ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২

সেলিনা হোসেন

একুশ কোনো সংখ্যা মাত্র নয়

প্রকাশিত: ০৭:০০, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

একুশ কোনো সংখ্যা মাত্র নয়

বাহান্নর ভাষা আন্দোলন শুধুমাত্র ভাষার জন্য আন্দোলন ছিল না। ভাষা আন্দোলনের ছিল বহুমাত্রা। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল জীবনের বহুমাত্রিক স্রোত। যে স্রোত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে ছুঁয়ে যায়। একুশের মঞ্চই একমাত্র ক্ষেত্র যা আমাদের দেশের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষকেই একসূত্রে গাঁথতে পেরেছে। গত চার দশক ধরে আমরা ভাষা আন্দোলনের বহুমাত্রিকতাকে দেখছি। জীবনের বহু ক্ষেত্রে এর ব্যাপকতা, প্রয়োজনীয়তা ও প্রয়োগকে দেখছি। ভাষা আন্দোলনের কাছে আমাদের বার বার ফিরে যেতে হয়। নিজেদের ব্যর্থতা নিজেদের অর্জনের মূল্যায়নের জন্যেই এই ফিরে যাওয়া। আমাদের রয়েছে একটি সমৃদ্ধ অতীত। যে অতীত প্রতিটি ধর্মের মানুষের সমন্বয়ের অতীত। এই অতীতের একটি যোগসেতু একুশের আন্দোলন। একুশের মধ্যে দিয়েই যেন আমাদের এই হাজার হাজার বছরের অতীত কথা কয়ে ওঠে। তাই ভাষা আন্দোলন আমাদের জীবনে এক অনিবার্য উপস্থিতি। উর্দুকে যারা রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে বাংলাকে উপেক্ষা করেছিল। কিন্তু এই উপেক্ষা বাঙালি জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারেনি। কারণ যখন কোনো জাতির মুখের ভাষা বিপদগ্রস্ত হয় বুঝতে হবে তখন সেই জাতির অস্তিত্বই বিপন্ন হওয়ার পথে। স্বভাবতই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে সেদিন সমগ্র বাঙালি জাতি সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। সেদিন থেকেই ভাষা-আন্দোলন আমাদের একটি অসাম্প্রদায়িক চরিত্র দান করতে পেরেছে। তখনকার পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন ফজলু রহমান। তিনি ছিলেন বাঙালি। তিনি বলেছিলেন যে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এবং পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম অভিন্ন। তিনি আরও চেয়েছিলেন আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রচলন করতে। সেটা ’৪৭ থেকে ’৪৯ সালের কথা। তখন পাকিস্তান সরকারের তরফে বয়স্কদের শিক্ষাখাতে যে অর্থ বরাদ্দ হয়েছিল তা পশ্চিম পাকিস্তানের বয়স্কদের শিক্ষাখাতে ঠিকই ব্যয় করা হয়েছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় হয়েছিল আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের চেষ্টায়। ’৪৭ থেকে ’৪৯-এর মধ্যে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য একের পর এক ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল। কিন্তু ’৫২-র আন্দোলন ইতিহাসকে একদম উল্টো স্রোতে বইয়ে দিয়েছে। ২. দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ’৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। এই অবস্থার মধ্যে সমাজ-ব্যবস্থায় রক্ষণশীলতা অবশ্যই থাকে। রক্ষণশীলতার প্রধান দায়-দায়িত্বগুলো মহিলাদের ওপরেই বেশি করে বর্তায়। ৫০-এর দশকে ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই আমাদের দেশের মহিলারা রক্ষণশীলতার বেড়ি ভেঙে একটা প্রগতির ধারার সূচনা করেছিলেন। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক ইতিহাসের অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ স্মৃতিচারণ করেছেনÑ ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করার সূচনায় দু’তিনটি দলে ভাগ হয়ে ছাত্রদের মিছিল বেরিয়ে যাওয়ার পর ছাত্রীদের যে মিছিল হয়েছিল তাতে তারা আট-দশজন ছাত্রী অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর একজন বান্ধবী ছিলেন নাম সামসুন্নাহার। এর বাবা ছিলেন পাকিস্তানের প্রাক্তন স্পিকার, পোশাক-আশাক ও চালচলনে এদের পরিবারটি ছিল রক্ষণশীল। মেয়েটি বোরখা পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন ও পুরোপুরি পর্দাপ্রথা মেনে চলতেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলন যখন অনিবার্য হয়ে উঠল তখন এই মেয়েটি বোরখা পরেই মিছিলে গিয়েছিলেন এবং গুলি ও কাঁদনে গ্যাসের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ২২ তারিখে যখন ছাত্রীরা আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন তখন আন্দোলনের ছাত্রনেতারা তাদের বলেন যে, আন্দোলন পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। সুফিয়া আহমদের বাবা ছিলেন জাস্টিস ইব্রাহিম। সমাজের একজন অভিজাত উঁচু তলার মানুষ। এত সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েরাও সেদিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। এরকম কয়েকটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায় যে, সেদিন এই আন্দোলন আমাদের জীবনে কতখানি অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। দিনটা ছিল পূর্ববঙ্গ বিধান পরিষদের বাজেট অধিবেশনের দিন। বিধান পরিষদের একমাত্র মহিলা সদস্য ছিলেন আনোয়ারা খাতুন। ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে তিনি পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে এসেছিলেন। চার দশক আগে মহিলাদের পক্ষে রক্ষণশীলতার দড়িছেঁড়া, আন্দোলনে অংশ নেওয়া খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। সেদিন মহিলারা নানাভাবে ভাষা আন্দোলনকে শক্তি যুগিয়েছিলেন। এত বছর পরেও আমরা সেই আবেগটুকু ধারণ করে রেখেছি। প্রয়োজনে আমরা বার বার একুশের কাছে ফিরে যাচ্ছি। শক্তি সঞ্চয় করছি। ৩ ১৯৪৭ সালে ড. এনামুল হক তার প্রবন্ধে লিখেছিলেন যে, বাংলার পরিবর্তে যদি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হয় তাহলে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু অনিবার্য। এ ব্যাপারে সব থেকে বেশি সোচ্চার ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি বলেছিলেন যে, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে যদি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হয় তাহলে তা পূর্ব পাকিস্তানবাসীর পক্ষে অত্যন্ত লজ্জাকর, অপমানজনক আত্মসমর্পণ করা হবে। এবং এই আত্মসমর্পণ হবে একটি রাজনৈতিক বশ্যতা স্বীকার। তিনি আরও বলেছিলেন যে, আমরা হিন্দু না মুসলমান এটা বড় কথা নয়, আমরা বাঙালি এটা যেমন বাস্তব কথা তেমনি বাস্তব সত্য। ‘৫২-র ভাষা আন্দোলন এভাবেই আমাদের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। এই অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনা আমরা আজ পর্যন্ত লালন করছি। কিন্তু আমাদের এখনকার ইতিহাসের চেয়ে ভিন্ন হয়ে গেছে। ৫০-এর দশকে যে দাঙ্গা হয়েছিল তারপর ১৯৬৪, অর্থাৎ ১৪ বছরের মধ্যে কোনো দাঙ্গা হয়নি। ১৯৬৪ সালে ভারতে হজরত মহম্মদের চুল চুরির ঘটনার প্রতিবাদে আমাদের দেশে যে দাঙ্গা হয়েছিল সেই দাঙ্গা শুরু হয়েছিল খুবই তাৎক্ষণিকভাবে। সেই দাঙ্গাকে প্রতিরোধ করা হয়েছিল অত্যন্ত সংগঠিতভাবে, অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে। প্রতিরোধ করা হয়েছিল দুই ভাবে। রাজনৈতিকভাবে এবং সাংস্কৃতিকভাবে। রাজনৈতিকভাবে প্রতিরোধের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক কর্মীদের নিয়ে দাঙ্গাবিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত এলাকার ঘরে ঘরে গিয়েছিলেন ও দাঙ্গাকে প্রতিহত করতে পেরেছিলেন। সাংস্কৃতিকভাবে প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাংস্কৃতিক কর্মীরা দলবদ্ধভাবে উপদ্রুত এলাকায় গিয়েছিলেন। দেশের সম্মানিত বিশিষ্ট শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা রাস্তায় নেমেছিলেন। সেই সময় ব্যক্তিগত প্রতিরোধ কতখানি স্বতঃস্ফূর্ত ছিল তার উজ্জ্বল উদাহরণ আমির হোসেন চৌধুরী। তিনি কবি ছিলেন, ইংরেজিতে প্রবন্ধ লিখতেন এবং নজরুল ইসলাম ইন্টারন্যাশনাল ফোরামের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি তার প্রতিবেশী একটি হিন্দু পরিবারকে রক্ষা করতে গিয়ে দাঙ্গাকারীদের হাতে নিহত হন। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে তার এই মৃত্যু আমাদের কাছে অত্যন্ত গৌরবের। এ মৃত্যু আমাদের অহঙ্কার। কিন্তু আজ বাংলাদেশে কি ঘটছে। একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতার শুরু করেছিলাম আমরা। কিন্তু সেই যাত্রাকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি। ১৯৯০ এবং ’৯২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে আমরা প্রতিহত করতে পারিনি। আমাদের সেই মনোবল ছিল না, দৃঢ়তা ছিল না। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই নিরপরাধ অসহায় প্রতিবেশীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে ফেলেছি। আমরা যেটুকু প্রতিরোধ করেছি তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই ক্ষীণ, খুবই দুর্বল। ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের সংবিধান থেকে বাতিল হয়ে গেছে। ১২ অনুচ্ছেদ বাতিল করে ১৯৮৯ সালে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রবর্তন করা হয়েছে। এসবই হয়েছে সরকারী পর্যায়ে। সাধারণ মানুষ ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রত্যাখ্যান করেনি। কিন্তু তারপরেও বলতে হবে যে আমাদের সাম্প্রদায়িক চেতনা প্রবেশ করেছে। এই সাম্প্রদায়িক চেতনা কেন প্রবেশ করল এটা আমাদের কাছে খুবই বড় প্রশ্ন। ৪ মৌলবাদী রাজনীতি উত্থানের আরেকটি পরিণতি শহীদ মিনার আক্রমণ। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩-এর ঘটনা এটি। মৌলবাদীরা শহীদ মিনার আক্রমণ করে ও শহীদ মিনারের পিছনের সূর্যটিক পুড়িয়ে দেয়। কালো কালি লেপে মুছে দেয় রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে অনেক কবির কবিতার লাইন। মুছে দেয় আলপনা। তারা প্রচার করছে যে এগুলো পূজার নিদর্শন। এভাবে পূজা করা হচ্ছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী শহীদ মিনার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। তার গায়ে লিখে দিয়েছিল মসজিদ। কিন্তু না সে মসজিদ তারা রাখতে পারেনি। এভাবে গায়ের জোরে মসজিদ করা যায় না। আসলে বিশ্বজুড়েই আজ ধর্মান্ধতার প্রসার ঘটেছে। বাবরি মসজিদকেন্দ্রিক সাম্প্রতিক ঘটনা এর অন্যতম উদাহরণ। বাবরি মসজিদে কি হয়েছে তার জন্য আমাদের নিরপরাধ হিন্দু প্রতিবেশীর ওপর অত্যাচার করতে হবে, জোর জুলুম করতে হবে এটা আর যাই হোক মুসলমানিত্ব নয়। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মহম্মদ তাঁর বিদায় হজের বাণীতে বলেছিলেন যে, ‘ধর্ম লইয়া বাড়াবাড়ি করিও না। যদি ধর্ম লইয়া বাড়াবাড়ি করো তাহলে নিশ্চহ্ন হইয়া যাইবে।’ যদি কোনো মুসলমান ইমানের সঙ্গে এটা বিশ্বাস করে তাহলে সে কখনই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে পারে না। আল্লার ঘর আল্লা রক্ষা করবেন। যদি এই বিশ্বাস থেকে আমরা খারিজ হয়ে যাই তাহলে আমাদের মুসলমানিত্বের বিশ্বাস থাকে কোথায়? ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যে অসাম্প্রদায়িকতা আমরা অর্জন কেরছিলাম, বাংলাভাষাকে ভালোবেসে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর শোষণ নিপীড়নকে উপেক্ষা করে যে অসাম্প্রদায়িক চরিত্র আমরা অর্জন করেছিলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পরে মাত্র দুই দশকের মধ্যেই আমরা তার সমস্ত কিছুই হারিয়েছি। আমরা সরে এসেছি আমাদের চরিত্র থেকে। সুপরিকল্পিতভাবে এই সাম্প্রদায়িকতার উত্থান, সম্পত্তি দখলের অপচেষ্টা, দেশত্যাগ করার জন্য উস্কানি এ ধরনের আগ্রাসন আমাদের সমাজ জীবনে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। ৫ এর পরেও কথা থেকে যায়। একমাত্র একটা জিনিসকেই সাম্প্রদায়িকতা এখনও স্পর্শ করতে পারেনি। তাহল আমাদের সাহিত্য। আল মাহ্মুদের অল্প কিছু কবিতা ছাড়া আমাদের সাহিত্য এখনও পুরোপুরি অসাম্প্রদাযিক। এখনও আমাদের বুদ্ধিজীবীদের বিবেক সাম্প্রদায়িকতার মর্মচেতনা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। নানা ধরনের লেখালেখি হচ্ছে পত্রপত্রিকায়। যে যেভাবে পারছেন লিখছেন, বলছেন। এই লেখার বিরুদ্ধে চক্রান্তও আছে। এগুলোকে বন্ধ করার জন্য উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে। বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে। কিন্তু দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। যদি বুঝতে পারি যে এই সাম্প্রদায়িকতার আগ্রাসন আমাদের মর্মমূলকে এখনও স্পর্শ করতে পারেনি তাহলে বুঝতে হবে যে এখনও আলোর রেখা আমাদের সামনে আছে। আর একুশ তো আমাদের জন্য রয়েই গেল। যে একুশ আমাদের দুর্যোগে দুঃসময়ে পথ দেখিয়েছে। যে একুশ মানে মাথা নত না করা।
×