
ছবি: প্রতীকী
কিডনি আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা রক্ত পরিশোধন করে, শরীরের অতিরিক্ত পানি ও বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের অনেকেরই কিডনি প্রতিদিন একটু একটু করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অথচ আমরা তা বুঝতে পারছি না। কারণ কিডনির সমস্যা সাধারণত শুরুতে খুব বেশি লক্ষণ দেখায় না। যখন টের পাওয়া যায়, তখন অনেক সময় অনেক দেরি হয়ে যায়।
প্রতিদিনের কিছু সাধারণ অভ্যাসই কিডনির ক্ষতির পেছনে বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা অনেকেই পর্যাপ্ত পানি পান করি না। দিনের পর দিন পানি কম খাওয়ার ফলে শরীরের বর্জ্য কিডনির মাধ্যমে ঠিকভাবে বের হতে পারে না। এতে কিডনিতে জমে যায় টক্সিন, যা ধীরে ধীরে কিডনির কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। আবার অনেকে সকালে ঘুম থেকে উঠে সরাসরি চা বা কফি পান করেন, কিন্তু পানি পান করেন না। এটি কিডনির উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে।
অনিয়মিত বা বেশি মাত্রায় ওষুধ সেবন করাও কিডনির ক্ষতির একটি বড় কারণ। বিশেষ করে ব্যথানাশক ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার আমাদের দেশে অনেক বেশি। ছোটখাটো ব্যথা হলেই আমরা প্যারাসিটামল বা অন্যান্য ওষুধ খেয়ে ফেলি, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই। এসব ওষুধ কিডনিতে জমে গিয়ে তার ক্ষতি করে। আবার যারা ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, তারা যদি নিয়মিত ওষুধ না খান বা পরিমিত নিয়ন্ত্রণে না রাখেন, তবে সেগুলো সরাসরি কিডনির উপর প্রভাব ফেলে।
অনিয়মিত জীবনযাপনও কিডনির শত্রু। দেরি করে ঘুমানো, রাতে বেশি খাওয়া, অতিরিক্ত লবণ বা চিনি গ্রহণ, ফাস্টফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রতি ঝোঁক — সবই কিডনির জন্য ক্ষতিকর। প্রক্রিয়াজাত খাবারে সোডিয়াম ও ফসফেটের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে, যা কিডনির কাজকে ব্যাহত করে। দিনের পর দিন এসব খাবার খেলে কিডনির ওপর বোঝা বাড়ে এবং ধীরে ধীরে তা নষ্ট হতে শুরু করে।
ধূমপান ও মদ্যপান কিডনির ক্ষতির আরেকটি প্রধান কারণ। সিগারেটের নিকোটিন কিডনির রক্তনালীকে সংকুচিত করে এবং স্বাভাবিক রক্ত চলাচল ব্যাহত করে। ফলে কিডনি ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। একইভাবে মদও কিডনির পানি ও লবণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় গড়বড় করে দেয়।
অনেকেই পর্যাপ্ত ঘুম পান না। শরীরের বিশ্রামের সময় কিডনিও নিজেকে পুনরুদ্ধার করার সুযোগ পায়। কিন্তু নিয়মিত ঘুমের অভাবে কিডনির সেই কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে দিনের পর দিন তার কার্যক্ষমতা কমে আসে। পাশাপাশি যারা অতিরিক্ত পরিশ্রম করে, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয় না, তাদের ক্ষেত্রেও কিডনির ওপর চাপ পড়ে।
শরীরচর্চার অভাবও কিডনির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। যারা একেবারেই হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম করেন না, তাদের রক্ত সঞ্চালন ঠিক থাকে না, ওজন বেড়ে যায়, রক্তে চিনি ও কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ে — যেগুলো সবই কিডনির ক্ষতির কারণ।
একটি আশঙ্কাজনক দিক হলো, কিডনি ধ্বংসের প্রাথমিক ধাপে প্রায় কোনো উপসর্গ থাকে না। ধীরে ধীরে কিডনি যখন ৬০-৭০ শতাংশ অকার্যকর হয়ে যায়, তখন হয়তো কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন: অতিরিক্ত ক্লান্তি, চোখ ও পায়ে ফোলা, প্রস্রাবের পরিমাণে পরিবর্তন, প্রস্রাবে ফেনা বা রঙের পরিবর্তন, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। কিন্তু ততদিনে অনেকটাই দেরি হয়ে যায়।
তাই সচেতন না হলে আমরা প্রতিদিন নিজের অজান্তেই কিডনিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছি। সময় থাকতেই অভ্যাসগুলো পরিবর্তন করা জরুরি। পর্যাপ্ত পানি পান করা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ না খাওয়া, লবণ-চিনি কম খাওয়া, ধূমপান পরিহার করা, ডায়াবেটিস ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা — এই সাধারণ কাজগুলোই কিডনিকে সুস্থ রাখতে পারে।
মনে রাখতে হবে, কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেলে তা আর আগের অবস্থায় ফিরে আসে না। তাই যতক্ষণ সময় আছে, যতক্ষণ কিডনি কাজ করছে, ততক্ষণই সচেতন হতে হবে। নইলে একসময় ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তাই দেহের নিঃশব্দ এই যোদ্ধাকে গুরুত্ব দিন, কিডনি সুস্থ রাখুন, জীবন সুন্দর রাখুন।
এম.কে.