
শরীয়তপুর জেলার শরীয়তপুর সদর উপজেলার রুদ্রকার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বাজারে ঐতিহ্যবাহী বুড়িরহাট ঐতিহাসিক জামে মসজিদ। ১৯০৭ সালে নির্মাণ করা হয় বলে স্থানীয় বাসিন্দা ও মসজিদের ইতিহাস থেকে জানা যায়।
দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনাটির পেছনে আছে কিছু নিবেদিত ধর্মপ্রাণ মানুষের অবদান। তাদের কেউ বেঁচে না থাকলেও নির্মিত চমৎকার স্থাপনাটি টিকে আছে এখনো। ইংল্যান্ডের সিমেন্ট ও কলকাতা থেকে আনা বিভিন্ন পাথর দিয়ে কারুকাজ করা মসজিদটি দেখতে পর্যটকরাও আসেন।
যখন বঙ্গভঙ্গ হয়, তখন ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদটি গোলপাতা দিয়ে তৈরি করা হয়। ১৯০৭ সালে তৎকালীন ধনাঢ্য ও ধর্মনুরাগী একাব্বর হোসেন হাওলাদার এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে বুড়িরহাট গ্রামে ছন ও গোলপাতা দিয়ে ছোট্ট একটি মসজিদ বানানো হয়। এর কয়েক বছর পর একাব্বর হোসেন হাওলাদারের ছেলে মরহুম মমতাজ উদ্দিন হাওলাদার টিনের ঘর দিয়ে মসজিদ বানান।
কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদের আদলে এর নকশা করা হয়। ৫ একর জমির ওপর নির্মিত মসজিদের দৈর্ঘ্য ২৫০ ফুট ও প্রস্থ ১২০ ফুট। দেয়াল ৩ ফুটেরও বেশি পুরু। ভেতরের দেয়ালে সিরামিক খণ্ড দিয়ে লতাপাতা আঁকা অসংখ্য রঙিন নকশা রয়েছে। বাইরের দিকে আছে সিমেন্ট ও সিরামিকের টেরাকোটা নকশা।
মূল মসজিদ প্রায় ৫ কাঠা জমির ওপর অবস্থিত। সংস্কারের আগে এটি ছিল আয়তকার। তখন এর দৈর্ঘ্য ছিল ৫০ ফুট এবং প্রস্থ ছিল ৩০ ফুট। কিন্তু সংস্কারের পর মসজিদের আকার রীতিমতো পরিবর্তিত হয়ে যায়।বর্তমানে এটি একটি বর্গাকৃতির এবং সাধারণ ৩০ গম্বুজবিশিষ্ট আয়তকার মোঘল মসজিদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। সংস্কারের পর মসজিদের চাকচিক্য ও সৌন্দর্য অনেক বেড়েছে।
গ্রামের মানুষের নামাজ আদায়ে জায়গা হচ্ছিল না। তাই উত্তর-পূর্ব পাশে বাড়ানো হচ্ছে। এখন চলছে ৩০টি গম্বুজের কাজ। মূল প্রবেশপথ দুটি। এখন একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন এক হাজার মুসল্লি। ওয়াকফকৃত সম্পত্তিতেই মসজিদ স্থাপিত। পাশে ঈদগাহ। পশ্চিমে মার্কেট। পূর্বপাশে ইমামের থাকার ব্যবস্থা ও মিনার। বিদ্যুৎ চলে গেলে আছে জেনারেটর।
স্থানীয় বয়স্কদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বুড়িরহাট এলাকার মুসলমানরা শিক্ষায় অনগ্রসর ছিল। কিছু সম্ভ্রান্ত পরিবার ছাড়া বাকিরা পড়াশোনা করেনি। এ সময় একাব্বর হোসেন হাওলাদার বুড়িরহাটের এই জায়গায় একটি গাছের নিচে বসে ইবাদত করতেন। কয়েক বছর পর তিনি এলাকার বিশিষ্ট কয়েকজনকে নিয়ে একটি ছনের ঘর তৈরি করে নামাজ ও কুরআন শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। তার ছেলে মরহুম মমতাজ উদ্দিন হাওলাদার একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ার চিন্তা করেন। কিন্তু তার ছিল না জমি বা অর্থ।
স্থানীয় অনেকে জানান, টিনের ঘরের একটি মসজিদ ছিল ১৯১০ সাল পর্যন্ত। এরপর সেটা পাকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৩৫ সালে তা পরিপূর্ণ রূপ পায়। তখন যে কয়েকজন ব্যক্তি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম মরহুম মমতাজ উদ্দিন হাওলাদার, মরহুম মন্তাজ উদ্দিন মুন্সী ও আফতাব উদ্দিন মুন্সী।
শরীয়তপুর চন্দনকর মৌজায় বুড়িরহাট বাজারের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানার শেষ প্রান্তে এই মসজিদ। এর দক্ষিণ পাশের খালের অস্তিত্ব এখন আর নেই। দান করা কিছু জমি ও খালে তৈরি হয়েছে মসজিদের পুকুর।
নকশা করেন প্রকৌশলী মরহুম আফতাব উদ্দিন মুন্সী। তিনি নির্মাণকাজে বিভিন্ন ধরনের পাথর ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী কলকাতা থেকে কিনে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। সিমেন্ট সরবরাহ করা হয় ইংল্যান্ড থেকে। কারুকাজের জন্য কারিগর আনা হয় চাঁদপুর থেকে। তাদের কাজ দেখে উদ্যোক্তাদের উৎসাহ আরও বাড়ে। এরপরই বাড়তে থাকে সহযোগিতা।
আশির দশকে নির্মাণ হয় মসজিদের মিনার। এটি তৈরি করতে বিরতিহীনভাবে ১০ জন মিস্ত্রির সময় লেগেছে দেড় বছর। বিভিন্ন সময়ে ধর্মপ্রাণ মানুষ ও পথচারীরা মসজিদের সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে থমকে দাঁড়ান।
রাজু