
বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা খুব এখনো তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। তাই উন্নত প্রযুক্তি, দক্ষ জনবল ও নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা ব্যবস্থার ঘাটতির কারণে প্রতিবছর দেশের প্রায় ৫ থেকে ৭ লাখ মানুষ চিকিৎসার জন্য পাড়ি জমান বিদেশে। এসব রোগী মূলত ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশগুলোতে চিকিৎসা নিতে যান। এতে বছরে গড়ে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয় শুধু চিকিৎসা খাতে। এই ব্যয় শুধু অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি নয় বরং দেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামোতে আস্থাহীনতারও প্রতিচ্ছবি।
কেন বিদেশমুখী হচ্ছে মানুষ? প্রথমত দেশে উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব, বিশ্বস্ত ও মানসম্পন্ন চিকিৎসা সেবার সংকট, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও কারিগরি জনবলের ঘাটতি এবং দীর্ঘসূত্রতা ও স্বাস্থ্যসেবায় দুর্নীতি ইত্যাদির কারণে। এসব সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর, গবেষণাভিত্তিক এবং দক্ষতাসম্পন্ন একটি স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে তোলার বিকল্প নেই। সেখানেই বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং কি?
বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং– চিকিৎসা বিজ্ঞান ও প্রকৌশলবিদ্যার একটি সংমিশ্রণ, যেখানে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়। এই শাখায় কাজ করা পেশাজীবীরা কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি, রোবোটিক সার্জারি, ডিজিটাল হেলথসেবা, টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল ইমেজিং, বায়োসেন্সর ডিজাইন, বায়োমেটেরিয়াল উন্নয়নসহ নানান গবেষণার সাথে যুক্ত থাকেন।
কেন পড়বেন বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ?
দেশের স্বাস্থ্যখাতে আত্মনির্ভরতা: দেশে মেডিকেল ইকুইপমেন্ট তৈরি, রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নে দক্ষ জনবল তৈরি হলে বিদেশনির্ভরতা কমবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে।
বহুমাত্রিক ক্যারিয়ার সম্ভাবনা: এই বিষয়ে পড়াশোনা করে শিক্ষার্থীরা হসপিটাল, ক্লিনিক, গবেষণাগার, মেডিকেল ডিভাইস কোম্পানি, হেলথ টেকনোলজি স্টার্টআপ এমনকি প্রশাসনিক ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও কাজ করতে পারেন।
উচ্চশিক্ষা ও বৈশ্বিক সুযোগ: বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং একটি বিশ্বজুড়ে চাহিদাসম্পন্ন সাবজেক্ট। বিদেশে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজের বিশাল সুযোগ রয়েছে। সামাজিক প্রভাব ও মানবসেবা: এই বিষয়ে কাজ করা মানে প্রযুক্তি দিয়ে সরাসরি মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অবদান রাখা। এটি একটি সম্মানজনক ও মানবিক পেশা।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অভিমত
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং (বিএমই) বিভাগের সভাপতি সহকারী অধ্যাপক ড. মো. খাইরুল ইসলাম বলেন, "বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিভিন্ন ফিল্ড যেমন–ক্লিনিক্যাল, রিজেনারেটিভ বা রিপেয়ার মেডিসিন, হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট, বায়োমেটেরিয়ালস, প্রোস্থেটিক ইত্যাদিতে যারা গ্র্যাজুয়েশন করবে, তারা চাকরিক্ষেত্রে ভালো সুযোগ-সুবিধা লাভ করবে। তাই এসব দিক বিবেচনায় একজন শিক্ষার্থীর জন্য বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করা যথেষ্ট যৌক্তিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।”
ইবির বিএমই বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তহমিনা ইয়াসমিন তন্বী বলেন, “বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিজ্ঞানের এমন এক শাখা, যেখানে প্রযুক্তি ও চিকিৎসা একসঙ্গে কথা বলে। যারা বিজ্ঞানকে ভালোবেসে প্রযুক্তি দিয়ে চিকিৎসা ও মানুষের জীবনমান উন্নত করতে চায়—তাদের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া উচিত। বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া মানে শুধু ডিগ্রি নেওয়া নয়, বরং প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের জীবনে বাস্তব পরিবর্তন আনার শক্তি অর্জন। এর মাধ্যমে উন্নত ক্যারিয়ার গড়া তো সম্ভবই, পাশাপাশি একে মানবসেবার ব্রত হিসেবেও গ্রহণ করা যায়।”
খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) বিএমই বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আজমাঈন ফায়িক বলেন, “বিএমই হচ্ছে একমাত্র শাখা যেখানে প্রকৌশল ও জীবনবিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটেছে। এটি এমন এক বিষয় যা অন্য যেকোনো ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার জ্ঞানকে এক্সটেন্ড করে, হিউম্যান বডিতে অ্যাপ্লাই করে বাস্তব সমস্যা সমাধানে ব্যবহৃত হয়।”
চিকিৎসা বিজ্ঞানের আধুনিকায়নে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং একটি নিরব বিপ্লব ঘটাচ্ছে। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও এই শাখার চাহিদা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। তরুণদের কাঁধে ভর করেই তৈরি হবে ভবিষ্যতের আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অভিমতই প্রমাণ করে, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং শুধুমাত্র একটি সাবজেক্ট নয়—এটি ভবিষ্যতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার এক স্বপ্নযাত্রা।
আঁখি