
বর্ষা আসে কোনো পুরানো চিঠির ভাঁজ খুলে। পড়ে ফেলে আমাদের মনের অন্দরের ভাষা। প্রথম ফোঁটাটি পড়তেই মাটি থেকে উঠে আসে এক চেনা গন্ধ- যেন হারিয়ে যাওয়া কোনো দিনের ফিরে আসা। আকাশ ধূসর হয়ে ওঠে, আলো হয়ে যায় নরম, বাতাসে ভেসে বেড়ায় এক গভীর প্রশান্তি। প্রকৃতি তখন যেন নিজের আঁচলে ভিজে গল্প লুকিয়ে রাখে। গ্রামবাংলায় এই গল্প সবচেয়ে স্পষ্ট। কাদামাখা পথ, ভেজা গাছের ছায়া, জমিনের ওপর শুয়ে থাকা মেঘের ছায়া- সব মিলে বৃষ্টি সেখানে হয়ে ওঠে এক জীবন্ত চিত্রকল্প। কোথাও শিশুদের কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, কোথাও বৃদ্ধের নিঃশব্দ বসে থাকা, আবার কোথাও ভেজা কুড়েঘরের চাল থেকে ঝরে পড়া একটি দুটি ফোঁটা- যা হৃদয়ে পড়ে প্রতিধ্বনি তোলে। তবে শহরেও বৃষ্টি নামে, নামে ভিন্ন এক রূপে। সেখানে বৃষ্টি আরাম আর বিড়ম্বনার জটপাকানো গিট। রাস্তায় জমে থাকা পানির মাঝে থেমে যায় মানুষের গতি, ছুটে চলা গাড়ি আর সময়ের হিসেব। তারপরও, শহরের জানালার পাশে বসে একাকী কেউ যখন চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ায়, সেই মুহূর্তেও বৃষ্টি কথা বলে- শব্দ দিয়ে নয়, অনুভব দিয়ে। এই অনুভব কেবল রোমান্টিক নয়, তা হতে পারে নির্মাণশীলও। বর্ষার এই ধীর গতি, নরম সময়- তাতে ভেসে আসতে পারে নতুন চিন্তার বীজ। অলস দুপুরে খিচুড়ির গন্ধের ফাঁকে, ছাতার নিচে হাঁটতে হাঁটতে কিংবা মেঘলা আলোয় ঘরের কোণে বসে, কেউ হয়তো ভাবছে- কীভাবে আরও ভালো মানুষ হওয়া যায়, কীভাবে সৃষ্টিকে আরও ছুঁয়ে ফেলা যায়। এই ভাবনার পাশে এসে দাঁড়ায় এক বাস্তবতা। আমাদের ছায়ার মতো হেঁটে বেড়ায় সেইসব মানুষ, যারা বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপে- কেবল বৃষ্টিকে উপভোগ করার জন্য নয়, বরং বেঁচে থাকার দায়ে। তারা রাস্তায়, তারা ফ্লাইওভারের নিচে, তারা ভবনের গায়ে হেলান দিয়ে জুতো বিক্রি করে, কিংবা ইটের মাথায় বসে পলিথিনে শরীর মুড়ে অপেক্ষা করে কাজের। আমরা কি তাদের দিকে চোখ ফেরাই? বৃষ্টি এখানে একটি আয়না। তাতে প্রতিফলিত হয় আমাদের মনুষ্যত্ব। আমরা যারা এই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, আমাদের উচিত নিজের প্রতিচ্ছবি একটু গভীরভাবে দেখা- এই ভিজে দুপুরে শুধু নিজের আরাম খোঁজার বাইরে, অন্যের কষ্ট বুঝে তাকে সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করা। হয়তো একদিনে সব বদলায় না, কিন্তু একটি দিনের ভালো ব্যবহার থেকে শুরু হতে পারে একটি নতুন দিনের গল্প। বৃষ্টি সেই গল্পও হতে পারে- যেখানে ঘরের কোণে বইয়ের পাতা খুলে বসে, কেউ নিজের ভিতরের সুরটাকে খুঁজে পায়। অথবা কেউ কাগজে আঁকে নিজের স্বপ্নের রেখা। হয়তো কিছু না করেও, চুপ করে বসে থেকে শোনা যায় নিজের মনের শব্দ। এই শুনতে পারাটাই তো এক ধরনের সৃষ্টি। বৃষ্টি হোক উপলক্ষ- নিজেকে জানার, অন্যকে বোঝার, হৃদয়কে জাগ্রত করার। এই বৃষ্টিতেই হোক নতুন সূচনা- যেখানে একফোঁটা জল শুধু ভেজায় না, উৎসারিত করে আলো।
যশোর থেকে
প্যানেল/মো.