ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ জুলাই ২০২৫, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২

বর্ষার শুরুতেই গড়াইয়ের তাণ্ডবে মানচিত্র থেকে হারাতে বসেছে বড়রিয়া গ্রাম

এম রায়হান, ঝিনাইদহ

প্রকাশিত: ১৭:২৬, ২৩ জুলাই ২০২৫

বর্ষার শুরুতেই গড়াইয়ের তাণ্ডবে মানচিত্র থেকে হারাতে বসেছে বড়রিয়া গ্রাম

ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ।

ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার বড়–রিয়া ও মধ্য পাড়া গ্রাম। এ গ্রামে গেলেই দেখা মেলে নদী পাড়ে বসা ষাটোর্ধ্ব বয়সের বেশকিছু মানুষ। তাদের সকলের চোখে চিন্তার ভাজ। কখন যেন সর্বনাশী গড়াই কেড়ে নেয় শেষ সম্বল ভিটে-বাড়ি। এই মানুষগুলো এরই মধ্যে হারিয়েছে তাদের ফসলি জমি। এখন অন্যের জমিতে কাজ করে চলে সংসার। এদের মধ্যেই একজন জাহাঙ্গীর মন্ডল। তিনি বলেন, আমার ১০ বিঘা ফসলি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। গড়াইয়ের ভাঙনের যে অবস্থা তাতে মনে হয় ভিটেবাড়িও এবছর ঠেকাতে পারবো না। 

বুধবার সরেজমিনে শৈলকুপা উপজেলার বড়রিয় ও মধ্যপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, এসব গ্রামের মানুষগুলোর মত ভাঙন আতঙ্ক গ্রামের বসবাসকারী সকল মানুষের মধ্যে। চলতি বছরের জুন মাসের শুরুর দিকে ভাঙন শুরু হলেও পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে এখন তীব্র আকার ধারণ করেছে। পাট, কলা ক্ষেত, হলুদের জমিসহ ভাঙতে শুরু করেছে ফসলি জমি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ফেলা জিও ব্যাগও ¯্রােতের তীব্রতায় তেমন কাজে আসছে না। অনেক ঘরবাড়িও তীব্র ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে। গ্রামটিতে এক সময় ছিল অসংখ্য মানুষের বসবাস, গড়াই নদীর ভাঙ্গনে এখন পাল্টেছে সেই চিত্র। অনেকেই হারিয়েছেন সহায় সম্বল, হয়েছেন নি:স্ব, ছেড়েছেন গ্রাম। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যে, ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলায় গড়াই নদীর বহমান অংশ ২০ কিলোমিটার। যার মধ্যে বড়–রিয়া গ্রামে ১.৫০, কৃষ্ণনগরে ১ কিলোমিটার, গোসাইডাঙ্গা ৫০০ মিটার, মাদলা এলাকায় ১.৫০, মাঝদিয়াতে ১ কিলোমিটার এবং লাঙ্গলবাধ এলাকায় ৫০০ মিটারসহ মোট  ৬ কিলোমিটার ভাঙ্গনপ্রবন।  তবে বেশী ভাঙন তীব্রতা বড়–রিয়া গ্রামের দেড় কিলোমিটার অংশে। কোথাও বেশী, কোথাও কম, সেই হিসাবে প্রতি বছর গড়ে ৫ মিটার অর্থাৎ ১৫ ফিট নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে। 

তবে স্থানীয়রা বলছে আরো বেশি পরিমাণ জমি ভেঙে যাচ্ছে। ১৯৬২ সালের পর থেকে ভাঙন থাকলেও গেল ২০ বছরে তীব্রতা বেড়েছে কয়েকগুণ। সিএস রেকর্ড অনুযায়ী, ১৪ শ’ ৫৭ বিঘা ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং ১৪৩ বিঘা সরকারি খাস জমি বড়–রিয়া মৌজায়। এখন তা দাড়িয়েছে গড়ে ২ শ’ ৫০ বিঘায়। গ্রামটিতে বসতিও ছিল আনুমানিক ৭শ’ পরিবারের কিন্তু অনেকেই অন্যত্র বসতি স্থাপন করেছেন। এখন প্রায় ২শ’ পরিবারের বসতি রয়েছে দাবি স্থানীয়দের। 

নদীর ওপারে কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার গনেশপুর আদর্শ গ্রাম। এপারের জমি ভেঙে ওপাশে জেগে ওঠা চরের জমিতে কুষ্টিয়ার মানুষ যেতে দেয় না, অভিযোগ স্থানীয়দের। আবার চর উদ্ধারেও কেউ ব্যবস্থা নেয় না। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে ২০১৯ ও ২০২১ সালে ডিপিপি প্রকল্প, পরিকল্পনা কমিশনে দাখিল করা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। চলতি বছরে গড়াইয়ের ভাঙন রোধে অস্থায়ী ভিত্তিতে সমীক্ষা কাজের আওতায় ১৭৫ কেজি ওজনের বালি ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। ১ জুন থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পটি শেষ হবে ২০২৬ সালের জুন মাসে। ১৩ কোটি টাকা’র এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে ৪ টি ধাপে। 

বড়–রিয়া গ্রামের বাসিন্দা সুন্দরী খাতুন বলেন, আমাদের প্রায় ৩০ বিঘা জমি ছিল, এখন তা ১০ বিঘায় দাড়িয়েছে। গ্রামের বাসিন্দা মনি মোল্লা বলেন, গ্রামের প্রায় ১৪ শ’ বিঘা জমি চলে গেছে কুষ্টিয়া অংশে। 

বড়–রিয়া গ্রামের বাসিন্দা বাবুল মোল্লা বলেন, এপাশ থেকে ভেঙে নদীর ওপারে চর জেগে উঠেছে। সেখানে কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার মানুষ জবরদখল করে খাচ্ছে। সেখানে খোকসার মানুষ আমাদের যেতে দেয়না আবার প্রশাসনের কেউ উদ্যোগ নেয় না এই জমি উদ্ধারে। ক্রমেই আমরা নিঃস্ব হচ্ছি সম্বল হারিয়ে। 

গ্রামের মোমেনা খাতুন এক ছেলেকে নিয়ে থাকেন গড়াই পাড়ে পিতার জমিতে। বলেন, আমাদের বাড়ি ছিল নদীর ওপারে। ভাঙার কারণে এখন এপাশে চলে আসছি। এটাও এবছর থাকবে কি না জানিনা। অন্য কোথাও বাড়ি করবো সে জমিও নেই। গ্রামের মানুষের কষ্টের কথা ভেবে সরকার যেন ভাঙন রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা নেয় এটাই আমাদের প্রত্যাশা। 

ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রঞ্জন কুমার দাস বলেন, বর্তমানে বর্ষার শুরুতে ভাঙন রোধে অস্থায়ী সমীক্ষা কাজ চলমান আছে। আগামী বছরের জুন মাস পর্যন্ত কয়েকটি ধাপে কাজটি চলবে। এরপর স্থায়ী কাজ করা হবে বরাদ্দের ভিত্তিতে। নদীর এই অংশটুকু অবতল হওয়াতে পানির চাপ বৃদ্ধিতে পলি সরে ভাঙন দেখা দেয়। তবে জমি উদ্ধারের বিষয়টি জেলা প্রশাসনের বলেও জানান তিনি। 

শৈলকুপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্নিগ্ধা দাস জানান, নদীর সীমানা নির্ধারণে জেলা প্রশাসক বরাবর পত্র পাঠানো হয়েছে। 

ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আওয়াল বলেন, আমাদের অংশ ভেঙে গিয়ে নদীর ওপারে কুষ্টিয়া অংশে জেগে ওঠা চরের জমি উদ্ধার ও সেখানে যেন শৈলকুপার মানুষ চাষাবাদ করতে পারে তা নিয়ে এরই মধ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন ও অন্যান্য দপ্তরের সম্মিলিত বৈঠকের পর জরিপ করে সীমানা নির্ধারণের জন্য সরকারের জরিপ অধিদপ্তরে পত্র পাঠিয়েছি। আশা করি সরকার দ্রুতই বিধিসম্মতভাবে উদ্যোগ নেবেন আর তখন নদী পাড়ের সমস্যা থাকবে না বলে তিনি জানান। 

মিরাজ খান

×