
মায়ের দেওয়া খাবার শেষ করতে পারেনি নুসরাত
‘মা, আমার জন্য কী খাবার আনছো?’ ‘তোমার জন্য অনেক খাবার আনছি। তুমি বসে খাও।’ এই বলে মেয়ে নুসরাত জাহান আনিকার হাতে টিফিন হিসেবে রোল, বার্গার ও কোকের বোতল তুলে দেন মা পারুল আক্তার। কিন্তু মায়ের দেওয়া সেই খাবারটুকু শেষ করতে পারেনি নুসরাত।
এর ঠিক ১০ মিনিটের মধ্যে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে নুসরাতদের ক্লাসের ওপর আছড়ে পড়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি যুদ্ধ বিমান। বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায় ওই বিমান ও পাশের ক্লাসগুলোতে। সেই আগুনে মারা গেছে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী নুসরাত।
ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাস থেকে নুসরাতদের বাসা খুব বেশি দূরে নয়। হেঁটে গেলে সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট সময় লাগে। এত কাছাকাছি দূরত্বে রিক্সাও যেতে চায় না। এ কারণে স্কুলে আসা-যাওয়ায় বাবাই ছিল তার সঙ্গী।
গত সোমবারও (২১ জুলাই) তার ব্যতিক্রম হয়নি। সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠে যথারীতি ফ্রেশ হয়ে নাশতা করে নুসরাত। পরে পড়ার টেবিলে থাকা বইখাতা গুছিয়ে সকাল ৭টায় বাবা মো. আবুল হোসেনের হাত ধরে হেঁটে স্কুলে যায় সে। আবুল হোসেন বলেন, ‘দুর্ঘটনার সময় অধিকাংশ বাচ্চাই খাইতেছিল। এ সময় বাচ্চাদের ক্লাসের ভেতরে আটকে রাখেন শিক্ষকরা। এ দুর্ঘটনার শতভাগ দায় স্কুলের প্রিন্সিপালসহ শিক্ষকদের।’
দুপুর ১টা। তখন মাইলস্টোন স্কুলের ক্লাস শেষ হয়েছে। কিন্তু তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস থেকে বের হতে মানা। কারণ, ১০ মিনিট টিফিনের বিরতি দিয়ে শুরু হবে কোচিং ক্লাস। ফলে আগেই টিফিন নিয়ে স্কুলের গেটে হাজির ছিলেন নুসরাতের মা পারুল আক্তার। টিফিনের সময় শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে শ্রেণিকক্ষের সামনে যান তিনি। বাইরে থেকে জানালার গ্রিলের ফাঁকা দিয়ে মেয়ের হাতে টিফিন দেন। এ সময় মেয়েকে পেট ভরে খেতে বলেন।
স্কুল থেকে বের হয়ে দিয়াবাড়ি গোল চত্বর সংলগ্ন বাসায় ফিরছিলেন পারুল আক্তার। হঠাৎ শুনতে পেলেন বিকট বিস্ফোরণের মতো শব্দ। পেছনে তাকিয়ে দেখেন সবাই যে যার মতো দিগি¦দিক দৌড়াচ্ছেন। স্কুলের ভেতর থেকে বের হচ্ছে আগুনের কু-লি ও কালো ধোঁয়া। এমন দৃশ্য দেখে আঁতকে ওঠেন পারুল। হাউ মাউ করে কেঁদে ছুটতে থাকেন মেয়ের স্কুলের দিকে।
স্কুলে ঢুকে পারুল দেখেন, নুসরাতদের শ্রেণিকক্ষের ওপর আছড়ে পড়েছে একটি যুদ্ধবিমান। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কক্ষে আগুন ও কালো ধোঁয়া। আগুনের মধ্যে দিগি¦দিক ছুটছিল শিশু শিক্ষার্থীরা। কিন্তু আগুনের তীব্রতায় কেউই শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হতে পারছিল না। বাইরে থেকেও কারও পক্ষে শ্রেণিকক্ষে ঢোকা সম্ভব ছিল না।
এ সময় স্কুলের আশপাশের লোকজন ও পাশে থাকা সেনাক্যাম্পের সদস্যরা উদ্ধার অভিযানে যোগ দেন। খবর পেয়ে ছুটে আসেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। হতাহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায় সেনাবাহিনী। পরে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) সাদা কাপড়ে মোড়ানো অবস্থায় নুসরাতের মরদেহ পায় তার পরিবার।
বুধবার (২৩ এপ্রিল) দুপুর ১টা। নুসরাত জাহান আনিকার ছবি হাতে নিয়ে নিজ বাড়িতে বিলাপ করছিলেন মা পারুল আক্তার। তাকে সান্ত¡না দিচ্ছিলেন আত্মীয়-স্বজনরা। পাশের একটি সোফায় শুয়ে নীরবে কাঁদছিলেন বাবা মো. আবুল হোসেন।
দরজার গায়ে সাঁটা আছে জন্মদিনের শুভেচ্ছা বার্তা। রঙিন কাগজে ছোট্ট হাতে লেখা ‘শুভ জন্মদিন নুসরাত’। দেওয়ালের কোনায় রাখা স্কুলব্যাগটা এখনো যেমন ছিল, তেমনই। খোলা খাতায় পড়ে আছে হ্যান্ড রাইটিংয়ের অনুশীলন, আর একটা পেন্সিল, যেটা শেষবার ব্যবহার করেছিল মেয়েটি। কিন্তু সেই ঘর, খাতা, উইশ কার্ড-সবই আজ যেন বোবা এক সাক্ষী। ছোট্ট নুসরাত আর নেই।
বিলাপ করতে করতে পারুল আক্তার বলছিলেন, ‘আমি যদি জানতাম ওখানে প্লেন বিধ্বস্ত হবে, ১০ মিনিট আগেই আমি আমার মাকে (মেয়ে) স্কুল থেকে নিয়ে আসতে পারতাম। মেয়েকে খাবার দিয়ে আসার ১০ মিনিট পরে এ ঘটনা ঘটেছে। প্লেনটা আমার মায়ের ক্লাসের ওপরই পড়েছে। দুর্ঘটনার পর আমার মাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করছি, স্কুলে পাইনি। অথচ ১০ মিনিট আগেই মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। মেয়েকে টিফিন দিয়ে আসছি। এটাই ছিল আমার মায়ের সঙ্গে শেষ দেখা।’
পারুল আক্তার বলেন, ‘মেয়েটা আমাকে বলল, ‘মা, আমার জন্য কী খাবার আনছো?’ আমি বলছি, ‘তোমার জন্য অনেক খাবার আনছি। তুমি বসে খাও।’ ম্যাডামরা ক্লাসে ঢুকতে দিলে আমি নিজেই ওরে খাওয়াইয়া আসতাম। ম্যাডামরা বাচ্চাদের বাইরে বের হতে দেন না। পানিও খেতে যেতে দিতেন না।
নুসরাত গরুর মাংস, বিরিয়ানি পছন্দ করতো জানিয়ে পারুল আক্তার বলেন, ‘সব সময় টিফিনে এগুলোই রান্না করে দেই। ওইদিন বাইরের খাবার চেয়েছে। স্কুলের ক্যান্টিন থেকে একটা রোল, বার্গার ও কোক কিনে তাকে দিয়েছি। ক্লাস থেকে বাচ্চাদের বের হতে দেন না শিক্ষকরা। এ জন্য বিদ্যালয়ের বারান্দার গ্রিলের ভেতর দিয়ে মেয়েকে খেতে দিয়েছি। মেয়েকে বলছি, ভেতরে নিয়ে খাও। আমি খাবারটা দিয়ে আসার পর আমার মা তা খাচ্ছিল। আর খাওয়া অবস্থায়ই বিমানটা আছড়ে পড়ে। আমার মা খাবারটাও ঠিক মতো শেষ করতে পারেনি।’
বিমান বিধ্বস্তের সময় ক্লাসের ম্যাডাম ছিল না জানিয়ে পারুল আক্তার বলেন, ‘টিফিনের সময় ম্যাডাম শ্রেণিকক্ষে ছিলেন না। ম্যাডামরা থাকলে হয়তো বাচ্চারা এত ভয় পেত না। সবগুলা বাচ্চা ভয়েই মরে গেছে। আগুনে আমার মেয়ের তেমন ক্ষতি হয়নি। সম্ভবত ভয় ও ধোঁয়ায় মারা গেছে।’
দুর্ঘটনার পর এক শিক্ষকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল পারুল আক্তারের। তখন নিজের মেয়ের খোঁজ চেয়েছিলেন তিনি। পারুল বলেন, ‘আমি ওই শিক্ষককে বলেছি আমার মেয়েকে কেন দেখে রাখেননি? তিনি উত্তর দিলেন, তিনি পাঁচ মিনিটের জন্য হাত-মুখ ধুইতে ওই ভবন থেকে বের হয়েছিলেন। এর মধ্যে এ ঘটনা ঘটছে।’
নুসরাতের মায়ের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন নীরবে কাঁদছিলেন তার বাবা মো. আবুল হোসেন। এ সময় আবুল হোসেন বলেন, ‘আমি বাসা থেকে ঘটনাস্থলে যখন ছুটে যাই, তার আগেই স্কুলের মেইন গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। দূর থেকে দেখেছি গ্রিল কেটে দোতলা থেকে বাচ্চাদের নামাচ্ছিল সেনাবাহিনী। ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভানোর পরে যে যেভাবে পারছে বাচ্চাদের বের করে নিয়েছে।
সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার কিছু শিশুকে সিএমএইচে নিয়ে গেল। আমার মনে হয় তখনই আমার মেয়েটাকে হেলিকপ্টারে করে সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’ উদ্ধার অভিযান শেষে মেয়েকে স্কুলে না পেয়ে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটে বেড়ান আবুল হোসেন। পরে সিএমএইচে গিয়ে মেয়ের মরদেহ পান। বলেন, আমার সঙ্গে আত্মীয়-স্বজন সবাই গেছে। আমি তো মেয়ের বাবা, আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিয়েছে। ভেতরে নিয়ে সাদা কাপড়ে ঢাকা মুখ দেখানো হয়েছে। তখন তারা বলেছে, ‘দেখেন, আপনার মেয়ে কি না।’ আমি তো আমার মেয়েকে দেখে চিনে ফেলেছি।
আমার মেয়ে শুধু ধোঁয়ায় কালো হয়ে মারা গেছে। স্কুলে যাওয়ার আগে চুলগুলো বেনী করা হয়েছিল, সে বেনী অবস্থায়ই আছে। গলায় আইডি কার্ড অক্ষত ছিল, কিছুই হয়নি। পরে সন্ধ্যায় লাশ নিয়ে বাসায় ফিরি। আত্মীয়-স্বজন সবাই খবর পেয়ে ছুটে আসছে। ওরে রাত ১১টার দিকে দাফন করেছি।
মাইলস্টোন স্কুলের ওই ভবনে মাত্র একটা ফটক বা সিঁড়ি ছিল জানিয়ে আবুল হোসেন বলেন, ‘এই স্কুলের ভবনে একটা চিকন গেট ছিল। এই গেট দিয়ে বাচ্চাদের বের করা হতো। কিন্তু এই গেটের সামনে বিমানটা বিধ্বস্ত হয়। এ কারণে ভবনটি থেকে বাচ্চারা সহজে বের হতে পারেনি। আবার ভবনটির এক্সিট গেটও ছিল না। যদি তিন-চার দিক থেকে বাচ্চাগুলো বের হতে পারতো, তাহলে দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও কম হতো।’
মাইলস্টোনের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলক কোচিং ক্লাস করতে হয় জানিয়ে আবুল হোসেন বলেন, ‘ওই স্কুলের স্যাররা কোচিং করতে বাধ্য করেছে। বাচ্চাদের যদি কোচিং না করাই তাহলে পরীক্ষায় কম নম্বর দেয়। ফলে বাধ্যতামূলক কোচিং করতে হয়। কোচিং করানোর জন্য প্রত্যেকটা গার্জিয়ানকে তারা মেসেজ দিছে। খুব চাপের মুখে সবাই বাচ্চাদের কোচিং করাইছে। নাহলে কোনো বাপ-মা চায় না সকাল ৭টায় গিয়ে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বাচ্চা স্কুলে থাকুক। নিয়ম অনুযায়ী যদি ১টায় ছুটি হয়ে যেত সবাই চলে যেত। সবার ছেলেমেয়েই আজ বেঁচে যেত।’
আবুল হোসেন বলেন, ‘দুর্ঘটনার সময় অধিকাংশ বাচ্চাই খাইতেছিল। এ সময় বাচ্চাদের ক্লাসের ভেতরে আটকে রাখেন শিক্ষকরা। এ দুর্ঘটনার শতভাগ দায় স্কুলের প্রিন্সিপালসহ শিক্ষকদের। কোনো স্কুলে যাতে শিশুদের সঙ্গে শিক্ষকরা খারাপ আচরণ না করেন এবং পড়ার নামে যাতে কোনো শিশুকে চাপ দেওয়া না হয়, এ বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে।’
প্যানেল হু