
ছবিঃ সংগৃহীত
ফেনী জেনারেল হাসপাতালে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা মিলছে না। চিকিৎসক, নার্স ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
অভিযোগ রয়েছে, চিকিৎসা নিতে এসে মরণযন্ত্রণায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে রোগীরা। হাসপাতালটি জেলার প্রধান চিকিৎসাসেবার কেন্দ্রবিন্দু হলেও চিকিৎসার কোনো পরিবেশ নেই বলে অভিযোগ করেছেন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর স্বজনরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২৫০ শয্যার জেলা সদরের হাসপাতালটিতে ৫৬ জন চিকিৎসকের মধ্যে ১৩ জন রয়েছেন। ৪৩টি পদই শূন্য। একইভাবে নার্স ১৫৩ জনের মধ্যে ১১৩ জন থাকলেও ৪০ পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়াও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ৪১ জনের মধ্যে ২৬ জন রয়েছেন, শূন্য পদ রয়েছে ১৫টি। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ৭৩ জনের মধ্যে ১৬ জন রয়েছেন। এ পদেও ৫৭টি শূন্য রয়েছে।
এ হাসপাতালে জেলার বাইরে থেকেও প্রচুর রোগী প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় রামগড়, খাগড়াছড়ি, বারইয়ারহাট, চৌদ্দগ্রাম, সেনবাগ থেকেও রোগী ভর্তি হচ্ছে। চিকিৎসার কোনো পরিবেশ নেই—এমন অভিযোগ করেন রোগীর স্বজনরা। প্রকল্পের অধীনে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের যারা পরিচালনা করতেন তারা ৫ আগস্টের পর পালিয়ে যাওয়ায় ১১ মাস কর্মচারীরা বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। এ কারণে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। চিকিৎসার করুণ দশার কারণে রোগীরা সঠিক স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না। শিশুদের ওয়ার্ডে নেই কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে এসে বিগত ৬ মাসে ২৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ শিশু ও বয়স্ক রোগী। রোগীর স্বজনদের অভিযোগ—যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়ার কারণেই রোগীরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এছাড়াও নতুন ভবনে একটি লিফট থাকলেও সেটাও অনেকটা বিকল হয়ে আছে। মুমূর্ষু রোগীরা উপরে ওঠানামা করতে ভীষণ যন্ত্রণায় পড়ছেন।
৮০ বছর বয়সী মায়ের চিকিৎসা নিতে আসা শহীদুল ইসলাম নামের এক রোগীর স্বজন জানান, মাকে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে এসে পদে পদে ধোঁকা খেতে হচ্ছে। স্ট্রেচার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কর্মচারী ও নার্স নেই। পরে একটি স্ট্রেচার খুঁজে নিয়ে নিজেরা টেনে টেনে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। সেখানে গিয়েও দেখা যায় রোগীদের লম্বা লাইন। কাজের ধীর গতি দেখে জিজ্ঞেস করা হলে তারা জানান, জনবল সংকট।
হাসপাতালের আশপাশের দোকানদাররা জানান, সদর হাসপাতালে ডাক্তার নেই বলে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তির জন্য একটি চক্র সেখানে কাজ করে থাকে। তারা যেকোনো রোগী এলে বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়ে ভর্তির পরামর্শ দেয়। এ ধরনের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রোগীর স্বজনরা জানান, এমনিতেই নেই ডাক্তার। আবার যে কয়জন রয়েছেন, তাদের কাছে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ এসে ভিড় জমায়। এতে রোগী দেখা ও চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটছে। যেন দেখার কেউ নেই।
এছাড়াও সকালে টোকেন কেটে লম্বা লাইন ধরে রোগীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। চিকিৎসকরা অনেকটা প্রাইভেট চেম্বার নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।
হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. শোয়েব ইমতিয়াজ নিলয় জানান, কর্মকর্তা-কর্মচারী সংকট থাকায় চিকিৎসাসেবায় বিঘ্ন ঘটছে। সার্জারি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞও সংকট রয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় জেলার বাইরে থেকেও বিভিন্ন জেলা থেকে এখানে রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সুদৃষ্টি দিলে চিকিৎসাসেবার মান উন্নত হবে বলেও তিনি জানান।
জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. কামরুজ্জামান বলেন, জোড়াতালি দিয়ে চলছে চিকিৎসাসেবা। আসলে আমাদের পক্ষ থেকে কিছুই করার নেই। ২৫০ শয্যা হলেও গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৫ থেকে সাড়ে ৫ শত রোগী চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। শূন্যপদ নিয়ে চিকিৎসাসেবা দিতে ভীষণ হিমশিম খাচ্ছেন বলেও তার অভিযোগ। এছাড়া এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। রোগীরা যথাযথ চিকিৎসা পেতে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন। এতেও শতভাগ চিকিৎসাসেবা নয়, ৫০% থেকে ৩৫% স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যাচ্ছে না।
তিনি আরও জানান, চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল দায়িত্বে আসার পর থেকে চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসাসেবা দেওয়া যাচ্ছে না—এই মর্মে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বারবার লিখিতভাবে জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি। জোড়াতালি দিয়েও চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। জনবল সংকট নিরসন হলে আশা করছি চিকিৎসাসেবার মান চাহিদা অনুযায়ী সম্ভব হবে।
জানতে চাইলে ফেনীর সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ রুবাইয়াত বিন করিম জানান, আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। একজন মানুষ যখন জীবনের ঝুঁকিতে পড়ে যায় তখন হাসপাতালে যায়। তখন চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসাসেবা না পাওয়া সত্যিই দুঃখজনক। এখানে দীর্ঘদিন যাবৎ চাহিদা অনুযায়ী জনবল না থাকার কারণেই এ সমস্যাগুলো হচ্ছে। আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। জনবলের জন্য জুন মাসের শেষ পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ে চেষ্টা করেছি। সিভিল সার্জন সম্মেলনেও এ বিষয়ে কথা বলেছি। ১০০ শয্যার স্ট্যান্ডার্ড মানের জনবলের জন্য পদ সৃষ্টির প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। আগে ১০০ শয্যার জনবল স্ট্যান্ডার্ড মানে পৌঁছালে, এরপর ২৫০ শয্যার জন্য যে পরিমাণ জনবল প্রয়োজন সেটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বরাবর লিখিতভাবে জানানো হবে।
ইমরান