
ছবি: প্রতীকী
ঘুম শুধু বিশ্রাম নয়, এটা আমাদের শরীর ও মস্তিষ্কের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কাজগুলোর একটি। প্রতিদিন অন্তত ৬-৮ ঘণ্টা ভালোভাবে ঘুম না হলে আমাদের ব্রেন ধীরে ধীরে নিজের ওপরেই আঘাত করতে শুরু করে। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন—যদি নিয়মিত ঘুম ঠিক না থাকে, তাহলে আপনার মস্তিষ্ক নিজেই নিজের ক্ষতি করতে শুরু করে।
ঘুমের সময় আমাদের ব্রেন নিজের ভেতরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ চালায়। সারা দিন আমরা যে সব চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও তথ্য গ্রহণ করি, তার একটা বড় অংশ এই ঘুমের সময়ই সংগঠিত হয়, সাজানো হয়, অপ্রয়োজনীয় অংশ মুছে ফেলা হয়। আর এই কাজটি করতে গিয়ে মস্তিষ্ক গ্লাইল সিস্টেম নামের একটি প্রক্রিয়ার সাহায্যে বিষাক্ত বর্জ্য ও অপ্রয়োজনীয় তথ্য বের করে দেয়। কিন্তু যদি ঘুম ঠিকভাবে না হয়, তাহলে এই প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হয় এবং সেই বিষাক্ত বর্জ্য মস্তিষ্কেই থেকে যায়। ফলে তা ধীরে ধীরে ব্রেনের কোষ নষ্ট করতে শুরু করে।
ঘুমের অভাবে আমাদের ব্রেনের স্নায়ু কোষ বা নিউরনের মধ্যে সংযোগ দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে মেমোরি সমস্যা, মনোযোগের অভাব, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস এবং মানসিক স্থিতি হারিয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। আপনি হয়তো দেখবেন, এক রাত ভালো ঘুম না হলে পরদিন সকালে আপনি ঝিমিয়ে পড়ছেন, মনোযোগ ধরে রাখতে পারছেন না, খিটখিটে মেজাজে আছেন। এখন ভাবুন যদি প্রতিদিনই এমন হয়, তাহলে আপনার ব্রেন কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আরও ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, গবেষণায় দেখা গেছে—যারা দীর্ঘ সময় ধরে ঘুমের অভাবে ভোগেন, তাদের ব্রেনে এক ধরনের প্রোটিন জমে, যাকে বলে “অ্যামিলয়েড বিটা।” এই প্রোটিনই আলঝেইমার রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। ব্রেনের ভেতরে এটি জমে গিয়ে স্মৃতিশক্তি নষ্ট করে দেয় এবং ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে মানসিকভাবে অসাড় করে তোলে।
এছাড়া ঘুম ঠিক না থাকলে ব্রেনের হিপোক্যাম্পাস নামক অংশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অংশটি মূলত আমাদের শেখার ক্ষমতা ও স্মৃতি সংরক্ষণের কাজে নিয়োজিত। যখন আমরা ভালোভাবে ঘুমাই, তখন হিপোক্যাম্পাস নতুন তথ্য গ্রহণে প্রস্তুত হয়। কিন্তু ঘুমের ঘাটতি হলে এটি ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে আপনি যেটা শিখছেন বা পড়ছেন, তা সহজে মনে রাখতে পারছেন না।
মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকেও পর্যাপ্ত ঘুম না থাকা ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনে। ঘুমের অভাব সরাসরি হতাশা, উদ্বেগ এবং মানসিক চাপের সঙ্গে যুক্ত। আপনি যদি নিয়মিত কম ঘুমান, তাহলে মন খারাপ লাগা, বিষণ্নতা এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা বাড়তে থাকবে। ধীরে ধীরে আপনি নিজেই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবেন।
শুধু মস্তিষ্ক নয়, ঘুম কম হলে আমাদের শরীরও ভেঙে পড়ে। হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ওজন বৃদ্ধি—সবকিছুর পেছনে একটি বড় কারণ হতে পারে ঘুমের অভাব। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতি হয় মস্তিষ্কের। কারণ ব্রেন যদি ঠিকমতো না চলে, তাহলে আমাদের শরীরের আর কোনো অঙ্গই সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না।
তাই ঘুমকে অবহেলা করার সময় আর নেই। মোবাইল, টিভি, সোশ্যাল মিডিয়া, কাজের চাপ বা রাত জাগা আড্ডা—এসবকে বাদ দিয়ে ঘুমকে অগ্রাধিকার দিন। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যান, আর সকালেও নির্দিষ্ট সময়ে উঠুন। ঘুমানোর আগে ক্যাফেইন, মোবাইল স্ক্রিন ও অতিরিক্ত আলো এড়িয়ে চলুন। এমনকি প্রয়োজনে মেডিটেশন, হালকা ব্যায়াম বা বই পড়ার অভ্যাস করুন—যাতে আপনার ঘুম সহজে আসে।
মনে রাখবেন, ঘুম কোনো বিলাসিতা নয়, এটি একটি দৈনিক প্রয়োজন। ঘুম ঠিক না থাকলে আপনার ব্রেন ধীরে ধীরে নিজেই নিজের বিরুদ্ধাচরণ শুরু করবে। সময় থাকতে সচেতন হোন। কারণ, একবার যদি ব্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন তা ফিরিয়ে আনা খুবই কঠিন। ভালো ঘুম মানেই ভালো জীবন।
এম.কে.