ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৭ মে ২০২৫, ২৩ বৈশাখ ১৪৩২

ফসল উৎপাদনে ন্যানো ফার্টিলাইজার

ড. এম আব্দুল মোমিন

প্রকাশিত: ২১:৩১, ৬ মে ২০২৫

ফসল উৎপাদনে ন্যানো ফার্টিলাইজার

ন্যানো ইউরিয়া উদ্ভাবন করে সাড়া ফেলেছেন

সম্প্রতি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাভেদ হোসেন খান ন্যানো ইউরিয়া উদ্ভাবন করে সাড়া ফেলেছেন। ন্যানো ফার্টিলাইজার বা ন্যানো সার হচ্ছে ‘স্লো রিলিজার’। এটি ফসলের ক্ষেতে ব্যবহার করলে গাছের গোড়ায় জমা থাকবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী গাছকে পুষ্টি সরবরাহ করতে সক্ষম হবে।

কোনো অপচয় যেমন হবে না, তেমনি গাছটিও সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করতে পারবে। আকারে ছোট হওয়ায় বীজের ক্ষুদ্র ছিদ্র দিয়ে বা পত্র রন্ধ্র দিয়ে এই পার্টিকেল বীজ বা পাতার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেও প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করতে পারবে। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে বহুলাংশে। 
ফসল উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সার। আগের দিনে কৃষক গৃহস্থালির সকল আবর্জনা এক জায়গায় জমা করত। পরে তা পচিয়ে সার হিসেবে ব্যবহার করত। হাঁস-মুরগির খোয়াড় বা গোয়ালঘর থেকে যেসব গৃহপালিত পশু-পাখির বিষ্ঠা আসত, সেগুলোকে পচিয়ে জমিতে দিত। এতে ভালো ফসল হতো।

৬০ দশকের শেষের দিকে যখন বাজারে রাসায়নিক সার যেমন- ইউরিয়া, নাইট্রোজেন, ফসফারস এবং পটাশ আসে, তখন জৈব সারের সঙ্গে রাসায়নিক সার দেওয়ার কারণে ফসল উৎপাদনে বেশ বড় পরিবর্তনের সূচনা হয়। মাটির উর্বরতা রক্ষা ও স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি উৎপাদনের তাগিদে দিনে দিনে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে রাসায়নিক সার। কৃষকের ম্যাক্রো নিউট্রিয়েন্ট হিসেবে জমিতে রাসায়নিক সার নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম (এনপিকে) ব্যবহার বৃদ্ধি পায়।

কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে নিবিড় চাষাবাদের কারণে উর্বরতা হারাতে থাকে মাটি। মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সুরক্ষার জন্য কৃষক জমিতে যে সার ব্যবহার করে তার মাত্র ৩০-৩৪ ভাগ ফসলের কাজে লাগে। আর শতকরা ৬০-৭০ ভাগ অপচয়ের মাধ্যমে ক্ষেতের পার্শ্ববর্তী জলাশয় বা অন্যান্য পানির সঙ্গে মিশে পরিবেশের ক্ষতি সাধন করে থাকে। এ সমস্যা সমাধানে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে আসছেন বিজ্ঞানীরা। তারই ফল হচ্ছে- ন্যানো ফার্টিলাইজার বা ন্যানো সার।
বিশ্বের সর্বাধুনিক ন্যানো টেকনোলজির সাহায্যে উদ্ভাবিত ‘ন্যানো সার’ ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং উৎপাদন ব্যয় কমানোর পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অবদান রাখবে বলে আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা। আশার কথা হচ্ছে, সম্প্রতি দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশে বসেই ন্যানো ইউরিয়া তৈরি করেছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাভেদ হোসেন খান।

ড. জাভেদের সঙ্গে ইতোমধ্যে এই সার বাণিজ্যিকীকরণের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে যুক্তরাষ্ট্রের জৈব সার কোম্পানি ‘কোলাবায়ো’। এই সার জনপ্রিয়করণে আগামী পাঁচ বছর যৌথভাবে রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট চালাবেন তারা। এর আগে বাংলাদেশ কাউন্সিল ফর সাইন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের (বিসিএসআইআর) বিজ্ঞানীগণ ন্যানো ফার্টিলাইজার তৈরির পর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদনে যাওয়ার উদ্যোগে নিলেও তা বেশিদূর এগোয়নি।

ন্যানো টেকনোলজি বিশ্বের অত্যাধুনিক ক্ষুদ্র প্রযুক্তি, যা সহজেই ফসলের মূলে প্রবেশ করে তার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করতে পারে। এর ব্যবহারে তৈরি সার ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয় হ্রাস এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাতেও সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। 
আরেকটি ভাবনার বিষয় হচ্ছে, কৃষকদের একটা প্রচলিত ধারণা হলো বেশি সার দিলে উৎপাদন বেশি হয়। ফলে তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত সার ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু খেতে দেওয়ার পর প্রায় ৭০ ভাগ সার গ্যাস আকারে উড়ে যায় অথবা মাটির নিচে লিচিং হয়ে মাটি ও পানিতে মিশে দূষিত করে পরিবেশ।

এতে একদিকে মাটির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, আরেকদিকে অ্যামোনিয়া আকাশে উড়ে গ্লোবাল ওয়ার্মিং হচ্ছে। এর কারণে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এড়াতে নতুন টেকনোলজি ‘ন্যানো সার’ বা ন্যানো ফার্টিলাইজার সহায়ক হবে বলে দাবি করছেন গবেষকরা। 
জেনে নেওয়া যাক ন্যানো ফার্টিলাইজার কি এবং কিভাবে কাজ করে? ন্যানো ফার্টিলাইজারকে ন্যানো মিটার দিয়ে পরিমাপ করা হয়। ১ ন্যানো মিটার সমান হচ্ছে টেন টু দি পাওয়ার মাইনাস ৯ মিটার বা ১ বিলিয়ন অফ এ মিটার। বস্তুকে ভেঙে যখন অতটা ক্ষুদ্রতর পর্যায়ে নেওয়া হয় তখন তার কার্যক্ষমতা বহুলাংশে বেড়ে যায়, অনেকটা পারমাণবিক শক্তির মতো।

ন্যানো পার্টিকেলের আকার অণুর চেয়ে সামান্য বড়। এটা এমন একটি সার যেখানে ফসলের প্রয়োজনীয় অনেক পুষ্টি উপাদানকে একসঙ্গে মিশিয়ে উপাদানগুলোকে কম্প্যাক্ট করে পলিমারাইজড করা হয়। ফলে এর গ্রহণযোগ্যতা ও স্থায়িত্ব বেড়ে যায়। গাছ দ্রুত এবং দীর্ঘ সময় ধরে এটা নিতে পারে। এতে লাভ হচ্ছে একবার সার ব্যবহার করে দুই ফসল ফলানো যায়। কেননা, আমাদের দেশে একই জমিতে বছরে দুই বা তিনটি ফসল হয়।

একেক ফসলের জন্য একাধিকবার সার দিতে হয়। এতে সারের খরচ যেমন বাড়ে তেমনি আনুপাতিক হারে মাটি ও পানি দূষিত হচ্ছে লিচিং লসের কারণে। আবার এমোনিয়া আকাশে উড়ে বায়ুম-ল দূষিত হচ্ছে। কৃষককে কিন্তু এগুলো কিনতে হচ্ছে। ভর্তুকি থাক আর যাই থাক, তারপরও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে উপায়টা কি? উপায় হচ্ছে ন্যানো ফার্টিলাইজার।
ন্যানো সারের পলিমারাইজড খাদ্য উপাদান গাছের গোড়ায় একবার ব্যবহার করলে কমপক্ষে দুটো ফসল ফলানো সম্ভব।

এটা আট মাস পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। এটা একটা বিষয়। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, এপ্লিকেশনের দিক দিয়েও বৈচিত্র্য আছে। আমাদের দেশের কৃষক নাইট্রোজেন ফসফেট কিনে নিয়ে যায় বস্তা ধরে। তিনটা বস্তা নিল। নিয়ে গিয়ে খেতের পাশে একটা চট পেতে নিল। তার ওপরে ঢেলে দিল। তারপর হাত দিয়ে মেশানো শুরু করল। এখন একটা ফসফেটের দানা একটা ইউরিয়ার দানার চেয়ে অনেক বড়। আবার একটা ইউরিয়ার দানা ফসফেটের দানার চেয়ে অনেক ছোট। আর পটাশিয়াম দানাটা কৃষ্টাল।

তিনটাকে মেশানো হলো। ছিটানের সময় কি হলো, বড় দানাটা আগে হাতে আসবে। তাহলে যে এলাকাতে বড় দানাটা পড়ল, সেখানে ফসফেট বেশি পড়ল। তারপর আরেক পাশে ইউরিয়া বেশি পড়ল। আরেক পাশে পটাশিয়াম বেশি পড়ল। একই খেতের মধ্যে অর্থাৎ, একটা কৃষকের খেত যদি বিশ শতক হয়, তার মধ্যে যদি তিন ভাগের এক ভাগে ফসফেট বেশি পড়ে, তারপর তিন ভাগের আরেক ভাগে ইউরিয়া বেশি পড়ে এবং তিন ভাগের অপর ভাগে পটাশিয়াম বেশি পড়ে। তাহলে কি হবে? ফলনের তারতম্য হবে। সুতরাং সারের অপচয় রোধ ও সঠিক মাত্রায় ব্যবহার নিশ্চিত করতে ন্যানো সারের বিকল্প নেই। 
একটা নতুন টেকনোলজি হিসাবে এটাকে কিভাবে কৃষকের কাছে কমিউনিকেট করতে হবে। ইদানীং আমরা যেটা করেছি, দেশে ফার্টিলাইজার আইন আছে, পলিসি আছে এবং এগুলোর একটা মানদ- আছে। কিন্তু এটির কোনো পলিসি নেই। সেদিকেও নজর দিতে হবে। এটি করতে পারলে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে আশা করা যায়। ন্যানো ফার্টিলাইজার হলো একটি সলিউশন বা সমাধান।

ইতোমধ্যে ন্যানো ফার্টিলাইজারের টেস্ট ট্রায়াল শুরু করেছে সরকারি-বেসরকারি গবেষণা সংস্থাসহ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। গতানুগতিক ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমিয়ে ন্যানো ইউরিয়া সারের ব্যবহার বাড়ানো গেলে ফসল উৎপাদনের এই ব্যয় অন্তত ৫০ ভাগ কমানো সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দেশের প্রধান খাদ্যশস্য ভাতের চাহিদা মেটাতে দেশে বছরে ধান উৎপাদন হয় প্রায় ৬ কোটি টন।

আর তা উৎপাদনে প্রতি বছর কৃষিজমিতে ব্যবহার হয় প্রায় ৩০ লাখ টন ইউরিয়া সার, যার ৮০ শতাংশই পূরণ করতে হয় আমদানির মাধ্যমে। বিশাল অঙ্কের এ সার আমদানিতে প্রতি বছর বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয়। তেমনি রাসায়নিকের ব্যবহারে কমে যাচ্ছে ফসলি জমির উর্বরতাও। এ সমস্যার সমাধান দিতে পারে ন্যানো সারের ব্যবহার। 
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাভেদ হোসেন খান বলেন, এক কেজি ইউরিয়া সরকার ৯০-৯২ টাকা দরে আমদানি করে। সে সার কৃষক পর্যায়ে বিক্রি করে প্রতিকেজি ২৭ টাকা হারে। সে হিসেবে প্রতি কেজির জন্য অন্তত ৬৩-৬৫ টাকা হারে ভর্তুকি দেয় সরকার। ড. জাভেদ এর মতে, এখন যেখানে ধানি জমিতে বিঘাপ্রতি ৪২০০ টাকার ইউরিয়া লাগে, সেখানে ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহার করলে খরচ হবে মাত্র ২৩০ টাকা। উল্লেখ্য, গত বছর ১৬ লাখ ২৩ হাজার টন ইউরিয়া আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। ন্যানো ইউরিয়ার ব্যবহার বাড়িয়ে এই ব্যয় অন্তত অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব।
পাশাপাশি জৈব সারের ব্যবহারও বাড়াতে হবে। আমাদের জমিগুলোতে প্রতিনিয়ত চাষবাসের কারণে কম্প্যাক্ট হয়ে যাচ্ছে। মাটিতে অনুজীবের কার্যক্রম বাড়ানের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ এবং মাটি ফাঁপা হওয়া দরকার। এক্ষেত্রে এখানে যদি জৈব সার না দেই তাহলে কিন্তু জমির সমস্যা হবে। আমাদের দেশে কিন্তু অনেক কিছুর ওয়েস্টেজ হয়, যেমনÑ ধানের নাড়া, বাড়ির আবর্জনা, গোবর, মুরগির বিষ্ঠাÑ সবকিছু মিলে কিন্তু অনেক বর্জ্য আছে।

এই বর্জ্যগুলোকে যদি আমরা সঠিক নিয়মে একসঙ্গে করে মাইক্রোবিল দিয়ে ট্রিট করতে পারি, তাহলে হবে কি এই সমস্ত ফার্টিলাইজর যেমন একদিকে মাটিকে ফাঁপা করবে, আরেকদিকে পানির রিটেনশন বাড়াবে। সঙ্গে সঙ্গে শিকড়ের সক্ষমতা বাড়াবে এবং গাছের যেসব উপাদান দরকার হয় তা সরবরাহ করবে। এই জৈব সার ব্যবহার মাটির উর্বরতা বাড়ায়। অন্য সার প্রয়োগের পর এই সারগুলো গাছ নিতে পারবে। তাতে ফসলের ফলন অনেক বেড়ে যাবে।
পরিশেষে বলা দরকার, ন্যানো টেকনোলজির প্রয়োগ বিশ্বব্যাপী শিল্পায়নের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সে ক্ষেত্রে বিশ্বের উন্নত দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও ড. জাভেদের আবিষ্কৃত ন্যানো সার দেশের কৃষকদের হাতে তুলে দিতে পারলে সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী অগ্রগতি সাধিত হতে পারে।

লেখক : ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ব্রি, গাজীপুর 
[email protected]

×