ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ জুলাই ২০২৫, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২

দুর্যোগ দুর্বিপাক দুর্ঘটনা এবং উত্তরা ট্র্যাজেডি

আসাদ পারভেজ

প্রকাশিত: ১৭:৩৮, ২৩ জুলাই ২০২৫

দুর্যোগ দুর্বিপাক দুর্ঘটনা এবং উত্তরা ট্র্যাজেডি

২১ জুলাই রাজধানী উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে অন্যদিনের মতোই দুপুরবেলায় চিরচেনা ব্যস্ততা। ক্লাসরুমের বাইরে অপেক্ষারত অভিভাবকরা। তাদের হৃৎপিণ্ড সন্তানরা কেউ ক্লাস করছিল, কেউ ছুটি শেষে বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। নিয়তি যে বিধিবাম কে-বা জানে! বেলা একটার হঠাৎ শোনা গেল বিকট শব্দ। কোনোকিছু বুঝে উঠার আগেই মুহূর্তেই আগুন, ধোঁয়া আর চিৎকারে এলোমেলো হয়ে যায় পুরো পরিবেশ।
কিছুক্ষণ পরই জানা যায়, বিমানবাহিনীর এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান স্কুলটির চত্বরের একটি দোতলা ভবনে বিধ্বস্ত হয়েছে। বিমানটি ছিল চীনের তৈরি- যা প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছিল। আইএসপিআর এর তথ্য মতে, বেলা ১টা ৬ মিনিটে কুর্মিটোলার বিমানবাহিনীর ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পর বেলা ১টা ১৮ মিনিটের দিকে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিধ্বস্ত হয়। মর্মান্তিক এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলামসহ ৩২ জন নিহত ও আহত ১৬৫ জন।
প্রশিক্ষণের সব ধাপ শেষে তৌকির ইসলাম প্রথমবারের মতো একা বিমান চালাবেন- এই প্রত্যাশায় পরিবারের সদস্যরা সোমবার সকালবেলা থেকেই উচ্ছ্বসিত ছিল। অথচ তাদের মতো করে বহু পরিবারের আনন্দ আজীবনের জন্য নিভে গেল। কত মায়ের বুক খালি হইছে, কত মায়ের আদরের সন্তান যন্ত্রণায় কাতরাইতাছে- আল্লাহই তা ভালো জানেন। অন্যদিকে সন্তানকে পাওয়া-না পাওয়ার অজানা আতঙ্কে স্বজনদের আহাজারি চলছেই। এক বিষণ্ন পরিবেশ। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈতিক রাজনীতির ফলে হাসপাতালগুলোর সামনে চিকিৎসা বিঘ্নিত হচ্ছে।
রাষ্ট্র শোক প্রকাশ আর পতাকা অর্ধনমিত করার মাধ্যমে তার যাবতীয় দায়িত্ব শেষ করে ফেলতে চায়! এদেশে বারবার বড় দুর্ঘটনার পর একই প্রশ্ন প্রবলভাবে প্রতিধ্বনিত হয়। উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিমানবাহিনীর এফটি-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ বিমানের বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা এমন প্রশ্নকে নতুন করে সামনে এনেছে। গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে অগ্নিকাণ্ডের তাপদাহে পুড়ে যাওয়া ছোট ছোট নিষ্পাপ ফুটফুটে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির মর্মস্পর্শী চিত্র স্পষ্ট হয়েছে।
২২ জুলাই, একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক। প্রধান উপদেষ্টা, তিন বাহিনীর প্রধান, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধানরা শোকবার্তা জানিয়েছেন। কিন্তু এই প্রতীকী আনুষ্ঠানিকতা কি আসল সমাধান? জনগণের চোখে এটা মনে হয় যেন দায়িত্ব এড়ানোর এক সহজ-সরল কৌশল। এত সব দুর্ঘটনা আমাদের দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ভয়াবহ দুর্বলতা, আন্তরিকতার অভাব এবং সর্বোপরি দেশের শাসনব্যবস্থার অদক্ষতাকে দেখিয়ে দেয়।
এদেশে বড় বড় দুর্ঘটনার ইতিহাস দীর্ঘ। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা এসব দুর্ঘটনায় বিচলিত। প্রতিটি ঘটনায় রাষ্ট্রের প্রতিল্ডিয়া প্রায় একই রকম। শোকবার্তা ও ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি, তদন্ত কমিটি গঠন এবং গণমাধ্যমে কয়েকদিন আলোচনার পর বিষয়টি সবাই ভুলে যায়। বছর শেষে পত্রিকার পাতায় সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড কিংবা ফ্যাসিস্টদের দুর্নীতির খবরের মতো করে একবার সামনে আসা ছাড়া আর কি-বা হতে পারে!
দুর্যোগ প্রতিরোধের জন্য দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা থাকা উচিত। অথচ তা কাগজে কলমে। ফলে প্রতিবার নতুন করে একই ধরনের বিপর্যয় ঘটে। ২০১৩-এর ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজার ধ্বংসলীলা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ইতিহাসে ভয়াবহতম শিল্প-দুর্যোগগুলোর একটি। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৩ মে রেশমা বেগমকে উদ্ধারের তিনদিন পর সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করে। বিশ দিনের উদ্ধার তৎপরতায় অবশেষে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে ১ হাজার ১২৯টি মৃতদেহ পাওয়া যায়। জীবিত উদ্ধার করা হয় আড়াই হাজারের মতো মানুষ- যাদের অধকাংশই চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করে। এ ঘটনা বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের নিরাপত্তাহীনতা এবং দুর্বল শ্রম অধিকারকে পুরোটাই নগ্ন করে তুলেছিল।
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার চকবাজারে নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭৮ জনের মৃত্যু হয়- যা ইতিহাসের পাতায় ডুবে আছে। রাস্তা সংকীর্ণ, ফায়ার সার্ভিস দ্রুত পৌঁছাতে না পারে, পর্যাপ্ত পানির উৎস ছিল না। এই অদক্ষতা এবং নগর ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা দেশর টপ নিউজ ছিল। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও সমাধান নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপের পরিবর্তে সরকারি ঘোষণা আর শোক বার্তাতেই বিষয়টি শেষ।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। অতিরিক্ত যাত্রী, অপর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা এবং ত্রুটিপূর্ণ নিরাপত্তা প্রটোকল থাকায় এ দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উঠে আসে। এরপর ২০২২-এর জুনে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেনার ডিপোর কথা সবারই জানা। বিস্ফোরণে ৪৯ জন তাজাপ্রাণের শরীর সমাধি হয়। রাসায়নিক পদার্থ সংরক্ষণে নিরাপত্তাহীনতা এবং পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাব এই দুর্ঘটনাকে ভয়াবহ রূপ দেয়। সেখানেও তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তার সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে কি?
২০২৩ সালের বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ডে শত শত দোকান ভস্মীভূত- যেখানে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়। নওগাঁর রানীনগরে আগুনে পুড়ে যায় ৫০টিরও বেশি ঘরবাড়ি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের প্রতিল্ডিয়া ছিল ধীরগতি- যার ফলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়।
সাধারণত যুদ্ধবিমানগুলো সবচেয়ে উন্নত এবং কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়। এফটি-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ বিমানটি উড্ডয়নের মাত্র ১২ মিনিটের মধ্যে ভেঙে পড়া শুধু প্রযুক্তিগত ত্রুটির ব্যর্থতা নয়, বরং রক্ষণাবেক্ষণ, প্রশিক্ষণ এবং দুর্যোগ মোকাবিলা পরিকল্পনার সামগ্রিক দুর্বলতার প্রতিফলন।
এ ঘটনার মাধ্যমে আমরা আবারও দেখেছি- দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিস ও জরুরি সেবার ধীরগতি। স্কুল ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা অপ্রতুলতা এবং প্রাথমিক চিকিৎসা ও উদ্ধার সমন্বয় চরমদুর্বল ছিল। এক্ষেত্রে অবশ্য গণমাধ্যমকর্মী, উৎসুক জনতা, অতিউৎসাহী ইউটিউবার এবং চারিত্রিক স্থলনে জর্জরিত রাজনীতির চামচাদের ভিড়ে অভিভাবকগণ, প্রশাসনের লোকজন এবং উদ্ধারকর্মীরা তাদের স্বীয় দায়িত্ব পালনে ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।
বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সরকারের বার্ষিক বাজেট বিশাল। কিন্তু যে কোনো দুর্ঘটনার পর পরিষ্কার বোঝা যায়, এর প্রভাব মাঠপর্যায়ে অতি সামান্যই। কেননা, দুর্নীতি ও অদক্ষতায় বরাদ্দকৃত অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার হয় না। অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, উদ্ধারকর্মীদের দক্ষতার অভাব এবং আধুনিক সরঞ্জামের অপ্রতুলতা। প্রতিরোধমূলক সংস্কৃতির অনুপস্থিতি- যা দুর্ঘটনা ঘটার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে মন্ত্রণালয়ের কার্যল্ডমে রাজনৈতিকীকরণ এবং দলীয় স্বার্থ জড়িত আছে বলেই এমন পরিস্থিতি।
বাংলাদেশের দুর্ঘটনার ইতিহাসে বারবার স্পষ্ট হয়েছে- সাধারণ জনগণই প্রথমে উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রানা প্লাজার ধসে হাজারো সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে অংশ নিয়েছে। চকবাজার কিংবা বঙ্গবাজারে স্থানীয়রা নিজেরা পানি ও বালি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের অক্ষমতা জনগণকে অনেক সময় অসহায় করে তোলে। এমন পরিস্থিতিতে জনমনে প্রশ্ন জাগে- জনগণের ট্যাক্সের অর্থে পরিচালিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ কি? কেন তারা ব্যর্থ হচ্ছে?
এদেশকে রক্ষা করতে হবে। মাথা তুলে অধিকার দেশের প্রতিটি জনগণের ন্যায্যতার দাবি। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ জোরদার করা খুবই প্রয়োজন। সবার আগে বিমান, লঞ্চ, কারখানা ও স্কুল ভবনে আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার। ফায়ার সার্ভিসকে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম সরবরাহ করা। দ্রুত প্রতিল্ডিয়া ব্যবস্থা তৈরি করে দুর্ঘটনার প্রথম প্রহরে কার্যকর পদক্ষেপের জন্য র‌্যাপিড রেসপন্স টিম গঠন করা আবশ্যক। সড়ক-নগর পরিকল্পনায় দুর্যোগ মোকাবিলার দিকগুলো সংযোজন করতে হবে। প্রত্যেকটি কাজে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের মাঝে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি স্কুল-কলেজে দুর্যোগ মোকাবিলা ও প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
গত সোমবারের উত্তরা বিমান দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে জানান দিয়েছে যে- কেবলই শোক নয়, প্রতিটি ক্ষেত্রে কার্যকর সংস্কার প্রয়োজন। দুর্ঘটনার পর ছবি তোলা, কাঁদা, ক্ষতিপূরণ দেওয়া বা পতাকা অর্ধনমিত করা কখনো টেকসই সমাধান নয়। প্রতিটি প্রাণের নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব।
লেখক : গবেষক ও রাষ্ট্রচিন্তক

প্যানেল/মো.

×