
প্রযুক্তি এখন আর শুধু একটি টুল নয়, এটি আমাদের জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশেষ করে বর্তমানের তরুণ প্রজন্ম, অর্থাৎ 'জেন জি' (Gen Z) এবং 'জেন আলফা' (Gen Alpha) প্রযুক্তিকে যেভাবে দেখছে এবং ব্যবহার করছে, তা আমাদের ভবিষ্যৎকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। এই দুই প্রজন্ম জন্মগতভাবে ডিজিটাল বিশ্বের বাসিন্দা, আর প্রযুক্তিকে তারা দেখছে কেবল একটি সুবিধা হিসেবে নয়, বরং জীবনের এক মৌলিক উপাদান হিসেবে।
জেন জি: ডিজিটাল বিশ্বের স্রষ্টা ও সমালোচক
জেন জি (যারা ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে) হলো প্রথম প্রজন্ম যারা স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে বেড়ে উঠেছে। তাদের কাছে ইন্টারনেট কেবল তথ্যের উৎস নয়, বরং যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম।
কনটেন্ট নির্মাতা: টিকটক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মে তারা কেবল কনটেন্ট ভোক্তা নয়, বরং সক্রিয় নির্মাতা। তাদের ট্রেন্ড ও সৃষ্টিশীলতা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
দক্ষ ব্যবহারকারী: তারা বিভিন্ন অ্যাপস ও সফটওয়্যারের ব্যবহারে অত্যন্ত পারদর্শী এবং দ্রুত নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) ও অগমেন্টেড রিয়েলিটি (এআর) তাদের কাছে নতুন কিছু নয়।
সামাজিক পরিবর্তন: জেন জি প্রযুক্তিকে সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা তুলে ধরার এবং পরিবর্তনের জন্য প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করে। অনলাইন পিটিশন, হ্যাশট্যাগ আন্দোলন—এগুলো তাদের প্রতিবাদের ভাষা।
কর্মক্ষেত্রে প্রভাব: তারা যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে, তখন তারা প্রযুক্তি-সমন্বিত, নমনীয় এবং উদ্দেশ্য-চালিত পরিবেশ আশা করে।
জেন আলফা: প্রযুক্তির সাথে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম
জেন আলফা (২০১০ সালের পর জন্মগ্রহণকারীরা) হলো সম্পূর্ণভাবে এআই, ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং স্মার্ট ডিভাইসের যুগে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম। তাদের কাছে ইন্টারনেট শুধু ভার্চুয়াল জগৎ নয়, বরং এক অবিচ্ছেদ্য বাস্তবতা।
স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার: তারা স্পর্শভিত্তিক পর্দা (touchscreen) এবং ভয়েস কমান্ডে (voice command) এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত যে, এটি তাদের কাছে দ্বিতীয় প্রকৃতির মতো। খেলার ছলেই তারা কোডিং বা রোবোটিক্সের প্রাথমিক ধারণা অর্জন করছে।
ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি: জেন আলফা এআই, ভিআর/এআর এবং মেটাভার্সের মতো প্রযুক্তিকে আরও সহজলভ্য ও ব্যবহারিক করে তুলবে। তাদের চাহিদা ও প্রত্যাশা ভবিষ্যতের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মূল চালিকাশক্তি হবে।
উচ্চ প্রযুক্তিতে আগ্রহ: উইপ্রোর সিটিও সন্ধ্যা অরুণ-এর মতে, জেন জি এবং জেন আলফার প্রযুক্তি পেশাদাররা সাধারণ ক্লায়েন্ট প্রজেক্টের চেয়ে জেনারেটিভ এআই (GenAI), কোয়ান্টাম এবং ব্লকচেইনের মতো নতুন প্রযুক্তির সাথে জড়িত প্রকল্পগুলিতে স্পষ্ট আগ্রহ দেখাচ্ছে। তারা দৈনন্দিন 'বিরক্তিকর কাজ' গুলিতে আগ্রহী নয়, বরং 'উদ্দেশ্য এবং চ্যালেঞ্জের অনুভূতি' খুঁজছে। এই প্রজন্মগুলি আয়ের জন্য কাজ করার চেয়েও বেশি আকর্ষক এবং চ্যালেঞ্জিং কাজ চায়।
প্রযুক্তি শিল্পের উপর প্রভাব:
এই দুই প্রজন্মের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা প্রযুক্তি শিল্পকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। তারা এমন প্রযুক্তি চায় যা দ্রুত, ব্যক্তিগতকৃত, নির্বিঘ্ন এবং তাদের মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ডেটা গোপনীয়তা, স্ক্রিন টাইম এবং ডিজিটাল সুস্থতার মতো বিষয়গুলো নিয়ে তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে, যা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও দায়িত্বশীল হতে উৎসাহিত করছে।
তবে, প্রযুক্তির এই নিবিড় সম্পর্ক কিছু চ্যালেঞ্জও তৈরি করছে। অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম, তথ্যের বন্যা এবং সাইবার বুলিংয়ের মতো বিষয়গুলো তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগের কারণ।
জেন জি এবং জেন আলফা প্রযুক্তিকে কেবল ব্যবহার করছে না, তারা এটিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। তাদের হাত ধরেই ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ও সমাজের পথ তৈরি হবে, যেখানে মানবতা ও প্রযুক্তির মধ্যে এক নতুন ভারসাম্যের প্রয়োজন হবে।
রাজু