
এশিয়া কাপের ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে শিরোপা জয়ের উল্লাস ভারতীয় ক্রিকেটারদের
এশিয়া কাপ এবং ভারত যেন একে অন্যের সমার্থক। পাকিস্তান এবং সহ-আয়োজক শ্রীলঙ্কায় ‘হাইব্রিড’ মডেলের এশিয়া কাপে আরও একবার সেটি দেখল বিশ্ব ক্রিকেট। রোহিত শর্মার হাত ধরে রেকর্ড অষ্টম বারের মতো শিরোপা জিতল মোড়ল দেশটি। এ অঞ্চলে ভারত ফেভারিট সন্দেহ নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দলটি অনেকটাই অগোছালো ছিল। ছিল ইনজুরি এবং অফ-ফর্ম। অন্যদিকে আইসিসি ওয়ানডে র্যাংকিংয়ের এক নম্বর স্থান পুনরুদ্ধার করেই মিশন শুরু করে পাকিস্তান। তার ওপর আসরটি আয়োজনের দায়িত্ব পায় দীর্ঘ ১৫ বছর পর।
সব মিলিয়ে বাবর আজমদের ঘিরে তৈরি হয় বাড়তি আগ্রহ। কিন্তু মাঠের ক্রিকেটে হতাশ করেছে তারা। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের কাছে বড় হারের পর সুপার ফোরে অঘোষিত সেমিফাইনালে রূপ নেওয়া ম্যাচে শ্রীলঙ্কার কাছে শেষ বলের নাটকীয়তায় সব শেষ হয়ে যায়। হতাশ করে বাংলাদেশও। গ্রুপ-পর্বে একমাত্র আফগানিস্তানকে হারিয়ে কোনোক্রমে সুপার ফোরে উঠলেও সেখানে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার কাছে টানা দুই হারে ফাইনালের রেস থেকে ছিটকে পড়ে সাকিব আল হাসানের দল। কিন্তু অনেকটা আনপ্রেডিক্টের মতো শেষ ম্যাচে হারিয়ে দেয় ভারতকে! বিশ্বকাপের ঠিক আগে হওয়ায় ওয়ানডে ফরম্যাটের এশিয়া কাপ এই অঞ্চলের দলগুলোর জন্য ছিল প্রস্তুতির বড় মঞ্চ। রোহিত থেকে বাবর, শাকিব থেকে শানাকাÑ আসর শেষে প্রত্যেকের মুখেই বিষয়টি বেশ বড় হয়ে উঠে আসে।
এশিয়া কাপের মূল আয়োজক পাকিস্তান। কিন্তু চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত সেখানে যেতে রাজি না হওয়ায় শ্রীলঙ্কাকে সহ-আয়োজক করা হয়। ফাইনালসহ মোট ১৩ ম্যাচের ৯টিই অনুষ্ঠিত হয় সেখানে। যেখানে কলম্বোয় সুপার ফোরের খেলায় প্রতিনিয়তই ঝামেলা বাঁধিয়েছে বৃষ্টি। একে তো গতবারের চ্যাম্পিয়ন। তার ওপর পাকিস্তানকে ওইভাবে বিদায় করে ফাইনালে উঠে আসা শ্রীলঙ্কাকে ঘিরেও ছিল বাড়তি প্রত্যাশা। কিন্তু হতাশ করেছে দাসুন শানাকার দল। ১৫.২ ওভারে মাত্র ৫০ রানে অলআউট হয় স্বাগতিকরা। জবাবে ৬.১ ওভারে কোনো উইকেট না হারিয়ে জয়ের উল্লাসে মাতে ভারত। দুর্দান্ত বোলিংয়ে ম্যাচসেরা হন মোহাম্মদ সিরাজ।
৭ ওভারে ১ মেডেন, মাত্র ২১ রান দিয়ে ৬ উইকেট নেন ডানহাতি এ পেসার। ছোট্ট লক্ষ্য তাড়া করতে নেমেও লঙ্কান বোলারদের এতটুকু ছাড় দেননি দুই ওপেনার। ১৯ বলে অপরাজিত ২৭ রানের ইনিংসে ৬টি চার মেরেছেন ইনফর্ম শুভমান গিল! ১৮ বলে ৩ চারে ২৩ রানে অপরাজিত থেকে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়েন সঙ্গী ইশান কিষান। ‘এভাবে খেলতে দেখলে কার না ভালো লাগে। দলের চরিত্র বোঝা যায়। বোলাররা যেভাবে শুরু করেছে, ব্যাটসম্যানরও ঠিক সেভাবেই শেষ করেছে।’ বলছিলেন রোহিত। এবার ঘরের মাটিতে ২০১১ আসরের পুনরাবৃত্তি করে বিশ্বকাপ উদ্ধারের স্বপ্নে বিভোর ভারত অধিনায়ক, ‘ওয়ানডে বিশ্বকাপের ঠিক আগে ওয়ানডে এাশিয়া কাপের এই আসরটা জয়ের জন্য আমরা সব কিছু করেছি। এক কথায় বললে, এখন ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া সিরিজ এবং বিশ্বকাপই লক্ষ্য। কলম্বোর প্রেমাদাশা স্টেডিয়ামে যেভাবে আতাশবাজি ফুটছে, সমর্থকদের বলব একটু ধৈর্য ধরো, বিশ্বকাপে চূড়ান্ত উৎসবের জন্য প্রস্তুতি নাও!’
ফাইনালের গল্পটা তো আসলে শুধুই মোহাম্মদ সিরাজের। আগুন ঝড়ানো বোলিংয়ে রেকর্ড বইয়ের অনেক পরিসংখ্যান নাড়িয়ে দিয়েছেন ডানহাতি এ পেসার। তাতে শ্রীলঙ্কার লজ্জা আর ভারতের দলীয় অর্জনেও এসেছে আরও অনেক রেকর্ড। শুরুটা করেন ইনিংসের চতুর্থ ওভারের প্রথম বলে পাথুম নিশাঙ্কাকে ফিরিয়ে। জাদেজার দুর্দান্ত ক্যাচে এই ওপেনার আটকা পড়েন ৪ লে ২ রান করে। দ্বিতীয় বল ডট। তবে এর পরের বলে সাদিরা সামাবিক্রমাকে (২ বলে ০) লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলেন সিরাজ। এই ইনফর্ম ব্যাটার রিভিউ নিয়েছিলেন তবে শেষ রক্ষা হয়নি। চতুর্থ বলে আবারও উইকেট! এবার তার শিকারে পরিণত হয়েছেন চারিথ আসালঙ্কা (১ বলে ০)।
প্রথম চার বলে ৩ উইকেট নেওয়ার পর পঞ্চম বলটি ছিল হ্যাটট্রিক ডেলিভারি। সেটিতে দারুণ এক শটে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ইনিংস শুরু করেন ধানাঞ্জয়া ডি সিলভা। কিন্তু পরের বলেই তিনি উইকেটের পেছনে ধরা পড়েন। ২ বলে ওই চারেই শেষ হয় তার ইনিংস। ফলে এক ওভারেই ৪ উইকেট পেয়েছেন সিরাজ। নিজের তৃতীয় ওভারে আক্রমণে এসে আবারও উইকেট পেয়েছেন। চতুর্থ বলে বোল্ড করেছেন শানাকাকে (৪ বলে ০)। ফলে নিজের করা ১৬ বলে মধ্যেই ৫ উইকেট পেয়েছেন তিনি। তাতে চামিন্দা ভাসের রেকর্ড ছুঁয়েছেন সিরাজ। ভাস ১৬তম বলে পঞ্চম উইকেটটি নিয়েছিলেন ২০০৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে। ম্যাচের প্রথম ওভারেই হ্যাটট্রিকসহ বাংলাদেশের ৪ উইকেট নিয়েছিলেন ভাস।
ফাইফার নিয়েই থেমে থাকেননি সিরাজ। ১২তম ওভারে এসে লঙ্কানদের শেষ ভরসা কুশল মেন্ডিসকে (৩৪ বলে ৩ চারে ১৭) ফিরিয়েছেন তিনি। সবমিলিয়ে ক্যারিয়ারসেরা ৭ ওভারে ২১ রানে ৬ উইকেট নিয়েছেন এই পেসার। আগের সেরা ছিল ৪/৩২ এই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই গত জানুয়ারিতে। সর্বোপরি ওয়ানডেতে ভারতের হয়ে এটি চতুর্থসেরা বোলিং। সবার ওপরে স্টুয়ার্ট বিনির ৪ রানে ৬ উইকেট, বাংলাদেশের বিপক্ষে ২০১৪ সালে, মিরপুরে। এশিয়া কাপের সেরা বোলিং ফিগারে তালিকাতেও বসেছেন সিরাজ। ২০০৮ ফাইনালে ভারতের বিপক্ষেই ১৩ রান ৬ উইকেট নিয়েছিলেন লঙ্কান রহস্যময় স্পিনার অজন্তা মেন্ডিস।
এবার সেই একই মঞ্চে লঙ্কান ব্যাটারদের বিপক্ষে নতুন কীর্তি গড়লেন সিরাজ। যেখানে তার বোলিং ফিগারটাও ২১ রানে ৬ উইকেট। প্রথম ১০ ওভারে ভারতের হয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার তালিকাতেও নিজেকে সবার উপরে নিয়ে গিয়েছেন এই পেসার। ১০ ওভারের মাঝে আজ ৫ উইকেট নিয়েছেন তিনি। এর আগে ৪ উইকেট ছিল জাভাগাল শ্রীনাথ, ভুবনেশ্বর কুমার, জসপ্রিত বুমরাহর। সিরাজের আগুন ঝড়ানোর দিনে জ্বলে উঠেছিলেন হার্দিক পান্ডিয়াও। তার ঝুলিতে গেছে ৩ উইকেট। তাছাড়া বুমরাহ পেয়েছেন ১ উইকেট। ইনিংসের চতুর্থ ওভারে সিরাজ নেন ৪ উইকেট। ১ ওভারে কোনো বোলারের ৪ উইকেট নেওয়ার এটি চতুর্থ ঘটনা। এর আগে এমন কীর্তি আছে চামিন্ডা ভাস (বিপক্ষ বাংলাদেশ ২০০৩), মোহাম্মদ সামি (বিপক্ষ নিউজিল্যান্ড ২০০৩) ও আদিল রশিদের (বিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২০১৯)। সব মিলিয়ে ১ ওভারে কোনো দলের ৪ উইকেট পড়ার দশম ঘটনা এটি। সিরাজের ৬ উইকেটের সঙ্গে পান্ডিয়া নিয়েছেন ৩টি, বুমরা ১টি।
২৬৩ বল বাকি রেখে জিতেছে ভারত। ওয়ানডেতে এর চেয়ে বেশি বল বাকি রেখে জয়ের ঘটনা আছে আর ৫টি। তবে ১০ উইকেটে জয়ের ম্যাচে এর চেয়ে বেশি বল বাকি রেখে জয়ের ঘটনা আর একটিইÑ২০০৭ সালে কুইন্সটাউনে বাংলাদেশের দেওয়া ৯৫ রানের লক্ষ্য নিউজিল্যান্ড পেরিয়ে গিয়েছিল ২৬৪ বল ও ১০ উইকেট বাকি রেখে। ওয়ানডেতে কোনো টুর্নামেন্ট ফাইনালে এত বল বাকি রেখে জয়ের ঘটনা নেই আর কোনো। ভারতেরও ওয়ানডেতে এটি সবচেয়ে বেশি বল বাকি রেখে জয়ের নতুন রেকর্ড। ওয়ানডে ফরম্যাটে এশিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের দ্বৈরথে এর আগে তারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ১৯৮৪, ১৯৮৮, ১৯৮৮, ১৯৯০, ১৯৯৫, ২০১০, ২০১৮ সালে। পাশাপাশি ২০১৬ সালে টি২০ ফরম্যাটেও চ্যাম্পিয়ন তারা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছয় বার শিরোপা গেছে লঙ্কানদের ঘরে। ওয়ানডে ফরম্যাটে ১৯৮৬, ১৯৯৭, ২০০৪, ২০০৮ ও গতবার (২০২২) টি২০ ফরম্যাটে। ওয়ানডে ফরম্যাটে পাকিস্তানের দুই শিরোপা ২০০০ ও ২০১২ সালে।
রোহিতের অতি উচ্ছ্বাসের কারণটা অনুমেয়। এশিয়া কাপের আগে ইনজুরি ও অফ-ফর্ম মিলিয়ে বেশ ঝামেলায় ছিল ভারত। সেখানে দারুণ ব্যাটিংয়ে অধিনায়ক নিজে যেমন ফর্মে ফিরেছেন, তেমনি সেঞ্চুরি পেয়েছেন বড় তারকা বিরাট কোহলি এবং ইনজুরি কাটিয়ে দীর্ঘদিন পর ফেরা লোকেশ রাহুল। ধারাবাহিক ব্যাটিংয়ে দ্যুতি ছড়িয়েছেন ওপেনার শুভামান গিল। বল হাতে মাত্র দুই ম্যাচেই ৯ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন স্পিনার কুলদীপ যাদব। ‘এতটা যে হবে, ভাবিনি। সিরাজকে কৃতিত্ব দিতে হবে। ও যেভাবে বল বাতাসে বাঁক খাওয়াচ্ছিল আবার সুইং করছিল, তা খুব বেশি দেখা যায় না। সিরাজ, হার্দিক, শামি, শার্দুল প্রত্যেকে ভিন্ন ধরনের পেসারÑ বৈচিত্র্যময় আক্রমণ। স্পিনে কুলদীপের কথাও আলাদা করে বলতে হবে।
ইনজুরির পর ব্যাট হাতে লোকেশ রাহুর যেভাবে ফিরে এসেছে। সব মিলিয়ে দারুণ একটা অবস্থায় আমরা বিশ্বকাপ শুরু করতে পারব।’ বলেন রোহিত। বিদায়ের আগে শেষ ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে জয়ের পর বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিবও বলেছিলেন, বিশ্বকাপের দল পেয়ে গেছেন তিনি! অর্থাৎ বিশ্বকাপের আবহ নিয়ে শুরু এশিয়া কাপের শেষটাও হয়েছে একই আবহে। আগামী ৫ অক্টোবর ভারতে শুরু হবে ওয়ানডে বিশ্বকাপের এবারের আসর। চলবে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত।