ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২

বাবা মানে আত্মত্যাগ ও ভালোবাসা

জ্যাষ্টিন গোমেজ

প্রকাশিত: ১৯:৪৪, ১৪ জুন ২০২৫

বাবা মানে আত্মত্যাগ ও ভালোবাসা

ভোরের প্রথম আলো ফুটে ওঠার আগেই একজন বাবা ঘুম ছেড়ে ওঠে পরিশ্রম শুরু করেন পরিবারের জন্য। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তার মনে চিন্তা আর দুশ্চিন্তা থাকে কিভাবে তার পরিবারকে আরেকটু ভালো রাখা যায়। একজন বাবার চোখে হয়তো ক্লান্তির চিহ্ন দেখায়। কিন্তু সেই ক্লান্তির আড়ালে লুকিয়ে থাকে এক অমলিন ভালোবাসার গল্প। যে গল্পের বুনিয়াদ পরিবারের সুরক্ষা, খাদ্য, আশ্রয় এবং ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি। তারা হয়তো মুখে কম কথা বলেন, তবুও তাদের কাজ তাদের ভালোবাসার গন্ধ ছড়ায়। বাবা হয়তো খুব কমই বলে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। কিন্তু তার প্রতিটি কাজই সেই ভালোবাসার নিদর্শন। আর তাই তো একজন বাবা ভোরের অন্ধকারে উঠে চলে পড়েন কর্মস্থলে, যেন তার সন্তান স্বপ্ন পূরণে সক্ষম হয়। এমন বাবারাই কখনো কল-কারখানায় কঠোর পরিশ্রম করেন, শরীর কষ্টে ভোগে, তবু মন থেকে কখনো হাল ছাড়েন না। আবার কেউ কেউ একাধিক কাজ করেন, আর্থিক সংকটের মধ্যে দিয়ে পরিবারকে চালিয়ে নিয়ে যেতে। বাবারা শুধু অর্থায়ন করে নয় বরং পরিবারকে মানসিক শক্তি, ধৈর্য এবং আশা দেন। আর এই নিঃশব্দ ভালোবাসা অনেক সময় চোখে পড়ে না।
বাবা ও সন্তানের মধ্যে থাকে একটি অদৃশ্য, অজানা বন্ধন থাকে, যা কথায় প্রকাশ হয় না। এটি গড়ে ওঠে একসঙ্গে কাটানো মুহূর্ত, সংগ্রাম ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ওপর। আমরা এই বন্ধন হৃদয়ে বহন করি। একটি নিঃশব্দ সূত্র যা অতীত থেকে বর্তমান, বাবা থেকে সন্তান, হৃদয় থেকে হৃদয়ে যুক্ত করে। আমরা বড় হওয়ার পরেও এই সংযোগ মুছে যায় না। যার ফলে আমরা তার অভ্যাসগুলো অনুকরণ করি, তার কথা পুনরাবৃত্তি করি এবং তার পরামর্শ চাই। এমনকি তিনি যখন পরলোকগত হন হতাশার সময়ে তার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে তার কাছে পরামর্শ চাই। বাবাদের ভালোবাসা প্রকাশ পায় নির্ভরযোগ্য উপস্থিতি, স্থায়িত্ব ও নীরব উৎসাহের মাধ্যমে। আর এই ভালোবাসা আমাদের ধৈর্য, সম্মান ও করুণা শেখায়, কথার মাধ্যমে নয়, কাজের মাধ্যমে। আর এই জন্য মানুষটি কথা কম কিন্তু তার সন্তানের হাত ধরে রাখে আর নীরব বার্তা দেয় ‘তুমি এখানে নিরাপদ আছো।’ শৈশবে বাবারা যেমন নীরব রক্ষক এর ন্যায় দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখতেন আর বলতেন ‘আমি আছি, তুমি নিরাপদ’ সেই সুরক্ষা ও বিশ্বাসের জাল আমাদের জীবনের ঝড় থেকে বাঁচায়। 
কিন্তু বর্তমান সমাজে মায়েদের সম্মান ও ভূমিকার গুরুত্ব বাবাদের চেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। পরিবারে অর্থনৈতিক ও নৈতিক স্তম্ভ হওয়া সত্ত্বেও অনেক সময় তাদের অবদানকে তুচ্ছ করে দেখা হয়। বাবারা সারা জীবন পরিশ্রম করে সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুললেও, সেই ত্যাগ ও ভালোবাসা খুব কমই ভাষায় প্রকাশ পায়। অনেক সন্তান মায়ের যত্ন ও স্নেহকে কেন্দ্র করে আবেগ প্রকাশ করলেও, বাবার নিঃশব্দ আত্মত্যাগকে ‘দায়িত্ব’ বলে মনে করে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে অনেক বাবাই একাকিত্ব, মানসিক চাপ ও অবহেলার মধ্যে পড়ে যান। তারা কথা বলা ও শোনার মানুষ পান না, ভালোবাসার ভাষা পান না। এমনকি অনেক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের মতামতকেও গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সমাজে পিতৃত্বের প্রতি এই অবহেলা কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়ে কষ্টের জন্ম দেয় না, বরং বৃহৎ পরিসরে একটি অসন্তুষ্ট প্রজন্ম তৈরি করে। যেখানে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতার ভারসাম্য হারিয়ে যেতে বসেছে।
তাই বাবা দিবসে আমরা বাবার নীরব ভালোবাসা এবং আমাদের অজানা বন্ধন স্মরণ করি। সেই মানুষটিকে সম্মান জানাই, যিনি কথা কম বলেও আমাদের হাত ধরে রেখেছিলেন। তাকে কেবল তার কাজের জন্য নয়, তার অস্তিত্বের জন্য সম্মান দেই। চলুন প্রতিজ্ঞা করি বাবাদের নীরব শক্তিকে ভুলে যাব না। তাদের আত্মত্যাগ, নীরব নির্দেশনা এবং অসীম ভালোবাসার জন্য কৃতজ্ঞ থাকব। কারণ প্রতিটি সফল সন্তানের পেছনে থাকে এমন একজন বাবা, যিনি নীরব ভালোবাসায় গড়েছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ভালোবাসা। ভবিষ্যতের পিতাদের জন্য এটি মনে রাখা জরুরি যে, বাবা হওয়া শুধু একটি সম্পর্ক নয়, এটি একটি দায়িত্ব ও মূল্যবোধ। বাবা হওয়া সহজ নয়। এটি ধৈর্য, আত্মত্যাগ, ভালোবাসা ও নির্বিচারে পাশে থাকার এক দীর্ঘ যাত্রা। একজন বাবাকে শুধু উপার্জনকারী নয়, সন্তানের জীবনে আদর্শ চরিত্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যিনি নৈতিকতা শেখান, আবেগ বোঝেন এবং সন্তানের প্রতিটি সাফল্য ও ব্যর্থতায় ছায়ার মতো পাশে থাকেন। ভবিষ্যতের পিতারা যদি তাদের সন্তানদের সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চান, তবে তাদের আগে নিজেকে গড়তে হবে- সহানুভূতিশীল, মনোযোগী এবং ইতিবাচক চিন্তাধারার একজন মানুষ হিসেবে। নতুন প্রজন্মের পিতৃত্ব আর কেবল কর্তৃত্বের নয়, এটি হবে সহানুভূতির, বোঝাপড়ার এবং সত্যিকারের ভালোবাসার এক নতুন অধ্যায়। নতুন প্রজন্মের বাবাদের জন্য পিতৃত্ব একটা ‘রোল মডেল’ হওয়ার সুযোগ। নতুন বাবাদের উচিত পুরানো ধারণা ভেঙে সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা সম্পর্ক গড়ে তোলা, তাদের অনুভব করা এবং শেখানো, কীভাবে একজন ভালো মানুষ হওয়া যায়। সন্তানকে শুধু পথ দেখান না, বরং সেই পথ একসঙ্গে হেঁটে পাশে থাকাই হোক নতুন বাবাদের অঙ্গীকার। 


লেখক : সাংবাদিক
[email protected]

প্যানেল

×