
নজরুলজয়ন্তী আজ
গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান/যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান...। কবিতার পঙ্ক্তিমালায় এভাবেই তিনি ধর্ম-বর্ণ কিংবা জাতের বিভেদরেখা পেরিয়ে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। হিংসা-বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতা ছাপিয়ে মানবতার মর্মবাণীকে ধারণ করে উচ্চারণ করেছেন- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান ...। আজ রবিবার সেই মহাত্মা কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৭তম জন্মদিন ও ১২৬তম জন্মবার্ষিকী।
১৩০৬ বঙ্গাব্দের এ দিনে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মেছিলেন প্রেমের উল্টোপিঠে দ্রোহের অনলে জ্বলে ওঠা এ কবি। জাতীয় কবি নজরুলের এবারের জন্মদিন এসেছে ভিন্ন এক আবহে। যেখানে মিশে রয়েছে বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজের আকাক্সক্ষা। যুক্ত হয়েছে ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানের অনুপ্রেরণা। অসীম সাহসে বুকের রক্ত ঢেলে স্বৈরশাসনের অর্গল ভেঙে প্রতিবাদী অনুপ্রেরণার হয়েছেন চির বিদ্রোহী নজরুল। তাই তো এবার জাতীয় জাতীয়ভাবে নজরুলজয়ন্তী উদ্্যাপনের প্রতিপাদ্য ‘চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান : কাজী নজরুলের উত্তরাধিকার’।
বর্ণিল আয়োজনে এবার জাতীয়ভাবে উদ্যাপিত হবে নজরুলের জন্মদিন। রাজধানীর ঢাকার পাশাপাশি নজরুলের স্মৃতিধন্য কুমিল্লায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে আয়োজন। নজরুলের জীবনসঙ্গী জন্মভিটা মানিকগঞ্জের জমিরদার বাড়ি আঙিনায়ও থাকছে পৃথক আয়োজন। গানের সুরে, কবিতার ছন্দে, নাচের নান্দনিকতা কিংবা নজরুলকে নিবেদিত বিশিষ্টজনদের কথনে সজ্জিত হয়েছে এসব অনুষ্ঠামালা। এর বাইরে বাংলা একাডেমি, ছায়ানটসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে উদ্যাপিত হবে কবির জন্মদিন।
জাতীয় কবির জন্মদিন উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই বাণীতে তিনি বলেন, নজরুলের কবিতার মূল বিষয় ছিল মানবতার জয়গান এবং মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার, সাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। নজরুলের অমর সৃষ্টি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল আন্দোলন-সংগ্রামে আমাদের অনুপ্রেরণা ও সাহস যুগিয়েছে।
অপরদিকে নারীর অধিকার কিংবা সমতার সমাজ বিনির্মাণেও পথের দিশা হয়ে ওঠে নজরুলের সৃষ্টিসম্ভার। অগ্নিবীণা হাতে বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করা এই কবির প্রকাশটা যেন ছিল ধূমকেতুর মতো। এ কারণেই ধর্মীয় মৌলবাদ থেকে নারী-পুরুষের বিভেদÑকোনোটাকেই মেনে নেননি নজরুল। সমাজে সম্প্রীতির বারতায় ছড়িয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে বলেছেনÑ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান ...। সমঅধিকারের আকাক্সক্ষায় উচ্চারণ করেছেনÑ বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর ...।
ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝে বেড়ে ওঠা কাজী নজরুল জন্মেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়া গ্রামের দরিদ্র পরিবারে। মক্তবে পড়ালেখার মাধ্যমে তার শিক্ষা জীবনের সূচনা হয়। তবে বাবার মৃত্যুর পর আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি এগোয়নি। মাত্র ১০ বছর বয়সে কাঁধে তুলে নেন পরিবারের ভার। জীবিকার তাগিদে কাজ করেছেন রুটির দোকানে। তরুণ বয়সে সেনাসদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। করেছেন রাজনীতিও। সাহিত্য চর্চার শুরুটাও বালক বয়সে। লেটো দলে যোগ দিয়ে শুরু হয় তাঁর সাহিত্য চর্চা। নজরুলের কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি। কবি বিশেষ আলোড়ন তুলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে।
শোষকের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে তিনি লিখেছিলেন, ...আমি ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা সঞ্চারি ভূমিকম্প ....। তার রচিত আরেক বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা।’ এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়াজাগানো কাব্য সংকলন ‘অগ্নিবীণা।’ বাংলা কাব্যের ভুবনে অগ্নিবীণা ছিল বাক বদলের এক নতুন দিগন্ত। তাই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থের ‘প্রলয়োল্লাাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’ কবিতাগুলো তুমুল হৈ চৈ ফেলে দেয় সর্বত্র।
নজরুল গদ্য রচনার বেলায়ও ছিলেন স্বতন্ত্র চিন্তার। তাঁর প্রথম গদ্য ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক জীবনে করাচী সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেন তিনি। এখান থেকে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের মূল সূচনা ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। সেনানিবাসেই তিনি লিখেছেন ‘হৈনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’ ও ‘ঘুমের ঘোরে’ গল্পগুলো। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের গল্প সঙ্কলন ‘ব্যথার দান।’ একই বছর প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘যুগবাণী।’ তবে নজরুলের সৃষ্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে আছে সঙ্গীত। বৈচিত্র্যময় বাংলা গানের সবচেয়ে বড় ভান্ডার রেখে গেছেন কবি। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গান রচনা করেন তিনি। সুর বৈচিত্রে ভরপুর এসব গান বাংলা সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি অনন্য এক উচ্চতায় আসীন করেছে। তার সৃষ্ট রাগগুলোও দারুণ বিস্ময় জাগায়।
নজরুলজয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালা ॥ জাতীয় পর্যায়ে নজরুলজয়ন্তী উদ্যাপনে এবার তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। আজ রবিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত কুমিল্লায় এই আয়োজন অনুষ্ঠিত হবে। আজ বিকেলে কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি সচিব মো. মফিদুর রহমান। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেবেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মোঃ লতিফুল ইসলাম শিবলী এবং কবিপৌত্রী ও নজরুল ইসলাম ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান খিলখিল কাজী।
অনুষ্ঠানে ‘নজরুল পুরস্কার ২০২৩ ও ২০২৪’ এর জন্য মনোনীত গুণীজনদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে। আলোচনা শেষে শুরু হবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নিবেদন ‘চেতনা ও জাগরণে নজরুল’ শীর্ষক সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। অনুষ্ঠানের শুরুতেই সমবেত সংগীত ‘জয় হোক’ ও ‘মনের রং লেগেছ’ পরিবেশন করবেন একাডেমির শিল্পীবৃন্দ। ‘খেলিছো এ বিশ্বলয়ে’ ও ‘প্রিয় এমন রাত যেনো যায় না বৃথা’ শিরোনামের গান শোনাবেন প্রখ্যাত নজরুলসংগীত শিল্পী ফেরদৌস আরা। একাডেমির নৃত্যশিল্পীবৃন্দ পরিবেশন করবেন সমবেত নৃত্য। আরমিন মুসার সংগীত পরিচালনায় সমবেত সংগীত ‘জাগো নারী জাগো’, ‘রুমঝুম রুমঝুম’ ও ‘দূর দ্বীপবাসিনী’ পরিবেশন করবে ঘাস ফড়িং কেয়ার। সব শেষে রেবেল ব্যান্ড পরিবেশন করবে ‘পরদেশী মেঘ’, ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ ও ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ গান তিনটি।
নাচ-গান ও আবৃত্তির আজ রবিবার থেকে শুরু হবে ছায়ানট আয়োজিত দুই দিনব্যাপী নজরুল উৎসব। প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটায় অনুষ্ঠানের সূচনা হবে।