
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ কিছু সাফল্য দিয়ে যাচ্ছে। যেমন কাঠামো সংস্কারের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে কর্মকর্তা পর্যায়ে আনা হয়েছে ব্যাপক রদবদল। ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। গুম-হত্যা চিরতরে বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। আয়নাঘর নামের নির্যাতনের সেই ঠিকানা বাতিল করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) শক্তিশালী করা হচ্ছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাকে সরকারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধে এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক কাঠামোর কোন খাতে কতটা সংস্কার প্রয়োজন এবং তা কীভাবে সম্ভব তা নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্য উপদেষ্টারা। আলোচনায় অংশ নিয়েছেন ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করাও। সকলের মতামতের প্রতিফলন আনতে রাজনৈতিক দলের কাছে সংস্কার প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী, সংবিধান সংস্কার, তত্ত্ববধায়ক সরকারের রূপরেখা, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে বিশিষ্টজনের মতামত চাওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও ছাত্রদের অন্যতম সমন্বয়ক মাহফুজ আলম বলেন, ‘দেশে স্বচ্ছ, জবাবদিহি ও জনসম্পৃক্ত রাজনীতি ও নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে সংবিধান সংস্কার করতে হবে।’
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়। এই লক্ষ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন এই ছয়টি ক্ষেত্রে সংস্কার আনার জন্য পৃথক পৃথক কমিশন গঠন করা হয়। সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত কমিশন ইতোমধ্যে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, যেখানে সংসদীয় ব্যবস্থা আরও কার্যকর করার জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে এবং নির্বাচন কমিশন সংস্কারের লক্ষ্যে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। বিচার ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করতে বিচারকদের নিয়োগ ও প্রেষণ নীতিতে পরিবর্তন আনার সুপারিশ করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কার্যকারিতা বাড়াতে নতুন বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার এই সংস্কারগুলোকে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশের শাসন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও অন্তর্বর্তী সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ: নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমাতে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। বাজার তদারকি জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় কঠোরতা এবং মুদ্রানীতিতে কিছু কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। বিনিয়োগ আকর্ষণ: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ কর ছাড়ের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। রপ্তানি খাতে উজ্জীবন: দেশের রপ্তানি খাত বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পকে চাঙ্গা করতে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করা হয়েছে।
৮ আগস্ট সরকার গঠনের পর থেকে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে সবচেয়ে কঠিন যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে, তা হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন। দায়িত্ব গ্রহণের সময় থেকেই সরকার দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কঠোর অবস্থান গ্রহণের ঘোষণা দেয়। সন্ত্রাস দমন, সীমান্ত অপরাধ, চোরাচালান এবং শহরাঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার করার ওপর ছিল সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব। বিশেষ অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে। রাজধানীসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সীমান্ত এলাকাগুলোতে বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়েছে, যার ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। টেকনাফ ও কক্সবাজার অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। অনলাইন জালিয়াতি, হ্যাকিং এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সাইবার ক্রাইম ইউনিট সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। ভুয়া তথ্য প্রচার ও ডিজিটাল প্রতারণা বন্ধে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। ইউনূস সরকারের ছয় মাসের অন্যতম বড় সাফল্য আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হয়েছে এবং মানবাধিকার ইস্যুতে সরকার তার নীতি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব নিয়ে আলোচনা চলছে, যা ভবিষ্যতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার নতুন ধারা শুরু হয়েছে, যদিও এখনো কার্যকর সমাধান আসেনি। বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান আরও দৃঢ় করতে সরকার কৌশলী ভূমিকা রাখছে, যা ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন। তবে বিরোধী দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। সরকার বলছে, সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করেই নির্বাচন আয়োজন করা হবে। বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি জানাচ্ছে, যা নিয়ে আলোচনা চলছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন হিসাব কষছেন। গত এক মাসে তিনি ৩০টির বেশি দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নামি-দামি অনেক রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান তাকে অভিনন্দন জানিয়ে সম্পর্ক জোরদার করার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বিগত সরকারের যে ধরনের সম্পর্ক ছিল তাতে ভাটা পড়েছে। বাঁধ খুলে দেওয়া ও সীমান্ত হত্যাকাণ্ড ইস্যুতে ভারত সরকারকে কঠিন বার্তা দিয়েছে বর্তমান সরকার। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সার্ককে গতিশীল করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজাতে ৯০ দিনের সীমারেখা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা খাতে ব্যাপক সংস্কার শুরু করা হয়েছে।
মানবাধিকার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করা হচ্ছে এমন মত জানিয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত গুমের কারণে নিখোঁজ ব্যক্তির সংখ্যা সাত শতাধিক।’ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছেন। এখন এ বিষেয় আইনি সংস্কার করা হবে। বর্তমান সরকারের এই এক মাসে পুলিশ বিভাগের সংস্কারে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশ বিভাগকে এখনো পুরোদমে সক্রিয় করা সম্ভব হয়নি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকার পুলিশ বিভাগকে সক্রিয় করে সৎ, আন্তরিক ও পেশাদার হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। তবে পুলিশ বাহিনী এক মাসের মধ্যে পরিবর্তন হবে, তা আশা করা ঠিক না। সরকারকে পুলিশ সংস্কারে আরও জোর দিতে হবে।’
সংস্কারের অংশ হিসেবে অবৈধ সুবিধা গ্রহণ, দুর্নীতি ও গণহত্যার দায়ে বিগত সরকারের অনেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, গণমাধ্যমকর্মীর নামে করা মামলায় অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অর্থনীতিতে সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যাপক সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পুঁজিবাজারসহ অর্থ খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজে গতি বাড়াতে আগের সরকারের আমলে দায়িত্ব পালনরতদের বাদ দিয়ে নতুনদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। শিল্প খাতে স্থিতিশীলতা রাখতে, কারখানায় সুষ্ঠু পরিবেশ ও শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার, মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধি নিয়ে রিভিউ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
অর্থনৈতিক সংস্কারের আংশ হিসেবে এরই মধ্যে কালোটাকা সাদা করার বিশেষ সুযোগ বাতিল করা হয়েছে। ব্যাংক খাতে স্থিরতা আনতে কমিশন গঠনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের মালিক দুর্নীতিগ্রস্ত হলে তাকে বিচারের আওতায় আনলেও তার প্রতিষ্ঠান সচল রাখতে সরকার প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্যবসায়ীদের কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বন্দর সচল করতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পণ্যের দাম কমাতে এরই মধ্যে অনেক নিত্যপণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে।
আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করাই অন্তর্বর্তী সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমাদের আর্থিক খাত সংস্কার করা খুব জরুরি। বর্তমান সরকার দায়িত্বে এসে এখানেই হাত দিয়েছে। এটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জের কাজ। অর্থনীতি ঠিকভাবে মেরামত করতে পারলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। আমদানি কমবে, রপ্তানি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। ছাত্র-জনতাও এটাই চেয়েছে।
লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন
প্যানেল/মো.