বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে বাংলাদেশ ভোটার রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (বিভিআরএস) পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু এই সিস্টেম পরিচালনায় নিজস্ব দক্ষ জনবল না থাকায় তৃতীয় পক্ষ হিসেবে প্রযুক্তি সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইবিসিএস-প্রাইম্যাক্স সফটওয়্যার (বাংলাদেশ) লিমিটেডের মাধ্যমে সিস্টেমটি পরিচালনা করছে ইসি। তবে কোম্পানিটির সঙ্গে বৈধ কোন চুক্তি ছাড়াই বর্তমানে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এক্ষেত্রে নতুন ভোটার নিবন্ধন, তথ্য সংশোধন এবং বায়োমেট্রিক আপডেটের মতো ইসি’র দৈনন্দিন গুরুত্বপূর্ণ সেবা কার্যক্রমে বিলম্ব হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে প্রকল্প সূত্র বলছে, সিস্টেম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান চুক্তির শর্ত না মানায় একটি স্থবিরতা তৈরি হলেও সার্বিকভাবে সুরক্ষিত আছে ভোটার নিবন্ধন ব্যবস্থা।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আওতাধীন আইডেনটিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং একসেস টু সার্ভিসেস (আইডিইএ-২) প্রকল্পের অধীনে বিভিআরএস নামক এপ্লিকেশনটি পরিচালিত হয়। এক্ষেত্রে ইসি’র কারিগরি সহায়তায় রয়েছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইবিসিএস-প্রাইম্যাক্স লিমিটেড। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ইসি’র করা চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে জুন ২০২৪। এখনো পর্যন্ত নতুন করে নবায়ন চুক্তি বা অন্য কোনো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর বা বিকল্প কোনো ভেন্ডর নিয়োগ হয়নি। এতে প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। চুক্তি নবায়ন না হওয়ায় নির্বাচন কমিশনের দৈনন্দিন কাজকর্মে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। নতুন ভোটার নিবন্ধন, তথ্য সংশোধন এবং বায়োমেট্রিক আপডেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবা কার্যক্রম বিঘিœত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
এর পাশাপাশি, জাতীয় পরিচয় যাচাই এবং নাগরিক শনাক্তকরণ সেবা- যা ১৮০টিরও বেশি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হচ্ছে- তাতেও ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এর ফলে সাধারণ নাগরিকদের ওপর সরাসরি ও পরোক্ষভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ভবিষ্যতের জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতের কাজেও বিলম্বের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে সার্ভার, স্টোরেজ, নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণে জটিলতা বাড়ছে, যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিস্টেম বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও কমিশনের অনুরোধে আইবিসিএস-প্রাইম্যাক্স এখনো কারিগরি সহায়তা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত সেবা অব্যাহত রেখেছে। অপরদিকে কোম্পানির একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা ইসির অনুরোধে এখনো সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি, যদিও আমাদের আনুষ্ঠানিক চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে।
চুক্তি নবায়নের বিলম্বের ফলে প্রশাসনিক, আর্থিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে নানা শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কোম্পানির দাবি, তারা সব চুক্তিভিত্তিক কাজ শেষ করেছে, তবে প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি এখনো হয়নি- মূলত দীর্ঘায়িত হ্যান্ডওভার ও নলেজ ট্রান্সফার প্রক্রিয়ার কারণে, যা চুক্তির আওতাভুক্ত ছিল না।
আইবিসিএস-প্রাইম্যাক্স’র একজন কর্মকতা বলেন, বর্তমান হস্তান্তর পদ্ধতি বাস্তবসম্মত নয়। বুয়েটের পরামর্শে পরিচালিত প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ ও জটিল হয়ে উঠেছে এবং মূল কাজের পরিধির সঙ্গেও এটি সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
অংশীজনরা জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশনের মধ্যে জটিল সিস্টেম পরিচালনার মতো পূর্ণাঙ্গ কারিগরি দক্ষতা এখনো গড়ে ওঠেনি। কমিশনের কিছু অভিজ্ঞ কর্মকর্তা থাকলেও, পূর্ণাঙ্গভাবে বিভিআরএস পরিচালনার জন্য যে স্তরের দক্ষতা প্রয়োজন, তা এখনো সীমিত।
২০০৭ সালে চালু হওয়া বিভিআরএস দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যভা-ার। এটি ব্যাংকিং, পেনশন, সিম নিবন্ধন, নির্বাচনসহ ১৮০টিরও বেশি সেবামূলক কার্যক্রমে ভূমিকা রাখে। সঠিক ভোটার তালিকা প্রস্তুতের মাধ্যমে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে এই সিস্টেমের গুরুত্ব অপরিসীম।
২০১৯ সালে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে জয়লাভ করে আইবিসিএস-প্রাইম্যাক্স বিভিআরএস পরিচালনার দায়িত্ব পায়। তারা ব্যয়বহুল ওরাকল-ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম বাদ দিয়ে উন্মুক্ত সফটওয়্যারভিত্তিক একটি সাশ্রয়ী ও কার্যকর সিস্টেমে রূপান্তর করে, যার ফলে সরকার প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ লাইসেন্স ব্যয় সাশ্রয় করতে পেরেছে। ইসি ইতোমধ্যে চুক্তির তিন-চতুর্থাংশ অর্থ পরিশোধ করেছে। বাকি এক-চতুর্থাংশ অর্থ- যার পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা- এখনো বকেয়া রয়েছে।
চুক্তি নবায়ন প্রসঙ্গে আইবিসিএস-প্রাইম্যাক্স কোম্পানির পরিচালক কাজী আশিকুর রহমান বলেন, ভবিষ্যতে পরিষেবার কোনো ব্যাঘাত এড়াতে আমরা বারবার কর্তৃপক্ষকে প্রকল্পটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে অধিগ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়ে আসছি। আমাদের প্রত্যাশা নির্বাচন কমিশন জাতির সর্বোত্তম স্বার্থে সেই অনুযায়ী কাজ করবে।
এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের আইডিইএ-২ প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ গোলাম আজিজুর রহমান সিদ্দিকী দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, ন্যাশনাল আইডি উইংয়ের অধীনে নির্বাচন কমিশন প্রকল্পের জন্য আইবিসিএস-প্রাইম্যাক্স সফটওয়্যার লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়নি, বরং এটি ২০২৬ সালের ৩০শে জুন পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। তবে, টাইগার আইটির সঙ্গে চুক্তি গত ৩০ জুন ২০২৪ তারিখে শেষ হয়ে গেছে। টাইগার আইটির সঙ্গে সম্পন্ন চুক্তির অনেক ডেলিভারি (যেমন: প্রশিক্ষণ, সক্ষমতা তৈরি, ভিআরএস ইন্টিগ্রেশন, ইত্যাদি) পূরণ করতে না পারায় চুক্তিটি এখনো ক্লোজ করা হয়নি এবং তাদের সঙ্গে চুক্তি সমাপ্তির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে যা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত টাইগার আইটির সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করা যাবে না।
তিনি বলেন, ইসির নিজস্ব জনবলের এখনো কোডিং এবং বিভিন্ন প্রোগ্রামিং ভাষায় সিস্টেম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা তৈরি হয়নি। নিজেদের সক্ষমতা তৈরি না করে কিংবা অন্য কোনো উপায় বের না করে সম্পূর্ণ দায়িত্ব বুঝে নিলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সমস্যা বা ভাবমূর্তির সংকট দেখা দিতে পারে। তবে চুক্তিতে ইসির নিজস্ব জনবলকে দক্ষ করে তোলার বিষয়টি উল্লেখ আছে।
সিস্টেমের ঝুঁকির বিষয়ে তিনি আশ্বস্ত করেন যে, বর্তমানে সিস্টেমে কোনো সমস্যা বা দুর্বলতা নেই এবং কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। সিস্টেমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং ভবিষ্যতে কোনো দুর্ঘটনা এড়াতে তারা সার্বক্ষণিক খেয়াল রাখছেন।