
‘গুজব’ বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত একটি শব্দ। দিনকে দিন এটি এক ভয়ংকর রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হচ্ছে। ডিজিটাল যুগে তথ্যের প্রবাহ যত সহজতর হচ্ছে, ঠিক ততটাই দ্রুত ও বিস্ফোরকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে ‘গুজব’।
অনলাইন ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এক বছরে ৫২ শতাংশ ‘গুজব’ বেড়েছে, যা রাষ্ট্র ও সমাজের বিভ্রান্তি ও অস্থিরতার গভীর চিত্র তুলে ধরে। ধর্ম, রাজনীতি থেকে শুরু করে ব্যক্তি স্বার্থ সবক্ষেত্রেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে গুজবের ব্যবহার বেড়েছে।
বিশেষ করে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে প্রতিদিন অসংখ্য ভুয়া গুজব ছড়ানো হচ্ছে। প্রযুক্তির অপব্যবহার, যাচাইবিহীন শেয়ার এবং সাধারণ মানুষের অনিশ্চিত তথ্যজ্ঞান এ সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে।
গুজবের ভয়াবহ প্রভাব কেবল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নয়, বরং সামগ্রিক সামাজিক সম্প্রীতির ওপরও পড়ছে বিরূপ ছায়া।
গুজবের লাগামছাড়া বিস্তারের মূল কারণ হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দায়িত্বহীন ব্যবহার, তথ্য যাচাইয়ের অভাব এবং সচেতনতার সংকট। অধিকাংশ ভুয়া তথ্য এমন আইডি থেকে ছড়ায়, যেগুলোর পরিচয় যাচাই করা হয় না।
কেউ নিজের পরিচয় গোপন রেখে, আবার কেউ অন্যের নাম-ছবি ব্যবহার করে ভুয়া প্রোফাইল খুলে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে। অনেক সময় রাজনৈতিক স্বার্থে বা ধর্মীয় উগ্রতা ছড়ানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে ‘গুজব’ ছড়ানো হচ্ছে।
কিছু উঠতি কনটেন্ট ক্রিয়েটর জনপ্রিয়তা পাওয়ার আশায় যাচাইবিহীন স্পর্শকাতর বিষয় শেয়ার করে, যা পরে বড় আকারে বিভ্রান্তি তৈরি করে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যাদের ডিজিটাল শিক্ষা সীমিত, তারা এসব তথ্য যাচাই না করেই বিশ্বাস করে। ফলে ‘গুজব’ হয়ে ওঠে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক।
রিউমার স্ক্যানারের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালে শনাক্ত হওয়া প্রায় তিন হাজার গুজবের বড় অংশই ছিল রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে ছড়ানো। ধর্মীয় সংবেদনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে জনগণকে বিভাজনের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, যেমন কিছু দিন আগে ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের নামে ভুল তথ্য ছড়িয়ে ‘বাটা’র মতো কিছু প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়েছে।
প্রতিনিয়ত সংবাদমাধ্যমের নাম ব্যবহার করে বানানো ভুয়া ফটোকার্ডের মাধ্যমে অনেকের সুনামহানি, ব্যবসায় ক্ষতি, এমনকি সামাজিক প্রতিহিংসার জন্ম দেওয়া হচ্ছে। গুজব ছড়ানোর এমন ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে, এটি আর স্বাভাবিক ভুল নয় বরং একটি সুপরিকল্পিত অপচেষ্টা।
রাজনৈতিক দলগুলোর একাংশ, উগ্রবাদী গোষ্ঠী এবং দুষ্টচক্রের কনটেন্ট নির্মাতারা এই ষড়যন্ত্রে জড়িত। ফলে আমাদের সমাজ এখন সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে না পারা এক বিভ্রান্তির জগতে বাস করছে।
এই পরিস্থিতির ভয়াবহতা আরও গভীর হয়েছে ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে, যেখানে ভুল তথ্যের প্রকোপ নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে।
রিউমার স্ক্যানারের সর্বশেষ গত ২৬ এপ্রিলের রিপোর্ট অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে ৮৩৭টি ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে, যা ২০২৪ সালের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ বেশি এবং ঠিক আগের প্রান্তিকের তুলনায় (২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর) প্রায় ২১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষ করে রাজনৈতিক উত্তাপ ও ধর্মীয় ইস্যুকে কেন্দ্র করে ভুল তথ্যের বিস্তার ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। এই তথ্যপ্রবাহের উন্মত্ততায় সঠিক খবর হারিয়ে যাচ্ছে, আর তার ফাঁকে অসংখ্য ষড়যন্ত্রমূলক গুজব রাষ্ট্র ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ছে, যেন একটি বর্ণহীন, গোপন ভাইরাসের মতো।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো একক ব্যক্তি হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে, যার মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে ৮০ শতাংশই তার পক্ষে। অন্যদিকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জড়িয়ে প্রচারিত ৫১টি গুজবের মধ্যে ৯০ শতাংশই ছিল নেতিবাচক।
চলতি বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ছড়ানো ১৭৯টি গুজবের ৯৩ শতাংশই ছিল সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্টের উদ্দেশ্যে। এ ধরনের প্রবণতা শুধু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং গোটা রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বিষাক্ত করে তুলছে। মিডিয়া লিটারেসির অভাব, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং ঘৃণা ছড়ানো প্রচারের সমন্বয়ে তৈরি হচ্ছে এক অন্ধকার তথ্যবাস্তবতা।
‘গুজব’ সমাজে বিশৃঙ্খলা, দাঙ্গা এবং সহিংসতার জন্ম দেয়। যেমন, ভুল তথ্যের ভিত্তিতে কোনো প্রতিষ্ঠানকে ‘ইসরাইলি’ হিসেবে চিহ্নিত করে হামলা চালানো শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি নয়, এটি সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো, বিনিয়োগ পরিবেশ এবং আইনশৃঙ্খলার ওপর আঘাত।
পাশাপাশি, রাজনৈতিক গুজব নির্বাচনী পরিবেশকে প্রভাবিত করে, ভোটারদের বিভ্রান্ত করে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে দেয়। ধর্মীয় গুজব সমাজে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ায়, সংখ্যালঘুদের আতঙ্কে ফেলে দেয়।
এ ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রচার যুব সমাজের মাঝে উগ্র মনোভাব তৈরি করে এবং সামাজিক সম্প্রীতিকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় সাধারণ জনগণের তারা একটি বিভ্রান্তিকর তথ্য বিশ্বাস করে পরবর্তীতে নিজেও গুজবের বাহক হয়ে ওঠে, ফলে বিভ্রান্তি আরও বহুগুণে ছড়িয়ে পড়ে।
গুজবের এ সর্বগ্রাসী বিস্তার আমাদের সামাজিক ঐক্য, বিবেচনাশক্তি ও তথ্যবোধকে ধ্বংস করছে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রথমেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করতে হবে। প্রতিটি অ্যাকাউন্টের সত্যতা যাচাই, ভুয়া আইডি শনাক্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।
‘গুজব’ ছড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথাযথ ব্যবহার এবং আইনের অপব্যবহার বন্ধ রাখতে হবে। একই সঙ্গে নাগরিক পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গণমাধ্যমে ধারাবাহিক প্রচার, স্কুল-কলেজে ডিজিটাল শিক্ষা অন্তর্ভুক্তি এবং কমিউনিটি পর্যায়ে তথ্য যাচাইয়ের প্রথা চালু করা যেতে পারে।
ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাষ্ট্রীয় সহায়তা দিয়ে শক্তিশালী করা দরকার। পুলিশের সাইবার ইউনিটকে আরও দক্ষ করে ‘গুজব’ চিহ্নিত ও দমন অভিযান জোরদার করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠন, গণমাধ্যম এবং সচেতন নাগরিকদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
‘গুজব’ এখন আর কেবল তথ্য বিভ্রাট নয়, এটি এক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি। ধর্ম, রাজনীতি কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থে ছড়ানো এই গুজব সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভাজন সৃষ্টি করছে। তাই সময় এসেছে এই বিষবৃক্ষের শিকড়ে আঘাত হানার।
প্রযুক্তি, আইন, শিক্ষা এবং সচেতনতার সমন্বয়ে গুজব প্রতিরোধে একটি জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। সত্যকে তুলে ধরা এবং মিথ্যাকে প্রতিহত করাই হবে আমাদের আগামী দিনের সবচেয়ে বড় লড়াই।
লেখক : সাংবাদিক
কুতুবে রব্বানী