
ছবিঃ সংগৃহীত
অনেকেই ভাবেন স্ট্রোক শুরু হয় হঠাৎ জ্ঞান হারানো, মুখ বেঁকে যাওয়া বা অস্পষ্ট কথা বলার মতো নাটকীয় উপসর্গ দিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, স্ট্রোকের প্রথম দিকের লক্ষণগুলো এতটাই সূক্ষ্ম ও সাধারণ যে বেশিরভাগ মানুষ সেগুলোকে অবহেলা করেন। কেউ ক্লান্তি বলে মনে করেন, কেউ বয়সজনিত সমস্যা ভেবে চুপ থাকেন। অথচ এই উপসর্গগুলো আগেভাগে চিনতে পারলে প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব — এমনকি স্থায়ী শারীরিক ক্ষতিও এড়ানো যায়।
বিশ্ব স্ট্রোক সংস্থার (World Stroke Organization) ২০২৫ সালের গ্লোবাল স্ট্রোক ফ্যাক্ট শিট অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ১.২ কোটি নতুন স্ট্রোক ঘটে। গড় হিসাবে প্রতি ২.৬ সেকেন্ডে একজন নতুন স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই সময় থাকতে সচেতন হওয়া খুবই জরুরি।
চলুন জেনে নিই সেই ৭টি উপসর্গ যা অনেকেই সাধারণ মনে করলেও, আসলে তা হতে পারে স্ট্রোকের প্রথম সংকেত:
১. মুখ বা শরীরের এক পাশে হঠাৎ অবশ বা ঝিনঝিনে অনুভূতি
হঠাৎ করে মুখ, হাত বা পায়ের এক পাশে অবশ হয়ে যাওয়া বা 'পিন-চुभছে' অনুভব হওয়া — স্ট্রোকের একটি ক্লাসিক লক্ষণ। অনেকে একে ‘হাত ঘুমিয়ে গেছে’ ভেবে ভুল করেন। তবে এই অনুভূতি যদি দ্রুত না সারে এবং একপাশে হয়, তাহলে সতর্ক হওয়া জরুরি। কারণ এটা সেই মস্তিষ্কের অংশে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হওয়ার ইঙ্গিত দিতে পারে, যেটা অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে।
২. হঠাৎ বিভ্রান্তি বা কথা বলায় সমস্যা
যদি আপনি বা আপনার আশেপাশের কেউ হঠাৎ বিভ্রান্ত হয়ে যান বা ঠিকভাবে কথা বলতে না পারেন — তাহলে সেটা শুধু "ব্রেইন ফগ" নয়, বরং হতে পারে স্ট্রোকের লক্ষণ। কারণ স্ট্রোক মস্তিষ্কের ভাষা-সম্পর্কিত অংশ (যেমন ব্রোকা বা ওয়েনিকি এরিয়া) প্রভাবিত করে।
৩. এক বা দুই চোখে হঠাৎ দৃষ্টিহানি বা ঝাপসা দেখা
অনেকেই মনে করেন চোখ ঝাপসা দেখলে তা হয়তো বেশি সময় স্ক্রিন দেখার ফল। কিন্তু হঠাৎ করে এক চোখে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যাওয়া বা দৃষ্টির ঘোলা হয়ে যাওয়া হতে পারে স্ট্রোকের আগাম বার্তা — বিশেষ করে যদি তা ব্যথাহীনভাবে ঘটে।
এক গবেষণায় (The Vision In Stroke) দেখা গেছে, স্ট্রোকে আক্রান্ত ৮৪% রোগীর দৃষ্টিজনিত সমস্যা ছিল — যার মধ্যে দৃষ্টিক্ষেত্র হারানো, ঝাপসা দেখা, পড়তে অসুবিধা এবং ডাবল ভিশন ছিল সাধারণ অভিযোগ। গবেষণাটিতে ৯১৫ জন রোগীকে স্ট্রোকের ২২ দিন পর পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল।
৪. হঠাৎ মাথা ঘোরা বা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা
হঠাৎ করে মাথা ঘোরা বা ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়াকে অনেকে "কানের সমস্যা" বা "চাপের কারণে" বলে উড়িয়ে দেন। কিন্তু এটি স্ট্রোকের সূচনালগ্নের একটি পরিচিত উপসর্গ হতে পারে — বিশেষ করে যদি এটি মস্তিষ্কের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রক অংশ (সেরিবেলাম) ক্ষতিগ্রস্ত করে।
৫. তীব্র ও হঠাৎ মাথাব্যথা
আমাদের অনেকেরই মাথাব্যথা হয় — কখনও পানিশূন্যতা, কখনও দুশ্চিন্তা বা নিদ্রাহীনতা থেকে। কিন্তু হঠাৎ করে খুব তীব্র, ঝাঁকুনির মতো মাথাব্যথা শুরু হলে, বিশেষ করে যদি আপনি মাইগ্রেনপ্রবণ না হন, তাহলে সতর্ক হওয়া উচিত। কারণ এটি হতে পারে হেমোরেজিক স্ট্রোক — যেখানে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয় এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসা প্রয়োজন।
৬. হঠাৎ অসামঞ্জস্যতা বা হাত থেকে জিনিস পড়ে যাওয়া
হঠাৎ ভারসাম্যহীনতা, জিনিস হাত থেকে পড়ে যাওয়া বা হোঁচট খাওয়া — যদি নিয়মিত ক্লান্তির কারণ না হয়, তাহলে তা স্ট্রোকের ইঙ্গিত হতে পারে। কারণ স্ট্রোক মটর কর্টেক্স বা সেরিবেলাম–এর কার্যক্রমে বাধা দিতে পারে, যা আমাদের চলাফেরা ও সমন্বয় নিয়ন্ত্রণ করে।
৭. হঠাৎ অস্বাভাবিক ক্লান্তি বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
ঘুমিয়েও ক্লান্তিভাব কাটছে না? হালকা মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম? অনেকেই একে সাধারণ ক্লান্তি ভেবে এড়িয়ে যান। কিন্তু এ ধরনের ক্লান্তি মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাওয়ার লক্ষণ হতে পারে। উপরের যেকোনো উপসর্গের সঙ্গে এই ক্লান্তি দেখা দিলে অবহেলা করবেন না।
✅ বাঁচতে হলে সচেতন হোন
স্ট্রোকের ক্ষেত্রে সময়ই জীবন। যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু হবে, তত দ্রুত পুনরুদ্ধার সম্ভব। তাই উপরের উপসর্গগুলোর যেকোনো একটি দেখা দিলেই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
মনে রাখবেন, স্ট্রোক সবসময় মুখ বাঁকা বা কথা জড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়—অনেক সময় তা শুরু হয় একদম নীরবে, আমাদের অজান্তেই!
ইমরান