
শেরপুরে বিস্তীর্র্ণ মাঠজুড়ে হাইব্রিড ধানের চাষ
জাতীয় অর্থনীতিকে মজবুত করতে কৃষি খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। গুরুত্বপূর্ণ এই খাত থেকে বরাবরই আশাব্যঞ্জক জোগান দিয়ে আসছে শেরপুর অঞ্চলের কৃষি। তারই ধারাবাহিকতায় এবার এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে উন্নত জাতের হাইব্রিড বীজ ধান। এ বছর ৭৫০ একর জমিতে চীনা জাতের এফ-১ জাতের হাইব্রিড বীজ ধানের আবাদ হয়েছে, যা থেকে প্রায় ৭০০ টন বীজ ধান পাওয়া যাবে।
কৃষি বিভাগ বলছে, জেলায় হাইব্রিড জাতের বীজ ধান চাষ শুরু হওয়ায় স্থানীয়ভাবে ৮০ ভাগ বীজের চাহিদা মিটবে। এতে নতুন কৃষি উদ্যোক্তা তৈরির পাশাপাশি কমবে হাইব্রিড বীজ আমদানি নির্ভরতা। একইসঙ্গে কমবে বীজ ধানের দাম। জেলার কৃষিতে তৈরি হবে নতুন এক সম্ভাবনা।
জেলা কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, ২০২৪ সালে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলায় প্রথমবারের পরীক্ষামূলকভাবে হাইব্রিড বীজ ধান উৎপাদন শুরু হয়। ফলন ভালো হওয়ায় চলতি বছর ব্যক্তি উদ্যোগ ছাড়াও কৃষিবিদ গ্রুপ, লাল তীর, সিনজেনটা, ইস্পাহানি, মদিনা সিডসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চীনা এফ-১ বোরো হাইব্রিড জাতের বীজ ধানের চাষ করেছে। হাইব্রিড ধানে ফলন বেশি হওয়ায় কৃষকরা এ ধান চাষে বেশি আগ্রহী হয়ে থাকেন।
তবে হাইব্রিড বীজ ধান চীন ও ভারত থেকে আমদানি করায় দাম বেশি পড়ে। তাই স্থানীয় চাহিদা মেটাতে নালিতাবাড়ী উপজেলার কৃষি উদ্যোক্তা কৃষিবিদ সাজ্জাদ হোসাইন তুলিপ কফি চাষে সফলতার পর এবার চীনা জাতের এফ-১ হাইব্রিড বীজ ধান আবাদ করেছেন। কৃষিবিদ গ্রুপের সহযোগিতায় স্থানীয় খালভাঙ্গা গ্রামে ৩৩ একর জমিতে বীজ ধানের চাষ করেছেন তিনি। এ হাইব্রিড বীজ ধান জেলায় চাষাবাদ হওয়ায় কৃষকদের ধান বীজের চাহিদা মিটবে। পাশাপাশি কমবে বীজ ধানের দাম। উন্নত হবে স্থানীয় কৃষি অর্থনীতি।
কৃষি বিভাগ আরও জানায়, চীনা এফ-১ জাতের ধান গাছে তুলনামূলক রোগ-বালাই অনেক কম। এ ছাড়া অন্যান্য হাইব্রিড জাতের ধানের তুলনায় এই বোরো হাইব্রিড জাতের বীজ ধানে একরে গড় ফলন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ কেজি। আর সাধারণ চাষে এই ধানে একরে গড় ফলন ১১০ থেকে ১২০ মণ পাওয়া যায়।
সরেজমিন গেলে কথা হয় বীজ ধান চাষি কৃষিবিদ তুলিপের সঙ্গে। তিনি জানান, জমি লিজ, বীজ ধান ক্রয়, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ এবং শ্রমিক খরচসহ একরপ্রতি তার মোট খরচ হবে ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকার মতো। ধান কাটা, মাড়াই করে বীজ ধান সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি পর্যন্ত সব খরচ বাদ দিয়ে একর প্রতি ৪০-৪৫ হাজার টাকা তার লাভ থাকবে বলে আশা করছেন তিনি। তার দেখাদেখি অনেকেই আগ্রহী হচ্ছেন বীজ ধান চাষে।
স্থানীয় কৃষি উদ্যোক্তা মো. সাইফুল আলম বলেন, আমরা প্রতি বছর বোরো আবাদে নানা জাতের হাইব্রিড ধান চাষ করি। একেক জাতের ধানের একেক রকম ফলন হয়। তবে এ বছর নিজ উপজেলায় উন্নত জাতের হাইব্রিড বীজ ধান উৎপাদন হওয়ায় আমরা অনেক আশাবাদী। কৃষক ছামেদুল হক বলেন, এ এলাকায় হাইব্রিড ধানের বীজ উৎপাদন হচ্ছে। বিষয়টি আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের। এ ছাড়া বীজধানে লাভও বেশি। তাই আগামী বছর এই হাইব্রিড ধান চাষ করার চিন্তা করেছি। কৃষক আবুল কালাম জানান, আগে হাইব্রীড ধানের বীজ বেশি দামে কিনতে হতো আমাদের। এবার এলাকাতে বীজধানের চাষ হওয়ায় আগের চেয়ে কম দামে বীজ ধান কিনতে পারব। এতেই আমরা খুশি।
বীজ ধান খেতের পরিচর্যা করতে হয় নিয়মিত। তাই এসব খেতে কর্মসংস্থান হয়েছে অন্তত শতাধিক শ্রমিকের। কৃষি শ্রমিক মো. ফয়জল বলেন, ধান বীজ উৎপাদনের জমিতে আমরা প্রতিদিন ৫০/৬০ জন শ্রমিক কাজ করি। সামনের বছর যদি আরও অধিক জমিতে এই হাইব্রিড বীজ ধানের চাষ হয় তা হলে গ্রামের অনেক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে। আরেক শ্রমিক আনোয়ার মিয়া জানান, বছরের এই সময়টাতে কোনো কাজ থাকে না। তবে এবার বীজ ধানের আবাদ হওয়ায় প্রতিদিনই কাজ পাওয়া যাইতেছে। এখানে কাজ করেই পরিবার চালাইতেছি আমরা।
নালিতাবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. আব্দুল ওয়াদুদ জানান, একসময় এই হাইব্রিড বীজ ধান বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। এখন উন্নত জাতের হাইব্রিড বীজ ধান বাংলাদেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। তাই আমদানিনির্ভরতা কমাতে অন্যান্য জেলার মতো শেরপুরে চীনা এফ-১ বোরো হাইব্রিড জাতের বীজ ধান উৎপাদন শুরু হয়েছে। আমদানি কমলে দেশের ডলার সাশ্রয় হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, এ বছর উপজেলায় ৭৫০ একর জমিতে হাইব্রিড বীজ ধান আবাদ হয়েছে। যেখান থেকে প্রায় ৭০০ টন বীজ ধান উৎপাদন হবে। আর তার বাজারমূল্য দাঁড়াবে প্রায় ১২ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, স্থানীয় কৃষক ছাড়াও বেসরকারি নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলো শেরপুরে হাইব্রিড বীজ ধান উৎপাদনে আগ্রহী। আমরা কৃষি বিভাগের তরফ থেকে বীজ ধান উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোকে ন্যায্যমূল্যে রাসায়নিক সার ও সেচ সুবিধা নিশ্চিতকরণে কাজ করছি। হাইব্রিড জাতের এই বীজ ধানের ভালো ফলন হলে নিজ জেলার চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য জেলায় বিক্রি করা যাবে। একই সঙ্গে বীজ ধান চাষে নতুন নতুন কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি হবে। এতে জেলার কৃষিতে তৈরি হবে নতুন সম্ভাবনা।