ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৫ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

নজরুলকে ধারণ করুক তরুণ প্রজন্ম

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:৫২, ২৪ মে ২০২৫

নজরুলকে ধারণ করুক তরুণ প্রজন্ম

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মজয়ন্তী দিবস আজ। আজকের দিনে তাঁকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা। কবি কাজী নজরুল ইসলাম অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। যে কারণে নানা কাজ বা সিদ্ধান্তে প্রতিনিয়ত স্মরণ করি। জাতীয় কবি নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার সিদ্ধান্তটি ছিল চমৎকার। তাঁর চিন্তা-চেতনা আমাদের কর্ম ও সামাজিক জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কবি নজরুল স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন ১৯৭২ সালের ২৪ মে। সেদিন ছিল কবির ৭৩তম জন্মবার্ষিকী। কিন্তু ১৯৪২ সালে তার জাগতিক চেতনা লুপ্ত হয়। কবি হিসেবে তার মৃত্যু হয় ৭৯ বছর আগে। যদি স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতেন, তিনি বিশ্বের ইতিহাসে অনেক কবিকে ছাড়িয়ে জেতেন। কারণ তাঁর মেধা এবং প্রজ্ঞা ছিল অসাধারণ।
বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে তার সম্মান ও স্বীকৃতি পাওয়া ছিল যথার্থ। নজরুল যেমন দুঃখী মানুষের কষ্ট দেখে ফুঁসে উঠেছিলেন, আমাদেরও তাঁর চেতনাকে ধারণ করে দুঃখী, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। তিনি ছিলেন মানবতাবাদী, সাম্যবাদী দর্শনে বিশ্বাসী। কবির চিন্তা ভাবনা ছিল অসাম্প্রদায়িক। ছিলেন স্বাধীন চিত্তের অধিকারী। মানুষের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপোসহীন। তাই সচেতন নাগরিক হিসেবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আদর্শ ও চেতনা আমাদের জন্য সর্বদাই অনুকরণীয়, অনুসরণীয় এবং চিরন্তন। তাঁর মতো সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। কিন্তু আমরা কথা বলতে পারছি না নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে। কবি নজরুলকে কবিতার রাজনীতিক বলা যায়। তেমনি রাজনীতির কবি বলা যায়। কারণ তাঁর নানা গান ও কথা আমাদের নানা আন্দোলনে উৎসাহ জোগায়। তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ ও দার্শনিক- যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বাংলা সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে চির স্মরণীয়। নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। স্থানীয় এক মসজিদে সম্মানিত মুয়াজ্জিন হিসেবেও কাজ করেছিলেন। কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন।
বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম উসকে দিয়ে গেছেন তরুণ প্রজন্মকে। যদি করার মতো কোনো কাজ কেউ করতে পারে-তাহলে তা তরুণই, অন্য কেউ নন। তাই কবি নজরুল তার বিভিন্ন লেখা ও অভিভাষণে করে গেছেন তারুণ্যের জয়গান। তিনি বলেন ‘তারুণ্যকে, যৌবনকে আমি যেদিন হইতে গান গাহিতে শিখিয়াছি সেইদিন হইতে বারেবারে সালাম করিয়াছি, সশ্রদ্ধ নমস্কার নিবেদন করিয়াছি; জবাকুসুম-সঙ্কাশ তরুণ অরুণকে দেখিয়া প্রথম মানব যেমন করিয়া সশ্রদ্ধ নমস্কার করিয়াছিলেন, আমার প্রথম জাগরণ প্রভাতে তেমনি সশ্রদ্ধ বিস্ময় লইয়া যৌবনকে অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়াছি; তাহার স্তবগান গাহিয়াছি।’
নজরুল ছিলেন বিদ্রোহী কবি। তাঁর বিদ্রোহী কবিতা মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করেছেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার বিভিন্ন পঙ্ক্তি, যেমন ‘চির-উন্নত মম শির’ শুনলে সকলের মনে এক ধরণের বিদ্রোহী মনোভাব সৃষ্টি হয়। যা সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে আমাদের সাহস জোগায়। তিনি ছিলেন এক অসাম্প্রদায়িক কবি। কারণ তিনি ইসলামি গান (গজল) রচনা করছেন এবং একই সঙ্গে শ্যামা সংগীত লিখেছেন। কবি নজরুল সাম্যের কবি, প্রেমের কবি-সব বিশেষণেই আমরা তাঁকে বিশেষায়িত করতে পারি। কিন্তু সবার আগে কাজী নজরুল ইসলামের মূল্যায়ন হওয়া উচিত মানুষের কবি, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি হিসেবে।
‘গাহি সাম্যের গান-যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,/যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’ বাঙালি যতদিন নজরুলের চেতনা ধারণ করতে পারবে,ততদিন জাতীয় জীবনে যতই বিঘ্ন-বিপদ আসুক, যতই প্রতিকূল অবস্থা হোক না কেন, বাংলাদেশ ও বাঙালির জয় সুনিশ্চিত। তাঁরই নামে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, যা ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত। সেজন্য সরকার থেকে আয়োজিত কেন্দ্রীয় প্রোগ্রামটি আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে উদযাপন করা উচিত।  বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৮ অতিবাহিত করে ১৯ বছরে পদার্পণ করছে। এটি ২০০৬ সালের ৯ মে প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও এটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ কয়েক বছর আগে নেওয়া হয়েছিল। যারা এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছেন, তাদেরও আজকের দিনে স্মরণ করি। প্রথমে বৃহত্তর ময়মনসিংহ সাংস্কৃতিক ফোরাম উদ্যোগ গ্রহণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়টি মূলত বাংলাদেশের প্রথম সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৬ সালে প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয় আইন এটিকে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
১৫ একর জমি নিয়ে শুরু করে বর্তমানে ৫৭ একর জমিতে গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা অনুযায়ী এই পরিমাণ আয়তন বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য পর্যাপ্ত নয়। তাই বর্তমান উপাচার্য  সম্প্রতি ১০০ একর জমি অধিগ্রহণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এটা একটি ইতিবাচক চিন্তা। বর্তমানে ছয়টি অনুষদের অধীন ২৫টি বিভাগে প্রায় ১১ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আধুনিক, স্মার্ট ক্যাম্পাস হিসেবে গড়ে তোলাসহ শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে সীমানা প্রাচীর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এক নতুন মাইলফলক। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ১৮ বছর পেরিয়ে গেলেও নানা বাধায় সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান উপাচার্য এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। যা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবারের একটি দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হবে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিতে দীর্ঘদিন ধরেই সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের দাবি করে আসছিলেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এই সীমানা প্রাচীর নির্মাণের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। যা ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সবার উচিত হবে বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে প্রতিষ্ঠিত করা। যার জন্য সবাইকে যার যার দায়িত্বটুকু সম্পূর্ণভাবে পালন করা উচিত। শিক্ষকদের উচিত হবে গবেষণানির্ভর কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কুয়াশা উৎসব হয়। একমাত্র এখানেই এই সংস্কৃতির চর্চা হয়। যার মাধ্যমে আমাদের দেশ বা জাতির সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়। আশা করি, যত দিন বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তত দিন এই উৎসব উদ্যাপন করবেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকে সবুজায়ন, ফুলের বাগান হবে। সবুজে সবুজে আমাদের হৃদয় ভরে উঠুক নজরুল প্রাঙ্গণ।
নতুন উপাচার্য হিসেবে যোগদানের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণা, শিক্ষাবান্ধব ও আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। আমরাও উপাচার্যের ইতিবাচক সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। শিক্ষা, গবেষণা, গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত, শিক্ষার্থীদের নানা বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করি।
বিশ্ববিদ্যালয়টি যেন আধুনিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন করে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখতে পারে, বর্তমান উপাচার্য সেই উদ্দেশ্যে কাজ করবেন- এটাই আমাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্যগুলো সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে হবে। তাহলেই আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে ভূমিকা রাখা সম্ভব। সম্মিলিত কর্মপ্রচেষ্টা এবং নিয়মতান্ত্রিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় কবির প্রেম ও চেতনায় এগিয়ে যাবে বলেই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। বিশ্ববিদ্যালয়টি নতুন নতুন ফুলে ভরে উঠুক এবং প্রতিটি মানুষ ফুলের মতো তাদের কর্মজীবন পরিচালনা করুক কবির জন্মদিনে এটাই হোক আমাদের ভাবনা।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

প্যানেল

×