
ছবি: সংগৃহীত
সকাল গড়াচ্ছে ধীরে। গাজা উপত্যকার খান ইউনিস শহরের ধ্বংসপ্রাপ্ত এক ভবনের ধূলিধূসর কোণায় বসে আছেন ২৪ বছর বয়সী তরুণী রিমা। কোলে তার শিশু সন্তান, বয়স মাত্র আট মাস। শিশুটির গলা ফাটানো কান্না থামছে না, ঠোঁট ফেটে গেছে, চোখে জল নেই—শুধু হাহাকার। রিমার চোখে পানি নেই, কিন্তু তার বুকের ভেতরে চলছে নিঃশব্দ কান্নার স্রোত।
রিমা জানেন—তার স্তনে এখন আর এক ফোঁটা দুধ নেই। যুদ্ধের ভয়, অনাহার, দুশ্চিন্তা তার শরীরকেও নিঃশেষ করে দিয়েছে। সেমাই, গুঁড়োদুধ, এমনকি বিশুদ্ধ পানির সামান্য চিহ্নটুকুও তাদের ভাগ্যে নেই।
এই যে চিত্র—এটাই আজকের গাজা। একটি ভূখণ্ড, যেখানে মায়েরা সন্তান কোলে নিয়ে বাঁচার আশায় বসে থাকেন, কিন্তু তাদের পাশে খাবার তো নেই, নেই ন্যূনতম চিকিৎসা কিংবা নিরাপদ আশ্রয়ও।
২০২৪ সালের শেষ প্রান্তে এসে গাজা পরিণত হয়েছে পৃথিবীর অন্যতম ভয়ংকর মানবিক সংকটের কেন্দ্রে। জাতিসংঘ বলছে—গাজায় ১১ লাখেরও বেশি মানুষ চরম খাদ্যাভাবে দিন কাটাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার ৪৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যা একধরনের নীরব গণহত্যার ইঙ্গিত দেয়।
অনেক মা রয়েছেন, যারা নিজেরাও অনাহারে—ফলে বুকের দুধ আসছে না। শিশুর কান্না দিন-রাত তাদের পিছু নেয়। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নেই গুঁড়ো দুধ, নেই স্যালাইন, নেই পানীয় জল। একসময় যারা স্কুলে যেত, খেলনা নিয়ে খেলত—তারা এখন খাদ্য খুঁজে বেড়ায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে।
UNRWA, WHO, WFPসহ নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা সহায়তার হাত বাড়ালেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো নয়। খাদ্যবাহী ট্রাক ঢুকতে পারে না নিয়মিত, মানবিক সহায়তা পৌঁছে না অধিকাংশ এলাকা পর্যন্ত। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেও খাবার পায় হাতে গোনা কয়েকজন।
একজন গাজাবাসী বাবা বললেন, “স্ত্রীকে বলেছি—আজ ওকে শুধু পানি খাইয়ে ঘুম পাড়াও। কারণ আজ আমাদের ভাগ্যে কোনো খাবার নেই।”
শিশুদের অপুষ্টি শুধু শারীরিক নয়, এটি মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশেরও অন্তরায়। বিশেষজ্ঞরা জানান, “একটি শিশু পাঁচ বছর বয়সের আগেই যদি দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টিতে পড়ে, তবে তার বুদ্ধি, স্মৃতি, ও স্বাস্থ্য চিরতরে ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়। এই ক্ষতি কখনোই পুরোপুরি পূরণ করা যায় না।”
ধ্বংসের ছাইয়ের নিচে কেবল বাড়ি-ঘর চাপা পড়েনি, চাপা পড়েছে হাজারো স্বপ্ন, শৈশব, মাতৃত্ব, ভালবাসা। এখানে শিশু শুধু বোমার শব্দে নয়, ক্ষুধায়ও কাঁদে। এখানে মা শুধু সন্তান হারানোর ব্যথায় নয়, তার ক্ষুধার্ত মুখটা দেখে নিঃশব্দে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
এই কান্না কোনো জাতিসংঘের রিপোর্টে ধরা পড়ে না। এই কান্না কোনো জিওপলিটিক্স বোঝে না। শুধু একটাই প্রশ্ন তোলে—
“আমরা কী খাবো?
এই পৃথিবীর কোনো শিশুর পেটে খালি থাকার অধিকার নেই। এই পৃথিবীর কোনো মায়ের কোল এমন শূন্য হতে পারে না। জানুন, দেখুন, শোনুন, অন্তত একবার ভাবুন—
ক্ষুধায় কাঁদে শিশু, চুপ করে কাঁদে মা এই বাক্য যেন শুধু খবরের কাগজে নয়, জেগে থাকে বিশ্ববিবেকের দেয়ালে।
আসিফ