড়িয়ে চলে এবং দৃঢ় গোষ্ঠীগত বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। এমনকি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হতে বিচ্ছিন্ন থাকে। এরাই হিন্দুদের জমিজমা দখল করার জন্য ঢাকাসহ অন্যান্য স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঘটায়। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সহযোগী হয়ে গণহত্যায়ও অংশ নেয়। এরা আলশামস বাহিনী গঠন করেছিল। ১৯৯২ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা দেয় যে, তিন শ’ বিহারি পরিবারকে পাকিস্তানে ফেরত নেয়া হবে। কিন্তু ১৯৯৩ সালে মাত্র ৫০ পরিবারকে ফেরত নেয়ার পর প্রক্রিয়াটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রয়েছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশ বিষয়টি উত্থাপন করলেও সন্তোষজনক কোন সুরাহা হয়নি। আটকেপড়া সবাইকে ফেরত নেয়ার জন্য বাংলাদেশের অনুরোধ পাকিস্তান উপেক্ষা করে আসছে। একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদারের সহযোগী বিহারিদের বাংলাদেশ জিম্মিও করেনি কিংবা যুদ্ধাপরাধের দায়ে তাদের বিচারের আওতায় আনেনি। এরা ১৯৭২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মিরপুর দখলে রেখেছিল। মুখোমুখি সশস্ত্র প্রতিরোধে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী তা মুক্ত করে। চিত্রনির্মাতা-সাহিত্যিক জহির রায়হান ওখানেই গুলি বিনিময়ের সময় নিহত হন। পাকিস্তান আটকেপড়া পাকিস্তানীদের স্বদেশ প্রত্যাবাসনের জন্য যে কমিটি করেছে, তারা সম্প্রতি সুপ্রীম কোর্টে বলেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ৪ থেকে ৫ লাখ পাকিস্তানী আটকে পড়ে আছে। পাকিস্তান এদের ফেরত এবং দায়-দায়িত্ব নেবে না। বাংলাদেশকেই এদের দায়-দায়িত্ব বহন করতে হবে। বাংলাদেশ অবশ্য বলে দিয়েছে, ’৭১ পূর্ব সময়ে জন্মগ্রহণকারী পাকিস্তানীদের ফেরত নিতে হবে। ১৯৯২ সালের ১৫ এপ্রিল বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে গোলাম আযমের বিচার সম্পর্কে বিতর্ক হয়। বিএনপির মন্ত্রী জমিরউদ্দিন সরকার, রফিকুল ইসলাম মিয়াসহ বিএনপি সরকার পক্ষের কতিপয় সদস্য বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় রাজাকার ও পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা প্রদর্শন সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা তাদের স্মরণ করিয়ে দেন, ‘যেসব রাজাকারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ ছিল, তাদের ক্ষমা করা হয়নি। ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীকে কেন ছেড়ে দেয়া হয়েছিল তার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা সংসদে আরও বলেন, পাকিস্তানে আটকেপড়া ৪ লাখ বাঙালীকে ফিরিয়ে আনার জন্যই সরকারকে বাধ্য হয়ে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছিল।’ শেখ হাসিনা এমনও বলেন, ‘সেনাপতি নূরউদ্দিন খান, বিডিআরপ্রধান আবদুল লতিফ, জেনারেল সালাম, মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান, মাজেদুল হকসহ ৪ লাখ বাঙালী পাকিস্তানে বন্দী অবস্থায় ছিল, তাদের পরিবার-পরিজনদের মাতমে সাড়া দিয়েই বঙ্গবন্ধু সেদিন যুদ্ধাপরাধী ও পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী সেনাদের ছেড়ে দিয়ে আটকেপড়া বাঙালীদের ফিরিয়ে এনেছিলেন। (সংবাদ ১৬ এপ্রিল ১৯৯১)। পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালীরা শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরতে পেরেছিল। তেমনি ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীসহ ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীও পাকিস্তান ফিরেছিল বিনিময়ের মাধ্যমে। কিন্তু বিহারিদের আর বিনিময় হয়নি। দিল্লী চুক্তি রক্ষা করে পাকিস্তান ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীকে বিচার করেনি যেমন, তেমনি বিহারিদের ফেরত নিচ্ছে না। বিশ্ব জনমতই পারে এ সমস্যার সমাধান করতে।
×