
চীনা পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে ১৪৫ শতাংশ শুল্কারোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এটা কার্যত চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো। চীন পাল্টা যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর ১২৫ শতাংশ শুল্ক ঘোষণা করেছিল। এর মাধ্যমে বিশ্বের দুই বৃহৎ অর্থনীতির মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ আরও তীব্র রূপ পরিগ্রহ করেছে। বিশ্বের ২য় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন এখন শুল্ক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে এবং এর ফলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি গতি কিছুটা ধীর হয়েছে। তবে যুুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশের ওপর নতুন শুল্কারোপ ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করে। বেজিং বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত অস্বাভাবিক উচ্চ শুল্ক আন্তর্জাতিক ও অর্থনৈতিক বাণিজ্যনীতি, মৌলিক অর্থনৈতিক আইন এবং সাধারণ বিচার-বিবেচনার গুরুতর লঙ্ঘন করেছে। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে স্বপ্রণোদিত মন্দা ও সরকার ব্যবস্থা ভাঙনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেন। গত ১২ মে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সমঝোতার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধে ৯০ দিনের বিরতি দেওয়া হয়েছে। যৌথ বিবৃতি অনুযায়ী, ১৪ মে থেকে যুক্তরাষ্ট্র চীনের পণ্যে আরোপিত ১৪৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে ৩০ শতাংশে নিয়ে আসবে। চীনও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক ১২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনবে। উভয় পক্ষ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা চলমান রাখতে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে একমত হয়েছে। এর আগে সুইজারল্যান্ডের জেনেভোয় বিশ্বের বৃহত্তম এই দুই অর্থনীতির দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে সপ্তাহব্যাপী আলোচনা হয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি পুরোপুরি বিপন্মুক্ত এমন কথা এখনই বলা যাবে না। মন্দার ঝুঁকি রয়ে গেছে এখনো, যদিও অর্থনৈতিক পতনের আশঙ্কা কিছুটা কমেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের এই ফিরে আসা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্র পরস্পরের পণ্যের ওপর শুল্কারোপ করলেও এর প্রভাব পড়েছিল বিশ্ব বাণিজ্যে। এমন উদ্যোগ অব্যাহত থাকলে আরও অনেক রাষ্ট্র এতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। মার্কিন শুল্কের প্রভাব কিছুটা লাঘব করতে বিকল্প বাণিজ্য অংশীদার খুঁজছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে পণ্য রপ্তানিকে খরচে করে তুলে শুল্ক। চীনে ব্যবসার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে ১৪৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে শুল্ক। ফলে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে হয়তো পণ্যের দাম বাড়াতে হবে বা বাড়তি শুল্ক নিজের বহন করতে হবে। নতুবা উভয়পথই বেছে নিতে হবে। এর ফলে, তাদের মুনাফা কমবে; যা অর্থনীতিতে তাদের অবদান কমিয়ে আনবে। এতে করে প্রবৃদ্ধি কমে আসতে পারে। কারণ, দেশটির অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি রপ্তানির ওপরই নির্ভরশীল। দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে আসছে, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে চীন বিভিন্নভাবে সুযোগের অপব্যবহার করছে; যা রোধ করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। আমদানি শুল্ক হচ্ছে ট্রাম্পের কৌশলগত অস্ত্র। তবে এই অস্ত্রের প্রভাব আন্তর্জাতিক ভূকৌশলগত রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্কের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে বেজিং। শুল্ক সম্পর্কিত ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পর সমগ্র বিশ্বের শেয়ারবাজারে একযোগে ধস নামে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে বহুপক্ষীয় বাণিজ্যব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, ট্রাম্পের শুল্ক নীতির মধ্য দিয়ে তা অবসানের পথ প্রশস্ত হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। একইসঙ্গে বৈশ্বিক মন্দারও আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লেইন মন্তব্য করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সব পণ্যতে নতুন শুল্কারোপের সিদ্ধান্তকে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় আঘাত।
বিশ্বায়ন হলো এক রাষ্ট্রের ওপর অন্য রাষ্ট্রের নির্ভরশীলতা। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য হলো সেটা আঞ্চলিক নির্ভরশীলতা। আর এশিয়ার কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য হলে সেটাকে বলে বিশ্বায়ন। বিশ্বায়নকে একটি শক্তিশালী প্রক্রিয়া বলা যায়; যার মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র ও অ-রাষ্ট্রীয় কারক নিজেদের মধ্যে বহুমাত্রিক ও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলে। অ-রাষ্ট্রীয় কারক বলতে বহুজাতিক সংস্থা, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও প্রযুক্তিগত বৃহৎ সংগঠনগুলোকে বোঝায়। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষমতা, সংস্কৃতি, বাজার, রাজনীতি, মূল্যবোধ, আদর্শ, নাগরিকতার মতো বুনিয়াদি ধারণাকে জাতিরাষ্ট্র নামক ভৌগোলিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে মুক্ত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রের ভৌগোলিক গণ্ডি পেরিয়ে মানুষ, পরিষেবা, পুঁজি, প্রযুক্তি, তথ্যের ও ধারণার উন্মুক্ত প্রবাহ ও প্রভাব বিশ্বায়নের প্রাথমিক শর্ত। বিশ্বায়ন আবার বিভিন্ন দেশের কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, বিশ্বায়ন যেমন একদিকে রাষ্ট্রকে দুর্বল করেছে, একইসঙ্গে রাষ্ট্র বিশ্বায়নের প্রভাব বিস্তারকে নিয়ন্ত্রণ ও সীমিত রাখার বিষয়ে উদ্যোগী হতে বাধ্য হয়েছে। অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্ত হতে অনেক বৃহৎ দেশ বিশ্বায়নবিরোধী নীতি গ্রহণ করেছে। চীনের ওপর শুল্ক বসিয়ে ট্রাম্প এই নির্ভরশীলতা কমানোর পক্ষে। স্নায়ুযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ও অভিবাসন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্র্রসহ অনেক দেশ শুল্ক ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করছে। ট্রাম্প মনে করেন, বিশ্বায়নই যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শিল্প ও কর্মসংস্থান হারানোর জন্য দায়ী। বিশ্বায়নের কারণে চীনে সকল কারখানা চলে যাওয়ায় মার্কিন নাগরিকরা কাজ পাচ্ছেন না। তাই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে যারা বিনিয়োগ করবেন, তাদের বিশেষ ছাড় প্রদানের কথা বলেছিলেন তিনি।
বাণিজ্যযুদ্ধ হচ্ছে দুটি দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব। একটি দেশের অন্যায্য বাণিজ্যিক কার্যকলাপের প্রতিশোধ বা কোনো দেশকে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করতে আমদানির ওপর শুল্ক ও অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার মাধ্যমে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, শুল্ক অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। কারণ, এটি দেশগুলোর জন্য অর্থনৈতিক বিশেষায়নের সুবিধা গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেশীয় শিল্পের অতিরিক্ত সুরক্ষার জন্য এ ধরনের শুল্কারোপ করা যায়। যেমন: উৎপাদন বা প্রতিরক্ষা খাত। কোনো একটি দেশ অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে বা শত্রুরাষ্ট্রের অর্থনীতির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে কোনো একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধের সূচনা করতে পারে। বিশে^র ওপর চীনের প্রভাব প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দেশটি একটি সুপার পাওয়ার হয়ে উঠেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। চীন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ পণ্য সরবরাহকারী রাষ্ট্র। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের মোট আমদানি পণ্যের ১৬ শতাংশ চীন থেকে এসেছে। অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র চীনের উত্থান সামাল দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে শুল্কারোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যমূল্যের চরম যে ঊর্ধ্বগতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তার মূলে চীনের ওপর উচ্চ শুল্কারোপ সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। বাণিজ্যযুদ্ধে যেহেতু পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়, তাই শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ জনগণ। দাম বৃদ্ধি পেলে ক্রেতারা কম কিনবেন, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি কমবে। ট্রাম্পের শুল্কনীতির সমালোচনা করে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার মহাসচিব রেবেকা গ্রিনস্প্যান বলেছেন, ট্রাম্পের এই নীতি বিশ্ব উন্নয়নের পরিপন্থি। সার্বিকভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়তে চলেছে। অবাধ বাণিজ্য উন্নয়ন ও বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। যে কারণে বাণিজ্য নিয়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা উচিত নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন, বাণিজ্যযুদ্ধে কোনো পক্ষই জয়ী হয় না। তিনি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সহযোগী দেশগুলোতে সফর করছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে এ ধরনের পরস্পরবিরোধী বাণিজ্য পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদি হলে তা বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতিকে ধীর করবে এবং এর ফলে বৈশ্বিক কর্মসংস্থানসহ স্বল্প মাত্রায় রপ্তানি করে এমন রাষ্ট্রগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। উচ্চশুল্ক বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দেয়। শুল্ক সম্পর্কিত ঘোষণাগুলোর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে অর্থ বাজারগুলোতে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, চীনের সঙ্গে তিনি ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যযুদ্ধ শেষ করতে আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বলেছেন, দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি করতে পারলে বাণিজ্যনীতিতে আরও স্থিরতা আসবে। ট্রাম্প এ প্রসঙ্গে বলেন, চীনের সঙ্গে চুক্তি করতে পারলে ভালো লাগবে। তিনি আরও বলেন, মনে হয় উভয় দেশের জন্য ভালো কিছু একটা করা সম্ভব হবে। ট্রেড পলিসি নিয়ে বলতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন, শুল্ক থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব জাতীয় ঋণ পরিশোধে ব্যবহৃত হতে পারে। ট্রাম্প সতর্ক করে বলেন, যদি চুক্তি না করা হয়, তাহলে ৯০ দিনের বিরতির পর উচ্চতর শুল্ক আবারও বলবৎ করা হবে। তিনি বলেন, তার সরকার কোনো দেশ বা কোম্পানিকে ছাড় দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে না। বিশ্লেষকদের মতে, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ কারও জন্যই সুফল বয়ে আনবে না। এতে অর্থনীতির প্রবাহ ব্যাহত হয়, এই যুদ্ধে শেষমেশ কেউ জিতে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। এর জবাব কখনোই বাণিজ্যযুদ্ধ হতে পারে না। আলোচনার টেবিলে বসেই এর সমাধান করা উচিত। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাভিত্তিক বহুপক্ষীয় বাণিজ্যব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীন একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। ইউরোপীয় কমিশনের মারোস সেফকোভিচ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অন্য সদস্যদের, বিশেষ করে চীনের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে চায়, যাতে বৈশ্বিক বাণিজ্য স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৪৩ শতাংশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দখল করে রেখেছে। যদি তারা সর্বাত্মক বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং সেটা তাদের প্রবৃদ্ধিকে ধীর করে দেয় বা দুই দেশকে আর্থিক মন্দার কবলে পড়ার দিকে ঠেলে দেয়, তাহলে তার প্রভাব বিশ্বের অন্যান্য দেশেও পড়বে। কারণ, এর প্রভাব সম্ভাব্য ধীর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির আকারে অন্যান্য দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। বৈশ্বিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বর্তমানে চলমান এই শুল্কযুদ্ধ শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন নয়, বৈশ্বিক সরবরাহ চেন এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। যুক্তরাষ্ট্রের এক হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ৫৮২.৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়েছিল। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা জানিয়েছে, চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে দুই দেশের মধ্যে পণ্যবাণিজ্য ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। এটি মোট বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৩ শতাংশ। সংস্থাটির প্রধান মনে করেন, এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতির বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।
তবে চীন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হামলা মোকাবিলায় শক্ত অবস্থানে রয়েছে তারা। এমনকি চীনের আরোপিত শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর ট্রাম্প বলেছিলেন, শুধু শুল্কারোপ করেই চীনকে সহজে হার মানাতে বাধ্য করা হবে। কিন্তু বাস্তবে তা চরম বিভ্রান্তিকর প্রমাণ হয়েছে। কারণ, চীন আত্মসমর্পণ করেনি। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি বাণিজ্যযুদ্ধের মধ্যেও চীনের অর্থনীতি প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ বছরের প্রথম ৩ মাসে ৫.৪ শতাংশ বেড়েছে; যা তাদের প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গেছে। তবে বাণিজ্যযুদ্ধের উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণে বছরের বাকি অংশে দেশটির অর্থনীতির সম্ভাবনা কিছুটা ম্লান হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তবে চীন জিডিপির যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে শুল্ক বৃদ্ধির প্রতিফলন ঘটেনি। তবে মে জুন নাগাদ এর প্রভাব পরিষ্কার হবে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ আরও তীব্র রূপ নেওয়ার প্রেক্ষাপটে চীন হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, চীনের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে কোনো রাষ্ট্র যেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি না করে। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমান মর্যাদায় পরামর্শের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিরোধ মেটানোর প্রচেষ্টাকে চীন সম্মান করে। তবে যদি কোনো পক্ষ চীনের স্বার্থের ক্ষতি করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতে যায়, তাহলে চীন এর তীব্র বিরোধিতা করবে। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আরও জানায় যে, চীন তার বৈধ অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং সক্ষম। একইসঙ্গে, সকল অংশীদারদের সঙ্গে সংহতি জোরদারে আগ্রহী চীন। তবে ট্রাম্প সম্প্রতি চীনের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি নিশ্চিত করার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। নিকট ভবিষ্যতে চীনের ওপর তার শুল্ক উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে বলেছিলেন ট্রাম্প। চীন বলেছিল, বেজিং ওয়াশিংটনের কোনো অর্থনৈতিক আঘাতকে এড়িয়ে চলবে না। তবে আলোচনার দরজা উন্মুক্ত রয়েছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্ক চীনের উৎপাদন খাতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। গত এপ্রিল মাসে চীনের কারখানার উৎপাদন গত ১৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংকুচিত হয়েছে। ন্যাশনাল রিটেইল ফেডারেশনের মতে, ২০২৫ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি অন্তত ২০ শতাংশ কমবে। আর চীন থেকে আমদানি আরও বেশি হারে কমবে। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অবিশ্বাস চরমে পৌঁছেছে। চীন জানিয়েছে, সাম্রাজ্যবাদী চাপে তারা মাথা নত করবে না। চীন বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রকে আগে শুল্ক তুলে নিতে হবে। তাদের অবস্থান অপরিবর্তিত এবং তারা তাদের স্বার্থ রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবে। তবে পরিশেষে উভয় দেশ প্রাথমিকভাবে ৯০ দিনের জন্য শুল্ক অনেকাংশে কমিয়ে আনতে সম্মত হওয়ায় বিশ্ববাজারে ব্যাপক উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল