ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৫ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

নজরুল জন্মে জেগে ওঠে শব্দ—জ্বলে ওঠে জাতি

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান, লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর 

প্রকাশিত: ০১:৩৮, ২৫ মে ২০২৫

নজরুল জন্মে জেগে ওঠে শব্দ—জ্বলে ওঠে জাতি

ছবিঃ সংগৃহীত

বাংলা সাহিত্যের বুকে তিনি এক অনির্বাণ শিখা। চিরকাল ধিক্কার জানিয়েছেন নিস্তব্ধতা ও পরাধীনতাকে। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম—কবিতার চেয়ে বড় এক জীবন, শব্দের চেয়েও উচ্চকণ্ঠ এক আত্মা। 

১৮৯৯ সালের ২৫ মে চুরুলিয়ার মাটিতে তাঁর জন্ম ছিল যেন বাংলা সাহিত্যের হৃদয়ে প্রথম বজ্রপাত। এই বজ্রপাত কোনো ধ্বংস ডেকে আনেনি, বরং জাগিয়ে দিয়েছে অনিদ্রা যুগের স্বপ্ন।

নজরুল জন্মে বাংলা শুধু এক কবিকে পায়নি, পেয়েছে এক বিপ্লব। তিনি ছিলেন না কেবল প্রেমিক, দ্রোহী, গীতিকার, গায়ক কিংবা সাংবাদিক—তিনি ছিলেন এক অবিস্মরণীয় সত্তা, যিনি নিজের ভিতরেই ধারণ করতেন এক অব্যক্ত কাব্যচেতনা, আর বহির্প্রকাশে তিনি ছিলেন এক আগুনঝরা ঝড়।

“আমি বিদ্রোহী ভগবান, বিশ্ব-বিধাতার চেয়েও মানবের মুক্তি করি পবিত্র ঘোষণা।”

এই পংক্তির মধ্যে নিহিত এক তপ্ত আত্মপ্রত্যয়। তাঁর কবিতা, তাঁর গান, তাঁর কলম—সবই ছিল এক যুদ্ধ ঘোষণা। যতটুকু তাঁর কবিতায় দ্রোহ, ততটাই তাঁর গানে মমতা, মাধুর্য, ভালোবাসা। তিনি একদিকে যেমন লিখেছেন—

"রক্তঝরা এ বেদনারই গান শুনে হেসেছে শিব-মহাকালী," অন্যদিকে গেয়েছেন— "ভুল করেছ বন্ধু, ভুল করেছ / সুধা বলে যাহারে হেনেছ বিষ!"

এই দ্বৈতসত্তার কবিই নজরুল, যিনি একইসঙ্গে ছিলেন আলো ও অন্ধকারের সংলগ্ন প্রান্তর। তাঁর কাব্য ছিল দিগন্তের মতো—অশেষ, উদার ও অসীম।

নজরুল তাঁর সময়ের নির্যাতিত মানুষদের জন্য কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর কবিতা ধ্বনিত হয়েছে ক্ষুধার্তের কণ্ঠে, বঞ্চিতের চোখে, বিপ্লবীর বুকের ভিতর। যখন তিনি লেখেন, “আমি সেই দিন হবো শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,”—তখন তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে এক অবিনাশী শপথ।

কিন্তু নজরুল একমাত্র দ্রোহেই সীমাবদ্ধ নন। তিনি প্রেমের কবি, ভালোবাসার পুরোহিত। তাঁর লেখা “মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী” থেকে শুরু করে “জাগো অনশন-শৃঙ্খল ভাঙো”—সবই এক কবির অন্তর-নিঃসৃত বহুবর্ণ অনুভূতির স্বাক্ষর।

তিনি যে কেবল মুসলিম সমাজের ভাষ্যকার ছিলেন না, তার প্রমাণ তাঁর গানে দেবী-দেবতা, কালী-শিব, ঈশ্বর ও প্রেম—সব এক সুরে গাঁথা। নজরুলের ভাষা কখনও প্রার্থনার, কখনও প্রতিবাদের, আবার কখনও প্রেমিকের পিপাসার মতো তৃষ্ণাতুর।

আজ, যখন বিশ্ব বিভাজিত, জাতি দোদুল্যমান, বিশ্বাস অসহিষ্ণু, তখন নজরুলই আমাদের শেষ আশ্রয়। তাঁর কণ্ঠে আজও উচ্চারিত হয় সহমর্মিতা, সাম্য আর শান্তির এক দুর্লভ সুর।

তাঁর জন্মদিন তাই শুধু স্মরণ নয়, এক নবজাগরণের দিন। এ এক প্রতিজ্ঞার দিন—আমরা তাঁর ভাষায়, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে, তাঁর সুরে পৃথিবীকে দেখতে শিখি।

নজরুল জন্মে, তাই বাংলা আজও জাগে।
নজরুল বাঁচে, তাই মানুষ আজও স্বপ্ন দেখে।
নজরুল বাজে, তাই কবিতা আজও বিদ্রোহ করতে জানে।

ইমরান

×