
ছবি: প্রতীকী
আজকালকার দিনে অনেকেই ঘুম থেকে উঠেই প্রথম যে কাজটি করেন, তা হলো মোবাইল ফোনে চোখ রাখা। কেউ দেখে মেসেজ, কেউ সোশ্যাল মিডিয়া, কেউ আবার ইমেইল বা খবর। এটি যেন একটি স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই অভ্যাস যে আমাদের শরীর ও মনের ওপর কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তা আমরা অনেকেই জানি না কিংবা গুরুত্ব দিই না।
ঘুম থেকে উঠার পর আমাদের শরীর ও মস্তিষ্ক একটি বিশেষ ধরণের অবস্থায় থাকে। তখন আমাদের ব্রেইনের তরঙ্গ ধীরে ধীরে রিল্যাক্স থেকে সক্রিয় অবস্থায় যায়। এই সময়টিকে বলে "হাইপনোগগিক স্টেট", যা খুবই সংবেদনশীল সময়। এই মুহূর্তে যদি আমরা হঠাৎ করে মোবাইল ফোনের মতো একটি ডিজিটাল স্ক্রিনে চোখ রাখি, তাহলে আমাদের মস্তিষ্কের ওপর চাপ পড়ে।
ঘুম থেকে উঠেই ফোন চেক করার ফলে আমাদের ব্রেইন হঠাৎ করে প্রচুর তথ্যের মুখোমুখি হয়—বার্তা, নোটিফিকেশন, ছবি, ভিডিও, খবর ইত্যাদি। এতে মস্তিষ্ক অপ্রস্তুত অবস্থায় একসঙ্গে অনেক কিছু প্রসেস করার চেষ্টা করে, যার ফলে চিন্তার গতি বিভ্রান্ত হয়, মন অস্থির হয়ে পড়ে এবং মনোযোগের অভাব দেখা দেয়।
আরও খারাপ হয় যখন ঘুম থেকে উঠেই আমরা নেতিবাচক কোনো খবর বা বিরক্তিকর মেসেজ দেখি। এতে করে সারা দিনের মন-মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। একে বলে "ডুম স্ক্রলিং" বা নেতিবাচক কনটেন্টে আটকে যাওয়ার অভ্যাস, যা মস্তিষ্কে উদ্বেগ তৈরি করে এবং কর্টিসল নামক স্ট্রেস হরমোন বাড়িয়ে দেয়।
মোবাইল ফোনের আলো, বিশেষ করে নীল আলো (ব্লু লাইট), ঘুম থেকে উঠার পর চোখের পক্ষে ক্ষতিকর। এটি চোখে চাপ তৈরি করে এবং দিনের শুরুতেই মাথাব্যথা বা চোখের ক্লান্তির কারণ হতে পারে। সেই সঙ্গে এটি সার্কাডিয়ান রিদম বা ঘুম-জাগরণ চক্রকে ব্যাহত করতে পারে।
ঘুম থেকে উঠার পর মস্তিষ্ককে ধীরে ধীরে সজাগ হতে দেওয়া উচিত। কিছু সময় চোখ বন্ধ করে থাকা, হালকা স্ট্রেচিং, ধ্যান, কিংবা শুধু বিছানায় বসে থাকা—এই সবকিছুই আমাদের মস্তিষ্ককে ধীরে ধীরে সক্রিয় হতে সাহায্য করে। এই প্রক্রিয়ায় মন ও শরীর দুটোই দিনের কাজের জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু ফোনে চোখ রাখলে সেই প্রাকৃতিক রিদম নষ্ট হয়ে যায়।
অনেকেই মনে করেন, ঘুম থেকে উঠেই ফোন দেখলে সময় বাঁচে, কিংবা এটি তাদের রুটিনের অংশ। কিন্তু বাস্তবে এটি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অভ্যাস। এতে করে কাজের প্রতি আগ্রহ কমে যায়, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দুর্বল হয় এবং একধরনের ক্লান্তি দিনভর লেগে থাকে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফোন চেক করেন, তাদের মধ্যে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা অনেক বেশি থাকে। তারা সারাদিন ছটফট করেন, মনঃসংযোগে সমস্যা হয় এবং প্রোডাক্টিভিটি কমে যায়। অন্যদিকে যারা ধীরে ধীরে দিন শুরু করেন, তারা অনেক বেশি প্রশান্ত ও স্থির থাকেন।
এই অভ্যাস পরিবর্তন করা কঠিন মনে হলেও একেবারে অসম্ভব নয়। সকালে উঠে ৩০ মিনিট বা ১ ঘণ্টা ফোন থেকে দূরে থাকা, এক কাপ গরম চা বা পানি খাওয়া, হালকা ব্যায়াম বা পছন্দের কোনো বই পড়া— এইসব ছোট পরিবর্তন মস্তিষ্ককে স্বস্তি দেয় এবং শরীরকে ভালো রাখে।
আমাদের মস্তিষ্ক একটি সংবেদনশীল যন্ত্র। সেটিকে সকালে জোর করে সচল করার চেয়ে ধীরে ধীরে জাগিয়ে তোলাই উত্তম। ঘুম থেকে উঠেই ফোন দেখা মানে সেই সংবেদনশীল যন্ত্রটিকে প্রথম ধাক্কা দেওয়া, যা দীর্ঘমেয়াদে মানসিক ও শারীরিক সমস্যার জন্ম দিতে পারে।
তাই নিজের জন্য ভালো কিছু করতে চাইলে, দিন শুরু করুন নিজের শরীর ও মস্তিষ্কের কথা ভেবে। ফোনটা একটু পরে দেখলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু এখনই সাবধান না হলে ভবিষ্যতে এর মূল্য দিতে হতে পারে অনেক বড়।
এম.কে.