
সাল ২০০০। ২৫ মার্চ। স্থান হিরোশিমা। চেরী ফুলের দেশ। ঐরৎড়ংযরসধ গু খড়াব ঐরৎড়ংযরসধ গড়হ অসড়ঁৎ : অষধরহ জবংহধরং. মনে আছে?
না প্রসঙ্গ ১৯৫৯ সালের বিশ্ব-নন্দিত চলচ্চিত্র নয়।
প্রসঙ্গ : ২৬ মার্চ।
হিরোশিমার মর্মান্তিক মর্মগাথার স্মৃতি-মিউজিয়ামের কাছাকাছি রাতে উঠেছি। জাইকার সফর। সকালের অপেক্ষা। আমি খুব ভোরে উঠি ছোটবেলা থেকেই। ঘুম ভাঙ্গল! বাইরে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। তবুও বের হয়ে গেলাম হোটেল থেকে ছাতা নিয়ে। ওই তো মিউজিয়াম! ধ্বংসযজ্ঞের স্মৃতি চিহ্নের সংগ্রহশালা।
রবীন্দ্রনাথ কখনও পাশ ছাড়েন না। ক’টি পঙতি মনের ভেতর বেজে উঠছিল-
‘সভ্যের বর্বর লোভ নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা, তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে, বাষ্পাকুল অরণ্য পথে পঙকিল হ’ল ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে। দস্যু পায়ের কাঁটা মারা জুতার তলায় বীভৎস কাদার পি- চির চিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে।’
অপমানিত ইতিহাস?
হ্যাঁ, তাই।
আফ্রিকা,হিরোশিমা আর বাংলাদেশের রক্তাক্ত ইতিহাস, এদের মাঝে তফাৎ কোথায়? আমাদের ইতিহাসও কি তা নয়? কিন্তু আমরা জাগ্রত হয়ে একজনের আহবানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম অপমানের জবাব দিতে।
ফিরে যাই, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় মিউজিয়ামের উদ্দেশ্যে। বিশাল চত্বরে ছোট্ট একটা বেদি। আণবিক বিস্ফোরণের এপিসেন্টার। চোখে পড়ল বেদির কাছে, যেন ঝরে নুয়েপড়া চারা গাছের মতো বা বাকা ধনুকের মতো একজনকে, যেন একটি অশরীরী অবয়ব! কাছে গিয়ে দেখলাম শতবর্ষ ছুঁয়েছে এমন একজন বৃদ্ধ! ফুল দিচ্ছেন। আমি এগিয়ে কাছে গেলাম। শত বছরের বেদনার বোঝা বইছেন সন্দেহ নেই। ধীরে, খুব ধীরে এগিয়ে এলেন তিনিও। তাকালেন আমার দিকে। তীক্ষè চাকুর মতো চোখ, চোখের কি বয়স নেই? আমি আমার ছাতা তাঁর ওপর ধরার চেষ্টা করলাম। একটু হেসে সরিয়ে দিলেন।
বললেন : ঝঢ়বধশ ঊহমষরংয? জবাবঃ ণবং, ও ফড় ঝরৎ!
প্রশ্ন : কোন দেশ?
বললাম : বাংলাদেশ। ভেবেছিলাম হয়ত চিনতে পারবেন না! চিনলেন।
মনে হলো যেন শুনছি উরংঃধহঃবপযড়ব! দুরাগত প্রতিধ্বনির মতো তাঁর কণ্ঠ:
‘তোমরা একটি যুদ্ধে জয়ী হয়েছ। অর্জন করেছিলে আত্মমর্যাদা।
আমি বিস্মিত হলাম।
বৃদ্ধ বলে চললেন, ধীর লয়ে অথচ প্রত্যয়ী কণ্ঠে : একটি দেশ যুদ্ধে পরাজিত হতে পারে, জয়ীও হতে পারে। যুদ্ধে জয়-পরাজয় আছে। কিন্তু যে জাতি আত্মমর্যাদা হারায়, সেই জাতি সব হারায়। সে জাতি আর জাতি থাকে না, হয়ে যায় আত্মমর্যাদাহীন ক্লিব। তোমরা হত্যা করেছ তোমাদের জয়ী পথিকৃত কে। হত্যা করে হারিয়েছ আত্মমর্যাদা!
চুপ করে গেলাম। ধীরে, অত্যন্ত ধীরে অপসৃয়মান সেই মানুষটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম, অপলক। ঘন মেঘ আকাশে। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলাম। বৃষ্টি বেড়েছে। ছাতা গুটিয়ে নিলাম। বৃষ্টি তুমি অঝরে ঝরো!
অনেক প্রশ্নের উত্তর পাই না, প্রতিধ্বনি হয়ে ফেরত আসে। কিন্তু উত্তর দিচ্ছেন একজন, রক্তের ধারাবাহিকতায়। বাংলাদেশ আছে, রূপের সে সুগন্ধে, পুনরায় জেগে উঠেছে বাংলাদেশ! বংগবন্ধু আছ্নে : নাও ছাড়িয়া দে, পাল তুলিয়া দে। ঐতো বন্ধু, আমাদের সংস্কৃতি আমাদের প্রতিচ্ছবি। স্বাধীনতা তুমি অজর কবিতা, শুধু রবিঠাকুরের নয়, শেখ মুজিবের!