
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড—এই বাক্যটির তাৎপর্য আমরা সকলেই জানি, এবং এর সাথে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এই চিরন্তন বাণীটি শুধু মুখস্থ করে রাখার জন্য নয়, বরং তার গভীরতা অনুধাবন করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্হার আতুড়ঘর প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে, নতুন বন্দোবস্ত গ্রহণ করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কেমন শিক্ষা চাই? কেবল পরীক্ষা-নির্ভর, পুঁথিগত বিদ্যায় পারদর্শী একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা নাকি মানবিক মূল্যবোধে পরিপূর্ণ একজন সুস্থ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবার একটি শিক্ষা ব্যবস্থা।
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, প্রযুক্তির প্রসার দুর্বার গতিতে। কিন্তু এর পাশাপাশি আমরা দেখতে পাচ্ছি এক অদৃশ্য মানবিক সংকট। সমাজের প্রতিটি স্তরে, শিক্ষিত মানুষের ভিড়েও কোথাও যেন শূন্যতা—নৈতিকতার, সহানুভূতির, এবং দায়িত্ববোধের অভাব।
আজকের শিশুরা ছোট পরিবারে বড় হচ্ছে, তাদের হাতের মুঠোয় আধুনিক প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রবাহ। কিন্তু এই প্রজন্মের অনেকের মাঝেই আমরা দেখতে পাচ্ছি আত্মকেন্দ্রিকতা, ধৈর্যহীনতা এবং সহানুভূতির অভাব।
শুধু ভালো ফলাফল সাফল্যের মাপকাঠি হতে পারে না। একজন মানুষ কতটা মানবিক, সেটাই তার প্রকৃত শিক্ষার প্রতিফলন।
আমরা একটি শিশুর ভবিষ্যতের জন্য যতটা অর্থনৈতিক সঞ্চয়ের কথা ভাবি, ঠিক ততটাই কি ভাবি তার মূল্যবোধ গঠনের কথা? আমরা চাই তারা একজন ভালো মানুষ হয়ে উঠুক, যাদের মধ্যে থাকবে মমতা, সততা, ন্যায়বোধ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা।তাই এই চাওয়া ও পাওয়ার সমন্বয় ঘটানোর লক্ষ্যে আমাদের চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন আনার পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থায় নিয়ে আসতে হবে আমূল-পরিবর্তন। যে পরিবর্তনে সুশিক্ষা কেবল ফলাফলমুখী পাঠ্যবইয়ে জ্ঞান অর্জন নয় বরং সেখানে সুশিক্ষা মানে হবে এমন এক শিক্ষা, যা মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়, সমাজকে সম্মান করতে শেখায়, এবং দেশকে আপন করে ভাবতে শেখায়।
আমাদের প্রয়োজন এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা:
যেখানে পাঠের সাথে থাকবে নৈতিকতা ও মানবিকতার শিক্ষা,
যেখানে শিশুরা শিখবে সহানুভূতি, সহনশীলতা ও দায়িত্ববোধ,
যেখানে পরীক্ষার নম্বরের পাশাপাশি মূল্যায়িত হবে মানবিক গুণাবলি।
আজকের শিশুরাই আগামী দিনের রাষ্ট্রপ্রধান, চিকিৎসক, শিক্ষক, বিজ্ঞানী বা সমাজের কাণ্ডারি। তাদের মধ্যে যদি মানবিক গুণ না থাকে, তবে শিক্ষার সমস্ত অর্জন অর্থহীন হয়ে পড়বে।
তাই এখন সময়—শুধু ভালো ফল নয়, ভালো মানুষ গড়ার শিক্ষা ব্যবস্থায় আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। পরিবার, বিদ্যালয়, সমাজ—সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলতে হবে - মানবিক ও মূল্যবোধসম্পন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর এই ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সুশিক্ষাই সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ।
লেখক: ফারজানা রহমান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ
নোভা