ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২

ভিউ লাইকের ভণ্ডামি লোক দেখানো মানবতা

সানিয়া তাসনিম লামিয়া

প্রকাশিত: ১৮:২৪, ৩১ জুলাই ২০২৫

ভিউ লাইকের ভণ্ডামি লোক দেখানো মানবতা

এক সময় মানুষের সাহায্যের জন্য পাশে দাঁড়ানো ছিল মানবিক দায়িত্ব। কিন্তু আজকাল এই দায়িত্ব যেন হয়ে উঠেছে একটি দৃশ্যমান কার্যকলাপ। রাস্তায় কেউ কষ্টে আছে—সাহায্যের বদলে অনেকেই আগে মোবাইল বের করেন ভিডিও করতে। কেউ দরিদ্র শিশুকে খাবার দিচ্ছেন, পাশে বন্ধু ভিডিও করছে, একটু পরেই সেটা চলে যাচ্ছে ফেসবুকে বা ইউটিউবে, ক্যাপশনে লেখা—”মানবতার জয় হোক!” কিন্তু সত্যিকারের মানবতা কি এতটাই ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে যে, ক্যামেরা না থাকলে সে আর জাগে না?
এই সামাজিক প্রবণতা শুধু চিন্তার খোরাক নয়, এটি মানবিক সংকটের দিকেও ইঙ্গিত করে। ক্যামেরা সামনে থাকলে আমরা ‘ভালো মানুষ’ হয়ে যাই, আর ক্যামেরা না থাকলে হয়ে উঠি উদাসীন দর্শক। এই দ্বিচারিতা কি সত্যিকারের সহানুভূতির প্রতিবিম্ব? নাকি এটি কেবল আত্মপ্রচারের এক নতুন উপায়?
ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় করা একটি অনানুষ্ঠানিক জরিপে দেখা গেছে, রাস্তায় কেউ অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকলে প্রথম প্রতিক্রিয়ায় ১০ জনের মধ্যে ৭ জনই মোবাইল বের করে ভিডিও করতে চায়। তাদের মধ্যে মাত্র ৩ জন কোনো ধরনের সহায়তা করতে এগিয়ে আসে।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণায় পাওয়া যায়—প্রায় ৬৫% তরুণ স্বীকার করেছে, তারা দান বা সাহায্যের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয় মানুষের প্রশংসা পাওয়ার জন্য।
এছাড়া, বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের অভিমত—ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে অনেকেই যোগ দেন ছবি তোলার সুযোগ থাকলে, কিন্তু ক্যামেরা বন্ধ হলে আর তাদের দেখা যায় না।
অনেকে ভালো কাজ করছেন নিঃস্বার্থভাবে—এ কথা সত্য। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে অনেকেই কাজটি করেন কেবল জনসামক্ষে নিজেকে “ভালো মানুষ” হিসেবে তুলে ধরতে। প্রশংসার আশা, ভাইরাল হবার লোভ, কিংবা স্রেফ চোখে পড়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই এই সাহায্য। যেন সহানুভূতি নয়, বরং অভিনয়ই এখন প্রধান।
এই দৃশ্যগুলো কেবল বাহ্যিক নয়, গভীরতর এক সংকটের প্রতিচ্ছবি। মানুষ যেন আর কাউকে মানুষ হিসেবে নয়, বরং কনটেন্ট হিসেবে দেখছে। একজন অসহায় মানুষ হয়ে উঠছে “ভালো কাজের” মঞ্চ। তার দুর্বলতা, কষ্ট—সবকিছু ব্যবহার করা হচ্ছে নিজেকে প্রচার করার জন্য।
শিক্ষা ব্যবস্থায় সহানুভূতির যে পাঠ দেওয়া হয়, বাস্তব জীবনে তা প্রায় অনুপস্থিত। ছোটবেলায় শেখানো হয়, “দরিদ্রের পাশে দাঁড়াও, বিপদে মানুষের সহায় হও।” কিন্তু বড় হয়ে সেই শিক্ষার রূপ বদলে যায়। এখন সহানুভূতি মানেই ক্যামেরাবন্দি কিছু মুহূর্ত, কিছু ইফেক্ট লাগানো ভিডিও, কিছু আবেগঘন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক।
গণমাধ্যমেও আজকাল দেখা যায়, কষ্টের চিত্র যত বেশি হৃদয়বিদারক হয়, সেটাই তত বেশি “সংবাদযোগ্য”। একজন অসহায় শিশুর কান্না, এক বৃদ্ধার হাতজোড় করে সাহায্য চাওয়া—এসব দৃশ্য নিয়ে বানানো হয় বিশেষ রিপোর্ট, কিন্তু রিপোর্টের বাইরে সেই মানুষটির জীবনে কোনো পরিবর্তন হয় না।
অনেক সময় সাহায্যপ্রার্থীর সম্মানবোধও এই “লোক দেখানো মানবতা”র নিচে চাপা পড়ে যায়। একজন দরিদ্র মা যখন লাইনে দাঁড়িয়ে এক কেজি চাল নিচ্ছেন, তার ছবি যখন অনলাইনে ভাইরাল হয়—তখন সে কী অনুভব করে? সেই লজ্জা কি আমরা উপলব্ধি করি? সাহায্যের সঙ্গে যদি অপমান যুক্ত হয়, তবে তা আর সাহায্য থাকে না, হয়ে দাঁড়ায় একধরনের প্রদর্শনী।
অথচ এমন অনেকেই আছেন, যারা গোপনে মানুষকে সাহায্য করেন, কারও লেখাপড়ার দায়িত্ব নেন, বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে সময় দেন, পথশিশুর পাশে দাঁড়ান—কোনো ছবি নেই, কোনো স্ট্যাটাস নেই। কিন্তু তাঁদের এই নীরব ভালোবাসাই সমাজকে টিকিয়ে রাখে।
একজন বৃদ্ধ যখন রাস্তায় পড়ে থাকেন, তখন তার প্রয়োজন পানি, চিকিৎসা কিংবা একটু সহানুভূতি—হড়ঃ ক্যামেরা। একজন শিশু ক্ষুধায় কাঁদছে—সে চায় একমুঠো খাবার, ছবি নয়। এই সত্যগুলো আমরা ভুলে গেছি। ভুলে গেছি যে মানবতা মানে হৃদয়, নাটক নয়।
ভালো কাজ করা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু যদি তা হয়ে দাঁড়ায় স্রেফ আত্মপ্রচারের মাধ্যম, তাহলে তার মানে বদলে যায়। মানুষকে সাহায্য করার আসল অর্থ তখন হারিয়ে যায় ছবির ফ্রেমে, ভিডিওর ব্যাকগ্রাউন্ডে, আর ক্যাপশনের মোড়কে।
আজ দরকার একজন অসহায় মানুষের চোখে চোখ রেখে তাকে সহায়তা করার সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনা। দরকার শব্দের চেয়ে স্পর্শের, ক্যামেরার চেয়ে হৃদয়ের, প্রচারের চেয়ে প্রকৃতির মানবতা।
সাহায্য করতে গেলে সেটি যেন প্রথমে মানুষটির প্রয়োজন মেটায়, তারপর আসে অন্যসব বিবেচনা। আর যদি সাহায্যপ্রার্থীর সম্মতি ছাড়া তাকে জনসমক্ষে তুলে ধরা হয়, তাহলে সেটা সহানুভূতির নয়, আত্মম্ভরিতার প্রতিফলন।
এই সমাজকে বদলাতে হলে আমাদের ব্যক্তিগত চিন্তার জায়গা থেকেই পরিবর্তন আনতে হবে। ভালো কাজ করব—শুধু এই কারণে যে, কেউ কষ্টে আছে। কেউ দেখছে কি না, কেউ ভিডিও করছে কি না—তা যেন না হয় আমার উদ্বেগের বিষয়।
কারণ মানবতা তখনই সবচেয়ে সুন্দর হয়, যখন তা হয় নিঃশব্দ, নিঃস্বার্থ ও নিখাঁদ। তখন তা ক্যামেরায় নয়, রয়ে যায় একজন মানুষের চোখে, মনে, এবং জীবনের গভীরে।
মানবতা হোক অনুভবে, প্রচারে নয়।
মানুষের পাশে দাঁড়ানো হোক দায়িত্ববোধে রেকর্ডিংয়ের লালসায়।
এটাই হোক আমাদের নতুন মানবিক সমাজের প্রতিজ্ঞা।

লেখক : শিক্ষার্থী, 
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা 

প্যানেল/মো.

×