ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৫ জুলাই ২০২৫, ১০ শ্রাবণ ১৪৩২

তুরাগ নদীতে মিলছে না দেশীয় প্রজাতির মাছের দেখা

রাজু আহমেদ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ০৮:১৮, ২৪ জুলাই ২০২৫

তুরাগ নদীতে মিলছে না দেশীয় প্রজাতির মাছের দেখা

ছবি: জনকণ্ঠ

কি কমু? আমরা বাঙালিরা অহনে আর "মাছে ভাতে বাঙালি" নাই! আগে তো নদী-খালে-বিলে জাউলাগিরি (জেলেগিরি) কইরাই খাইছি। তুরাগ নদীতে মাছ ধইরাই পরিবার চালাইছি। তহন পরিবারের খাওনের লেইগা বউ-পোলাপাইনের পছন্দমত যথেষ্ট পরিমাণে রাইখাও বাকি মাছ বেইচ্যা কি শান্তি-সুন্দর হালেই না সংসার চালাইছি! নদীর দেশি মাছ কিন্না লওনের লেইগা এক-আধ সপ্তাহ আগেই ঢাকা শহরের বড় বড় স্যারেরা অগ্রিম ট্যাকা-পয়সা দিয়া যাইতো। পরে সেই কাকডাকা ভোরে দামি দামি গাড়ি চইড়া আইসা মাছ লইয়া যাইতো। অহনে তো নদীতে জাল ফালাইয়া সারাদিন টাইন্যা নিজেরাই একবেলা মাছ-ভাত খাইতে কষ্ট অহে বেইচুম তো দূরের কথা! ছোটবেলা থেইকা জাউলাগিরি ছাড়া অন্য কোনো কাজ-কাম তো শিখীনাইক্কা। নদীতে আগের মতো মাছও পাওন যায় না। কি আর করুম? সংসার, বউ-পোলাপাইন লইয়া অন্ততপক্ষে তিনবেলা ডাইল-ভাত খাইতে তো হইবো? তাই জাউলাগিরি বাদ দিয়া অহনে অটোরিকশা চালাই।

নিজের আঞ্চলিক ভাষায় প্রচণ্ড আক্ষেপের সুরে ঠিক এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন, রাজধানীর দ্বীপখ্যাত তুরাগ নদী বেষ্টিত মিরপুরের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের এক বাসিন্দা।

একজন জেলের পেশাদারিত্বের ক্ষেত্র হারানোর আক্ষেপে পরিপূর্ণ তার বক্তব্যে হয়তো নিজের রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কে জানে, হয়তো সহজ-সরল এই মানুষটির সাবলীলভাবে উচ্চারিত সাধারণ বাক্যগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাঙালি জাতির জন্যে অত্যন্ত গুরুত্ববাহী কোনো বিশেষ বার্তা বা ভবিষ্যৎবাণী।

তার ভাষ্যমতে, রাজধানীর কোল ঘেঁষে বয়ে চলা, দেশীয় অসংখ্য প্রজাতির মাছের অকৃত্রিম ভাণ্ডার খ্যাত তুরাগ নদী। এক সময়ের প্রমত্তা তুরাগ নদীতে আর দেখা মিলছে না সেই দেশীয় প্রজাতির মাছের। নজরদারির অভাব, দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটাপন্ন নদীটির সাথে সাথে আজ চিরতরে বিলুপ্তির পথে দেশীয় নানা প্রজাতির মাছ।

স্থানীয়রা বলছেন, যেখানে আগে জাল ফেলেই পাওয়া যেত চোখ জুড়ানো, সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ আজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা জাল ফেলে টানলেও আর অতীতের মতো দেশীয় মাছের দেখা মেলে না এ নদীটিতে।

শোল, টাকি, কই, রয়না, চিংড়ি, বাইন, গুতুম, পুঁটি, টাটকিনি, পাবদা, খলিশা, টেংরা, শিং, মাগুর, বোয়াল, চিতল কিংবা সরপুঁটির ভাণ্ডার খ্যাত নদীটিতে আগের মতো মাছগুলো এখন যেন কেবল স্মৃতির পাতায়।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত বাংলাদেশের খ্যাতি গোটা বিশ্বব্যাপী। মাছে ভাতে বাঙালি, নদীমাতৃক ও কৃষিপ্রধান দেশ বাংলাদেশ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, বুড়িগঙ্গার মতো প্রধান নদীর সাথে সাথে শাখা নদীগুলোসহ দেশের ১ হাজার ৩শ’টি নদীর মধ্যে অন্যতম এ তুরাগ নদী।

দেশের বিখ্যাত জেলা জামালপুরের দীঘলাবন্দ অঞ্চলে এ নদীর উৎপত্তিস্থল। জামালপুর থেকে টাঙ্গাইল ও গাজীপুর অতিক্রম করে টঙ্গী, আশুলিয়া, ঢাকার মিরপুর, গাবতলী-আমিনবাজার ব্রিজ হয়ে পুরোনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বুড়িগঙ্গা নদীতে মিশেছে।

ঢাকার উত্তরের প্রাণতরী, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই নদীটি একসময় ছিল নৌপরিবহন, মাছ ধরা সহ ঢাকার আশপাশের বাসিন্দাদের জীবিকার উৎস। অসংখ্য প্রজাতির দেশীয় মাছ ও জলজ প্রাণীতে সমৃদ্ধ ছিল নদীটি। মেলে ধরেছিল দেশীয় জীববৈচিত্র্যের বিশাল সম্ভার। স্থানীয় কৃষি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও নদীটির ভূমিকা অনস্বীকার্য।

পাশাপাশি টঙ্গীর তুরাগ তীরে মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সম্মেলন 'বিশ্ব ইজতেমা' অনুষ্ঠিত হওয়ায় গোটা বিশ্বে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক, ঐতিহ্যগত দিক থেকেও নদীটির পরিচিতি এবং গুরুত্ব অপরিসীম।

মিরপুরের স্থানীয় একজন বাসিন্দা বলেন, আগে নিজের সারাদিনের কাজকর্ম শেষে সন্ধ্যা বেলায় ছেলে-মেয়ে নিয়ে তুরাগ নদীতে জাল-দুয়ারি পেতে এসে ভোর হওয়ার অপেক্ষায় থাকতাম। খুব ভোরে গিয়ে পানি থেকে সেই জাল-দুয়ারি তুলতেই আটকা পড়া দেশীয় প্রজাতির মাছ দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যেতো। ছেলে-মেয়েরা সেই মাছ নিয়ে খুশিতে নাচানাচি করতো। শখ পূরণের সাথে চাহিদাও মিটতো।

স্থানীয় আরও এক বাসিন্দা বলেন, তুরাগ নদীর তীর ঘেঁষে একসময় লাইন ধরে বিভিন্ন ধরনের বড়শি পেতে উৎসবমুখর পরিবেশে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা চোখে পড়তো। কারো ছিপে যেকোনো মাছ ধরা পড়লেই হৈ-হুল্লোড় করতাম। এখন আর সেই সুযোগ-পরিবেশ নেই।

গাবতলীর স্থানীয় একজন বাসিন্দা বলেন, এক ভোরে যখন মর্নিং ওয়াকে হাঁটতে বেরোতাম, পকেটে টাকা নিয়ে বের হতাম। কাকডাকা ভোরে জেলেরা মাটিতে কলাপাতা বিছিয়ে ছোট ছোট ঝুড়ি, গামলা, প্লেটে বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ সাজিয়ে নদীর পারে রাস্তায় বসতেন। হাঁটাহাটির এক পর্যায়ে বাসায় ফেরার সময় মাছ কিনে নিয়ে আসতাম। এখন আর সেই চিত্র চোখে পড়ে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কালের বিবর্তনে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী তুরাগ নদী এখন শুধুই জলরাশির নাম নয়, এক বিপন্ন নদীর করুণ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। তুরাগ নদী যেন হারিয়ে ফেলছে তার জীবনীশক্তি। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে পানির গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে, যা মাছের প্রজনন ও বংশবিস্তারে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, শুধু জেলেদের জীবিকা নয়, তুরাগ নদীর সাথে জড়িত রয়েছে দেশের পরিবেশ ও জলজ সম্পদের বিরাট একাংশের ভবিষ্যৎ। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে অদূর ভবিষ্যতে পরিবেশগত বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।

অন্যদিকে, স্থানীয় প্রশাসন বলছে, দখল ও দূষণ প্রতিরোধে অভিযান চলমান রয়েছে। তবে বাস্তব চিত্র বলছে অন্য কথা—নদীর বুক জুড়ে এখনো চলছে বালু ভরাট, গড়ে উঠছে অবৈধ স্থাপনা।

নদীতীরবর্তী বিশাল অঞ্চলবাসীর দাবি, ইটভাটা, পরিত্যক্ত প্লাস্টিক, রাসায়নিক, শিল্পবর্জ্যে দূষণে নদীর পানি ঘোলা ও প্রাণহীন। হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্য ও জীববৈচিত্র্য। যা দেশীয় প্রজাতির মাছের জীবনধারণ, প্রজনন ও বংশবিস্তারে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে নদীটিতে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির মাছ অদূর ভবিষ্যতে চিরতরে বিলুপ্ত হবে। সেই সাথে আজকের তুরাগ নদী আগামীতে ইতিহাসের পাতাতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে। একদিন এই নদী হয়তো মানচিত্রেই থাকবে না।

মুমু ২

×