
পবিত্র ভূমি, সেই ভূমি যেখানে একের পর এক নবী ও রাসুলের পদচিহ্ন রয়ে গেছে, যেখান থেকে শান্তির বার্তা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল আজ সেখানে বোমার শব্দে আকাশ কাঁপে, শিশুর কান্না চাপা পড়ে ধ্বংসস্তূপের নিচে। এই ভূমি আজ যেন এক উন্মুক্ত কবরস্থান। জাতিসংঘের তথ্যমতে, গাজায় প্রতি মিনিটে ঝরে পড়ছে ৫টি নিষ্পাপ প্রাণ। আপনি যখন এই লেখাটি পড়ছেন, তখন হয়তো কয়েকজন শিশুর নিঃশেষ কান্না পৃথিবী থেকে মুছে যাচ্ছে। কতটা অমানবিক হলে, কতটা ভ্রান্ত হলে, আমরা এই মৃত্যু দেখেও নির্বিকার থাকতে পারি?
এটি কেবল যুদ্ধ নয়, এটি একটি পরিকল্পিত গণহত্যা। একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার সুপরিকল্পিত এক অপারেশন। শুধু যুদ্ধের ময়দানে নয়, এই হত্যাযজ্ঞ চলছে হাসপাতালের বেডে, মসজিদের মিনারে, স্কুলের ক্লাসরুমে এবং এমনকি খাদ্য সাহায্যের লাইনে দাঁড়ানো শিশুদের মাঝেও। আর এই নৃশংসতা ঘটছে বিশ্ব-রাজনীতির ‘শান্তিপূর্ণ কূটনীতি’ আর তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’-এর নাম করে। যখন একটি পক্ষ নিজেদের রক্ষার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তখন তাকে বলা হয় সন্ত্রাস। অথচ যিনি আধুনিক অস্ত্রে, বিমান থেকে আগুন ঝরিয়ে একটি পুরো জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করছেন, তিনি থাকেন রাষ্ট্রীয় বৈধতার বর্মে রক্ষা পাওয়া।
এর বৈধতা দেয় সেই রাষ্ট্রগুলো, যারা নিজেদের মানবতার ধ্বজাধারী বলে দাবি করে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স যেসব দেশ গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলে বিশ্বমঞ্চে, তারাই আজ চুপ। বরং অনেকে অস্ত্র সরবরাহে ব্যস্ত। তারা শান্তি স্থাপনের চেয়ে আগ্রাসন টিকিয়ে রাখতেই বেশি আগ্রহী। কারণ এটি তাদের অস্ত্রব্যবসা ও ভূ-রাজনৈতিক আগ্রাসনের পথ প্রশস্ত করে।
আমরা ফেসবুকে একটি প্রোফাইল ফ্রেম দিচ্ছি, এক মিনিট শোক পালন করছি। কেউ কেউ হয়তো দান করছি এটাও অবশ্যই প্রয়োজনীয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি সত্যিকার অর্থে প্রতিরোধ গড়ছি? আমাদের প্রতিবাদ কতটা কার্যকর? আমরা কি এই ঘটনার গভীরে গিয়ে ভাবছি, বুঝতে পারছি কোন জটিল রাজনৈতিক ও সামরিক চক্র এই বর্বরতার জন্য দায়ী?
এই মুহূর্তে যারা নিরব, যারা কেবল বিবৃতি দিচ্ছে কিন্তু পদক্ষেপ নিচ্ছে না তারা এই হত্যাকাণ্ডের মৌন অংশীদার। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় যখন ইসরাইলের বিরুদ্ধে ন্যূনতম মানবিক অবস্থান নেয়, তখন মার্কিন প্রশাসন তার ফান্ডিং বন্ধ করে দেয়। যেন এক স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হলো মানবতা নয়, রাষ্ট্রীয় স্বার্থই মুখ্য। এই রাজনীতি আজ এমন এক নির্মম পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে একটি শিশুর জীবন আর একটি ক্ষেপণাস্ত্রের দামের চেয়েও কম মূল্যবান।
মনে রাখতে হবে, ইতিহাস কখনই চুপ থাকে না। ইতিহাস সব দেখে, সব লিখে রাখে। যেমন মনে রেখেছে হিরোশিমার ধ্বংস, রুয়ান্ডার গণহত্যা, বসনিয়ার রক্তাক্ত অধ্যায় কিংবা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিপীড়ন। আজকের এই হত্যাযজ্ঞও লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায় কালো কালিতে, রক্তাক্ত অক্ষরে। ভবিষ্যতের শিশুরা একদিন প্রশ্ন করবে তোমরা তখন কী করেছিলে? আমরা কি বলবো, আমরা ব্যস্ত ছিলাম নিজের ক্যারিয়ার, নিজের জীবনের ছোট ছোট উদ্বেগে? আমরা কি বলবো, আমরা নিরুপায় ছিলাম? অথবা আমরা হয়তো বলবো, “আমরা তো পোস্ট দিয়েছিলাম।” কিন্তু ইতিহাস এসব উত্তর গ্রহণ করবে না। ইতিহাস বিচার করে কর্মকাণ্ড দিয়ে, মৌনতা নয়।
এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুর্যোগ হচ্ছে আমাদের অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া। প্রতিদিনের মৃত্যুর খবরে আমরা আর কাঁদি না, ছবি দেখে চোখ সরিয়ে নেই, ভিডিও এড়িয়ে যাই। এক সময় যা ছিল হৃদয়বিদারক, এখন তা হয়ে গেছে ‘নিউ নরমাল’। এটাই মানবতার সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষয়। যে শিশুটি মারা যাচ্ছে, সে হতে পারতো ভবিষ্যতের একজন কবি, চিকিৎসক, গবেষক কিংবা কেবল একজন সাধারণ মানুষ যার ভালোবাসায় ভরে যেত একটি পরিবার। অথচ আমরা সেই সম্ভাবনাকে বাঁচাতে কিছুই করছি না। এই অবস্থানহীনতা, এই নীরবতা এটাই সবচেয়ে বড় অপরাধ।
আমরা যদি চাই, আমরা পারি বদল আনতে। ইতিহাসের গতিপথ কোনো একক রাষ্ট্র কিংবা নেতা নির্ধারণ করে না। এটি গড়ে ওঠে সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ, প্রতিবাদ, ঐক্যের ভিত্তিতে। আজকের পৃথিবী প্রযুক্তিনির্ভর, তথ্যপ্রবাহের গতিশীলতায় ভরপুর আমরা যদি সোচ্চার হই, সংগঠিত হই, সত্যকে তুলে ধরি, তাহলে সেই তরঙ্গ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে। আজ সবচেয়ে বড় প্রশ্ন আমরা কি মানবতা হারিয়ে ফেলেছি? না কি আমরা সেই কণ্ঠস্বর, যারা এখনো বিশ্বাস করে একটি শিশুর হাসি পুরো যুদ্ধবাজ বিশ্বের চেয়ে মূল্যবান? আমরা কি সেই আলো, যারা অন্ধকারে একটা মোম জ্বালাতে জানি?
এই পৃথিবী রক্ষা পাবে তখনই, যখন প্রতিটি বিবেকবান মানুষ দাঁড়াবে সত্যের পক্ষে। যখন আমাদের কলম, কণ্ঠ ও অবস্থান একসাথে বলবে আর নয়। ইতিহাস আজ আমাদের এক কঠিন পরীক্ষার মুখে দাঁড় করিয়েছে। এখনই সময় প্রতিবাদ করার, এখনই সময় মানুষের পক্ষে দাঁড়ানোর। আপনি কী করবেন?
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল