ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

‘স্বর্গীয় স্বরাজ’ এবং ভারত

মিলু শামস

প্রকাশিত: ১৭:৪৬, ৮ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৯:৩১, ৮ জুলাই ২০২৫

‘স্বর্গীয় স্বরাজ’ এবং ভারত

বছর কয়েক আগে এক যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক এ যুগে মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধীর প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আন্তনীয় গ্রামসির তত্ত্ব টেনেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল এ রকম, আন্তনীয় গ্রামসি তাঁর বিখ্যাত প্যাসিভ রেভলিউশন বা নিষ্ক্রিয় বিপ্লবতত্ত্ব দিয়ে মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধীর ‘সত্যাগ্রহ’ আন্দোলনের ব্যাখ্যা করেছিলেন। অহিংসা, অসহযোগ, আইন অমান্য ও নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ ছিল সত্যাগ্রহের মূল উপাদান। আর নিষ্ক্রিয় বিপ্লব তত্ত্বের একটি ব্যাখ্যা হলো, (বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে) বিপ্লব সব সময় নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে না। বিপ্লব পরিস্থিতি সমাজে যখন একেবারে অনুপস্থিত তখনো আসলে নীরবে নিভৃতে বিপ্লবের প্রস্তুতি চলতে থাকে। বাস্তবতা অনুকূলে না থাকায় বিপ্লবকামীরা ভেতরে ভেতরে বিপ্লবের প্রস্তুতিপর্ব এগিয়ে নেয়। গ্রামসির মতে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গান্ধী যে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে নেমেছিলেন তা ছিল প্যাসিভ রেভলিউশন। ওই প্রাবন্ধিক শুধু গ্রামসি নয় মার্কস থেকে শুরু করে টলস্টয় লেনিন স্ট্যালিন ক্রুশ্চেভ সবাইকে সাক্ষী মেনে গান্ধীকে ‘বিপ্লবী’ এবং সত্যাগ্রহকে বিপ্লব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। এ ধরনের আলোচনা খুবই বিভ্রান্তিকর। মার্কস-লেনিন গ্রামসির তত্ত্বকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দিয়ে কোনো ব্যক্তি বা ঘটনাকে একেবারে উল্টো করে দেখানো গোলমেলে শুধু নয়, বিপজ্জনকও। গান্ধীর অহিংস নীতির ঝাণ্ডা উড়িয়ে গত প্রায় তিন দশকে ভারতের রাজনীতিতেও কিছু গোলমেলে কাণ্ড ঘটছে যার প্রস্তুতি পর্বের নায়ক ছিলেন আন্না হাজারে। পরিণতি পর্বে  অরবিন্দ কেজরিওয়াল। 
প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় মূলধারার রাজনীতিতে বিরাজনীতিকরণের সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা বহুদিনের। কেজরিওয়াল সম্ভবত তারই সফল কেসস্টাডি ছিলেন। তাকে নিয়ে কথা বলতেই গান্ধীর প্রসঙ্গ এলো। কারণ ব্যক্তিত্বের দৈর্ঘ্য প্রস্থে কেজরিওয়াল গান্ধীর চেয়ে সন্দেহাতীতভাবে খাটো হলেও তাদের লক্ষ্যে মিল প্রচুর। যে কল্পিত স্বরাজের স্বপ্ন দেখিয়ে গোটা ভারতবর্ষকে গান্ধী নাচিয়েছিলেন, সেই স্বরাজ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য বা বাণী হচ্ছে, ‘সংগ্রামের মাধ্যমে নহে, ভগবানের আশীর্বাদরূপেই এই স্বরাজ স্বর্গ হইতে ভারতের ওপর নামিয়া আসিবে।’ সেই ‘স্বর্গীয় স্বরাজের’ কল্যাণে ভারতবাসী দেখেছিল ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। বাস্তবের মানুষেরা তার নানান মহিমা দেখছে। স্বরাজ সত্যাগ্রহ ইত্যাদির নামে গান্ধী আসলে কোনো শক্তির স্বার্থ রক্ষা করেছেন পরিবর্তিতরূপে সেই শক্তি উপমহাদেশের রাজনৈতিক টানাপোড়েনকে নিজেদের সুবিধামতো কীভাবে ওঠানামা করাচ্ছে, বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস পাঠক এবং সচেতন মানুষরা তার খবর রাখেন। তার মৃত্যুর বাষট্টি-তেষট্টি বছর পর দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার আওয়াজ নিয়ে হঠাৎ করেই আন্না হাজারে নামে এক ‘মহান’ নেতার আবির্ভাব হলে তারা বিস্ময় বিহ্বলে আত্মহারা হন না। এ ধরনের মেকি ইস্যু তুলে মূল সমস্যা থেকে মানুষের চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার কৌশল পুরানো। তবে শুধু এটুকু বলা যথেষ্ট নয়। তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে দেওয়াও ঠিক নয়। কারণ আন্না হাজারে বা কেজরিওয়ালদের উত্থানের পেছনে রয়েছে ভিন্ন উপাখ্যান। যা নির্মাণ করেছেন আরেক দল তাত্ত্বিক। পোস্টমডার্নিস্ট সেই তাত্ত্বিকরা ইম্পেরিয়ালিজমকে পোস্ট ইম্পেরিয়ালিজম বলে আড়াল করতে চাইলেও ইম্পেরিয়ালিজম আসলে নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে বহাল তবিয়তে আছে। এর সাম্প্রতিকতম (একেবারে সাম্প্রতিক বলা যাবে না। সহস্রাব্দের শুরু থেকে) নিরীক্ষা হচ্ছে জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ধ্বংস করা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়া। কোনো দেশের রাজনীতির স্বাভাবিক গতিপ্রক্রিয়াকে স্তব্ধ করার ক্ষতি কত ভয়াবহ হতে পারে তা অনেক সময় সহসাই টের পাওয়া যায় না। দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে এই ভয়াবহ প্রক্রিয়াটি এখন আর ক্ষীণ নয়, বেশ শক্ত ধারাতে এগোচ্ছে ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশ থাইল্যান্ডের একেবারে এ মুহূর্তের বাস্তবতাও সেদিকে ইঙ্গিত দেয়। এ দেশের ছাত্ররাও ভার হয়ে বসা সেই শক্তির উচ্ছেদ ঘটিয়েছে একবছর আগে। আন্না হাজারে, অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা হচ্ছেন এ ধারা এগিয়ে নেওয়ার পাইওনিয়ার। আর তাদের পাইক বরকন্দাজ হচ্ছে সুশীল সমাজ নামে সুবিধাভোগী গোষ্ঠী এবং বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠান। এরা রাজনৈতিক নেতৃত্বের নেতিবাচক দিকগুলো বিশেষ করে দুর্নীতির দিক নানা রঙে বর্ণিল করে উপস্থাপন করেন এবং এমন একটি মনোভাব দেখান যে এর চেয়ে ঘৃণ্য আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু কেন তারা দুর্নীতিবাজ হলেন, কোন সিস্টেম তাদের দুর্র্নীতিবাজ হওয়ার সুযোগ করে দিল সে সম্পর্কে কিছু বলেন না। উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়াও যে একটি পরিকল্পিত কর্মসূচির অংশ তা তারা কখনো এজেন্ডায় আনেন না। কারণ এটা তাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। এ মূল বিষয় প্রকাশিত হলে তাদের জন্ম বৃদ্ধি বিকাশ কোনোটাই হতো না। রাজনীতিবিদদের গায়ে দুর্নীতির লেবেল সেঁটেছে বলেই তো তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলে বিকল্প শক্তি হিসেবে মাঠে নামতে পেরেছেন। এই লেবেল সাঁটা এবং তা ক্লিন করার জন্য ‘অবতার’ নামানো এ সব একই প্রোগ্রামের অংশ। ভারতের রাজনীতিতে যা বাস্তবায়নের লড়াকু সৈনিক অরবিন্দ কেজরিওয়াল। মুখ্যমন্ত্রীর শপথ বক্তৃতায় তিনি উপস্থিত জনতাকে অঙ্গীকার করিয়েছিলেন ‘জীবনে কখনো কাউকে ঘুষ দেব না, কারও কাছে ঘুষ চাইব না।’ ঘুষ দেওয়া-নেওয়া ঘুঘুদের ধরতে তিনি ধন্বন্তরি কৌশলও তাদের শিখিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছেন, ‘দু’দিনের মধ্যে একটি ফোন নম্বর সবাইকে জানিয়ে দেব। কোনো সরকারি অফিসে কোনো কাজের জন্য কেউ ঘুষ চাইলে দিতে রাজি হয়ে যাবেন। তারপর ওই নম্বরে ফোন করে জানাবেন। আমরা ঘুষ দেওয়ার দিন হাতেনাতে পাকড়াও করব।’ শুদ্ধিকরণের কি চমৎকার দাওয়াই! সেই ‘নতুন বিশ্ব’ গড়ার আওয়াজ তোলা সোস্যাল ফোরামের কণ্ঠেরই প্রতিধ্বনি শোনা যায়। যাঁরা বলেন, ‘আমরা অস্ত্র প্রতিযোগিতা, পারমাণবিক অস্ত্র এবং সামরিক স্থাপনার বিরোধিতা করি। অস্ত্রের জন্য বিশ্ব অর্থনীতিতে বাজেটের যে অংশ খরচ হচ্ছে তা দিয়ে জনগণের বিশাল অংশের অনাহার দূর করা উচিত। জীবন রক্ষার ওষুধ, নবায়নযোগ্য শক্তি এবং ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির জন্য তা ব্যয় করা যেত।’ 
কথাগুলো খুবই শ্রুতিমধুর। বিপ্লব বিপ্লব ভাব আছে। কিন্তু এর মর্মমূলের সারশূন্যতা প্রকাশ হয় যখন তাঁরা এ কথার মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন। বলেন না যে, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার বা সামরিক স্থাপনা ইত্যাদি যে বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তা অটুট রেখে বা তার মধ্যে থেকে এগুলো কখনই রোধ করা সম্ভব নয়। এ ব্যবস্থা যারা টিকিয়ে রাখতে মরিয়া- এ হচ্ছে তাদের সদুপদেশ দেওয়া। এভাবে সত্যিকারের কোনো পরিবর্তন আনা অসম্ভব। কেজরিওয়াল মূলত তাই করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত জনগণই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার দিক থেকে।
হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে উদ্ভাসিত কেজরিওয়ালের অতীতটা এক ঝলকে দেখে নেয়া যাক। দু’বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের আগে তার ক্যারিয়ারের ভিত রচিত হয়েছিল প্রকৌশলী হিসেবে। এরপর ভারতীয় রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন। দু’হাজার ছয় সালে যুগ্ম কর কমিশনার হিসেবে চাকরি থেকে স্বেচ্ছা অব্যাহতি নেন। দু’হাজার এগারোয় জনলোকপাল বিল পাসের দাবিতে আন্না হাজারের সঙ্গে আন্দোলনে নেমে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। তবে আসল ঘটনা ঘটেছে এর অনেক আগে। দু’হাজার ছয়ে চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার আগে, লিয়েনে গিয়ে ‘পাবলিক কজ রিসোর্স ফাউন্ডেশন’ নামে একটি এনজিও খোলেন। ‘সুশাসন’ বিষয়ে নসিহত করাই ছিল এর কাজ। কেজরিওয়াল করেছিলেনও। এতটাই যে র‌্যামন মেগসেসাই এসে তার ঝুলিতে জমা হলো। আমজনতার প্রতি দরদ তার তখন থেকেই। পুরস্কারের টাকা তিনি দান করেন ওই এনজিওকেই। উর্দুতে একটি প্রবাদ আছে- যার আক্কেল আছে তার জন্য ইশারাই যথেষ্ট। এ সব পুরস্কার কেন দেওয়া হয়, কাদের দেওয়া হয়, নিজ দেশে কোন বলয়ে কার স্বার্থে তারা বাজ করেন-এগুলো মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো বোঝেন। কেজরিওয়ালকে নিয়ে অনেকেই অনেক রকম তত্ত্ব ঝেড়েছিলেন। আমাদের দেশে এমন কেজরিওয়াল কেন জন্মায় না তা নিয়ে হা হুতাশও করেছেন কেউ কেউ। মার্কসের ল্যাবরেটরিতে ঢুকিয়েও কাটাছেঁড়া। গান্ধীকে যেমন করা হয়েছে। 
লেখার শুরুতে যা উল্লেখ করেছি, গান্ধীর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের উন্মেষ ঘটেছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অত্যাচারে পিষ্ট জুলু উপজাতীয় কৃষক সম্প্রদায়ের সংগ্রাম থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ব্রিটিশরা তখনই চিনেছিল তাকে। তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দমনের মিশন দিয়ে তাই দ্রুত ভারতে পাঠায় তাকে। গান্ধী আজীবন সে দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছে। তার অনুসারী বলে পরিচয় দেওয়া অরবিন্দ কেজরিওয়ালকেও শেষ পর্যন্ত চিনেছে।

প্যানেল/মো.

×